মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নিজের ভারতজোড়া খ্যাতি আরও খানিকটা বাড়িয়ে নিলেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে আঞ্চলিক দলগুলোকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর সেই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। তিনি সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আজ সারা ভারতের চিকিৎসকদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি সফলভাবে তিনিই করলেন। পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকদের ওপর লাগাতার অকথ্য শারীরিক নির্যাতন এবং তার প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের নিন্দনীয় ভূমিকার পরিণতিতে আজ সারা ভারত জুড়ে পালিত হল প্রতিবাদ দিবস। সারা ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে, এমনকি দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসে পালিত হল প্রতিবাদী ধর্মঘট। কোলকাতার রাস্তায় বেরোল মহামিছিল। চিকিৎসকদের পাশে পাশে মিছিলে হাঁটলেন, ন্যায়ের শাসন দাবি করলেন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সাধারণ অচিকিৎসক মানুষ।
যে সমস্যা এক ঘণ্টায় মেটানো যেত, তাকে সরকারি উদ্যোগে জটিল করে তুলে রোগীদেরও ঠেলে দেওয়া হল চরম দুর্ভোগের মধ্যে। আগেও বারবার চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনাগুলোকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং হাসপাতালের উন্নয়ন সংক্রান্ত চিকিৎসকদের দাবিদাওয়াকে হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পত্রপাঠ। তারই পরিণতিতে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের ভয়াবহ হিংস্রতা এবং চিকিৎসককে হত্যার চেষ্টা ঘটে যাবার পরেও সরকারের তরফে কোনো অনুশোচনা চোখে পড়ল না। বদলে চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে চিকিৎসকদের বাধ্য করা হল আন্দোলনের পথে যেতে।
আরও পড়ুন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে
১০ই জুন ২০১৯ এক পঁচাশি বছরের বৃদ্ধের মৃত্যুর পর দুই ট্রাক বোঝাই সশস্ত্র দুষ্কৃতি এসে একটি সরকারি হাসপাতালকে আক্রমণ করে। সেখানে কর্তব্যরত সরকারি কর্মচারীদের বেধড়ক মারে এবং দুজন চিকিৎসককে খুন করার চেষ্টা করে। ভারি অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এক তরুণ চিকিৎসকের মাথার খুলি ভেঙে হাড়ে গর্ত করে মস্তিষ্কে রক্তপাত করানো হয়। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন এবং অসীম জীবনীশক্তির জোরে একটু একটু করে সেরে উঠছেন। যেকোনো আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন মুখ্যমন্ত্রী এই আক্রমণকে সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে দেখবেন এবং কঠোর হাতে তার মোকাবিলা করবেন, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সেই পথে হাঁটলেন না। তাঁর পুলিশ (পুলিশমন্ত্রী/ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং তিনি) বিনা বাধায় দু'শ জন গুণ্ডাকে ঢুকতে দিল এবং চিকিৎসকদের বাঁচাতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিল না আধ মিনিট দূরে এন্টালি থানা থাকা সত্ত্বেও। তিনি নিজে অদ্ভুত কিছু বক্তব্য পেশ করলেন পরবর্তী কয়েকদিন ধরে, রাজ্যের প্রধান হয়েও আন্দোলনসহ গোটা বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক রঙ দেবার চেষ্টা করলেন এবং রাজ্যে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকা বিজেপি সেই অবিমৃষ্যকারিতা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটল।
মুখ্যমন্ত্রী যদি পরদিন অফিস যাবার পথে একবার আইসিইউতে ভর্তি তরুণ চিকিৎসক পরিবহকে দেখতে যেতেন, তার মাথায় হাত রাখতেন মায়ের মতো আর নীলরতন হাসপাতালের আতঙ্কিত জুনিয়র চিকিৎসকদের সামনে গিয়ে বলতেন, "ভয় পেয়ো না, কাজ করো, আমি তো আছি, আমি সুরক্ষা দেব".... তাহলে আন্দোলন এগোতোই না এতদূর। সদ্য পাশ করা তরুণ ছেলেমেয়েগুলো সরল মনে তাঁকে বিশ্বাস করত, কারণ ওইটুকু স্নেহের কথা, ভরসার কথাই তারা শুনতে চাইছিল। তারপর মাননীয়া নাহয় তাঁর আগেকার সব প্রতিশ্রুতির মতো এবারের প্রতিশ্রুতিও বেমালুম ভুলেই যেতেন, কিন্তু এইটুকু নমনীয়তা দেখালে এতবড় সমস্যা তিনি সাময়িকভাবে এড়াতে পারতেন। তা হল না। তাঁর দম্ভ এই সহজ পথটি রোধ করে দাঁড়ালো। তিনি যে রাজ্যবাসীর অভিভাবক নন, প্রভু… চিকিৎসক সহ সব সরকারি কর্মচারীদের যে তিনি ভৃত্যমাত্র মনে করেন, তা তিনি আবার বুঝিয়ে দিলেন স্বকীয় অমিতভাষণে। ছাত্র ও চিকিৎসকদের নিজের কলেজে বহিরাগত বলে দাগিয়ে দিয়ে এবং হুমকি দিয়ে তিনি বৈরিতাকে চরম সীমায় নিয়ে গেলেন। ইংরেজিতে এই কর্মকাণ্ডকে বলে "burning the bridges". আন্দোলন হুহু করে ছড়িয়ে পড়ল পশ্চিমবঙ্গের সব হাসপাতালে।
আরও পড়ুন, চিকিৎসায় কর্মবিরতি, মানুষের হয়রানি- কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ
পাশাপাশি সক্রিয় হয়ে উঠল ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার বাহিনী। হকিস্টিক হাতে হাসপাতাল আক্রমণ, পাথর ছুঁড়ে একের পর এক জুনিয়র চিকিৎসকের মাথা ফাটানো, অ্যাসিডের বোতল হাতে ভয় দেখানো, মেয়েদের হস্টেলের সামনে প্যান্ট খুলে ধর্ষণের হুমকি, ব্যাংকে টাকা তুলতে যাওয়া ডেন্টাল ছাত্রের চোখ নষ্ট করে দেওয়া, রাতের অন্ধকারে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের হস্টেলে আগুন লাগিয়ে ছাত্রদের পুড়িয়ে মারার চেষ্ট… ইত্যাদি অভাবনীয় নৃশংস পদ্ধতি অবলম্বন করে আন্দোলনটিকে ভাঙার চেষ্টা চলতে লাগল। এর ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হল যে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের পক্ষে নমনীয় হয়ে কিছু পরিষেবা দিতে শুরু করা হয়ে উঠল অসম্ভব। মাঝখান থেকে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন সিনিয়র চিকিৎসক ও অধ্যাপকেরাও। স্নেহভাজন ছাত্রদের ওপর এহেন নির্যাতন তাঁদের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল। তাঁরা দলে দলে পদত্যাগ করতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক সরকারি চিকিৎসক ও অধ্যাপক পদত্যাগ করেছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। নিরো বাঁশি বাজাচ্ছেন।
ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন সাধারণ মানুষও। এখানে সরকারের অঙ্কে ভুল হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা মানুষকে মূর্খ ভেবেছিলেন। মনে করেছিলেন পেটোয়া কিছু লোকের সাহায্যে অপপ্রচার চালিয়ে চিকিৎসকদের আবার ভিলেন সাজানো যাবে এবং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিয়ে ভেঙে যাওয়া ভোট ব্যাংকটিকে আবার জোড়া লাগানো যাবে। সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লেন এবং খেপলেন, কিন্তু শত মিথ্যা প্রচার সত্ত্বেও গরিষ্ঠ সংখ্যক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রুষ্ট হলেন সরকারের প্রতি। সোশাল মিডিয়ায় তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল, স্পষ্ট হল আজকের মহামিছিলে।
আরও পড়ুন, কেন হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ রাখতেই হল?
পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক সংগঠনগুলির ডাকে শুক্রবার ১৪ই জুন বিকেলে মিছিল হল নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ থেকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত। যেহেতু এই আন্দোলন ধসে পড়া সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে, চিকিৎসকদের সুরক্ষার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত দাবিতেও, তাই মিছিলে যোগ দেবার জন্য সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল উদার আহ্বান। তাঁরা এলেন। কেউ অফিস ফেরত, কেউ স্কুল ছুটি নিয়ে ছুটে এলেন। হাজার হাজার মানুষ… রোগী ও চিকিৎসক… পাশাপাশি পথ হাঁটলেন গ্রীষ্মের বিকেলে। স্লোগান উঠল, "উই ওয়ান্ট জাস্টিস।" রোগীরা চিৎকার করে বললেন, "সেভ দ্য সেভিয়রস"... "ডাক্তারের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ"। স্লোগান উঠল, " স্বাস্থ্যের দাবিতে, শান্তির দাবিতে আমাদের সংগ্রাম চলছে চলবে।" রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাঠি হাতে পুলিশ কনস্টেবলও স্মিত হাদিতে জানিয়ে দিলেন, সরকারের আজ্ঞা মানতে বাধ্য হলেও তাঁর অন্তর রয়েছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো, বাড়ির বারান্দায় জড়ো হওয়া অগুন্তি মানুষ অবাক হয়ে দেখছিলেন, যেন ভরা বর্ষার ব্রহ্মপুত্র সগর্জনে ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। মোটরসাইকেল থামিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেড় মাইল লম্বা মিছিলের ভিডিও তুলছিলেন নব্য যুবকেরা। এই ছবি তাঁরা রাখবেন নিজেদের সঞ্চয়ে। এই ছবি তাঁদের জোগাবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস।
পরিচিত নাট্যকর্মীকে মিছিলে দেখে ধন্যবাদ জানাতে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, "সে কী? এই মিছিল তো আমাদেরও। ধন্যবাদ নয়, এসো পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাই।" তাঁর কথা শুনে চোখে জল এল, বুকে বল এল। এত মিথ্যা রটনার পরেও মানুষের সঙ্গে চিকিৎসকদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভেঙে দিতে পারেনি তাহলে ক্ষমতাবানেরা! আমরা সকলে মিলে তাহলে আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারব অর্ধমৃত স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে! পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোর অভাবে বারান্দায় পড়ে কাতরাতে হবে না ডেঙ্গু রোগীদের, অকালে মরে যেতে হবে না দুধের শিশুদের! সেই সুদিন আমরা আনতে পারব! পারব। নিশ্চয় পারব।
মিছিলের কলেবর দেখে, আওয়াজ শুনে সরকারের উপর মহল ভয় পেয়েছেন। টের পেয়েছেন সিংহাসনের নিচের ভূমিকম্প। তাঁদের সুর বদলাতে আরম্ভ করেছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে "আলোচনা" শব্দটি উচ্চারণ করতে শুরু করেছেন তাঁরা। সম্ভবত একটু দেরি হয়ে গেছে।
মুখ্যমন্ত্রী যদি একবার হুঙ্কার দিতেন, "আমার হাসপাতালে গুণ্ডামি বরদাস্ত করব না, আমার ডাক্তারের গায়ে হাত দিলে সবাইকে দেখে নেব…", তাহলে আজকের মিছিল হতই না। চিকিৎসক নেতারা দুদিনের চেষ্টায় এত মানুষকে একত্র করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। টিভিতে যাঁরা মুখ্য়মন্ত্রীর ভাষণ শুনেছেন, তাঁদের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এসেছেন মিছিলে।
এখনো হয়ত সব শেষ হয়নি। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যদি চান, এখনো এক ঘণ্টায় সমস্যা মিটতে পারে। যেকোনো মুহূর্তে কাজে যোগ দেবার জন্য চিকিৎসকেরা তৈরি, শুধু যদি মুখ্যমন্ত্রী চান। তিনি রাজ্যের পরিচালক। তাঁকে আমরা সম্মান করি আজও। এখনো তিনি সহমর্মিতা আর সদিচ্ছা দেখালে চিকিৎসককুল যথাসাধ্য তাঁর সাথে সহযোগিতা করবেন। আর কোনো রোগীকে আউটডোরের বাইরে থেকে ফিরে যেতে হবে না। আবার ভোর হবে যদি তিনি চান। তিনি কি চাইবেন?
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মতামত ব্য়ক্তিগত)