Advertisment

চিকিৎসার চেয়েও বড় সমস্যা যখন রাজনীতি

এই আন্দোলনে রাজনীতির রুটি সেঁকতে মরিয়া বিজেপি। এতে অবাক হওয়ার কী আছে? বিরোধী দল তো সেটা করবেই। একদা মমতার তৃণমূল কংগ্রেসও এই কাজ করেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata nrs junior doctors strike

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ বারবার বলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। স্বাস্থ্যকে যদি গুরুত্ব দেওয়া না হয়, তবে একটা দেশ বা একটা জাতির উন্নতি হতে পারে না। একটা দেশের মেরুদণ্ডই হলো এই দুটোর বিকাশ।

Advertisment

জ্যোতি বসু যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তখন প্রশান্ত শূর ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। মনে পড়ে, সে সময়ে হাসপাতালগুলির দুরবস্থা নিয়ে গোটা রাজ্য জুড়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্য এমন একটা পরিষেবা ক্ষেত্র যে মানতেই হবে, যতই সরকার অগ্রাধিকার দিক  রোগীদের ক্ষোভ নিরসন খুব সহজ কাজ নয়। এ হলো ডিমান্ড আর সাপ্লাই এর সমস্যা। কিন্তু তাই বলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যেমন চলছে তেমনই চলবে, শাসকদলের ক্ষমতাসীন প্রভুদের কোনো ভূমিকাই নেই, সে কথা তো বলা যায় না। প্রশান্ত শূরের বিরুদ্ধেও ডাক্তারদের আন্দোলন দেখেছি। কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলোর হাল দেখতে তখন কলকাতার নবীন সাংবাদিক হিসেবে একটার পর একটা হাসপাতাল ঘুরি। তখন দেখেছিলাম, হাসপাতালে রোগীর বিছানার কাপড় পূতিগন্ধময়। রক্তের দাগ লেগে আছে বালিশে। ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত পাওয়া যায় না। গভীর রাতে আর জি কর হাসপাতালে গিয়ে দেখেছিলাম, নানা ধরণের ব্যবসা চলছে সেখানে।

১৯৮৪ সালে জুনিয়র ডাক্তাররা যখন আন্দোলন শুরু করেন, তখন জ্যোতি বসুও বলেছিলেন, সরকার ডাক্তারদের বেয়াদপি সহ্য করবে না। আলোচনায় বসবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জ্যোতিবাবুকেও চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আলোচনায় বসতে হয়েছিল।

আজ এত বছর পর দিল্লি থেকে বলছি। সেই কলকাতা, সেই স্বাস্থ্য পরিষেবা, সেই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, সেই প্রশাসনিক অসহিষ্ণুতা, চিকিৎসকদের ধরে পেটানো। সেদিন ছিলাম কলকাতায় আর আজ রাজধানী দিল্লিতে। মাঝে তিনটি দশক অতিবাহিত, কিন্তু পরিস্থিতিটা এখনো বদলালো না।

এবার পশ্চিমবঙ্গে যা হচ্ছে, তা ছড়িয়ে পড়েছে অন্য রাজ্যেও। দিল্লিতেও এইমসের চিকিৎসকরা মাথায় হেলমেট পরে রোগী দেখছেন। এ হলো জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতীকী আন্দোলন। দেখা গেল হায়দ্রাবাদ, মহারাষ্ট্র এবং অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ছে এই আন্দোলন। তার মানে চিকিৎসা পরিষেবার এই সমস্যা শুধু কলকাতা নয়, গোটা দেশেই আছে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে তো শুধু পরিষেবার সমস্যা নয়। হাসপাতালগুলিতে দুর্নীতিও কম নয়। এই দুর্নীতি যে শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতালে হয় তা নয়, বেসরকারি হাসপাতালেও হয়। হাসপাতালের দালাল চক্র আছে। ধরুন রোগীর বিল যদি ছ'লাখ হয়, তবে দালাল এসে বলবে প্রাইভেট-সরকারি সব ধরণের হাসপাতালে চিকিৎসকদের সামনে ভাংচুর করে অর্ধেক করে দেব। তবে সেক্ষেত্রে রোগীকে এক লাখ টাকা দালালকে দিতে হবে। বহুক্ষেত্রে অভিযোগ, চিকিৎসকরাও এই দালাল চক্রে জড়িত থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সমস্যা সমাধানে কমিটি গঠন করেন। এখনও জানা যায় নি, সেই কমিটি তাদের তদন্ত রিপোর্টে কী কী সুপারিশ করেছে, বা কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে এবার কলকাতায় জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যা যা ঘটল, তা থেকে অনেকগুলি বিষয় নজরে এসেছে। সেগুলিরও পর্যালোচনা হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। চিকিৎসকদের আন্দোলনের বিষয়টি যেভাবে তৃণমূল বনাম বিজেপি রাজনীতির একটা ল্যাবরেটরি হয়ে উঠেছে, সেটা খুব কাঙ্খিত নয়। প্রথমত, আন্দোলনে প্রথমেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসার খুব প্রয়োজন ছিল না। সেটা কৌশলগতভাবে খুব পরিণত মুভ নয়। আবার মুখ্যমন্ত্রী যখন এলেন, তখন সবাই স্লোগান দিলেন, "উই ওয়ান্ট জাস্টিস"। ওই স্লোগান শুনে মমতার হয়তো এতটা ক্ষুব্ধ এবং উত্তেজিত হয়ে যাওয়া উচিত হয় নি। তিনি রেগে গিয়ে এসমা প্রয়োগের হুমকি দেন। ধর্মঘট প্রত্যাহার না করলে জুনিয়র ডাক্তারদের হস্টেল ছাড়ারও নির্দেশ দেন। জবাবে ক্ষুব্ধ চিকিৎসকেরাও একের পর এক পদত্যাগ করতে শুরু করেন। পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়।

এই আন্দোলনে রাজনীতির রুটি সেঁকতে মরিয়া বিজেপি। এতে অবাক হওয়ার কী আছে? বিরোধী দল তো সেটা করবেই। একদা মমতার তৃণমূল কংগ্রেসও এই কাজ করেছে। তবে বিজেপি এবার সুকৌশলে ডাক্তারদের আন্দোলনের মধ্যে সরাসরি না ঢোকার পন্থা নিয়েছে। আন্দোলনের ভেতরে ঢুকলে আন্দোলনকারীরা বিজেপির বিরুদ্ধেও চলে যেতে পারতেন, কারণ চিকিৎসকদের এই ইউনিয়ন কিন্তু বিজেপির নয়। কোনো রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা কিন্তু ধর্নাক্ষেত্রে দেখা যায় নি। জুনিয়র ডাক্তাররা লুম্পেন বা মাফিয়া বা সমাজবিরোধী নন। এঁরা মেধাবী ছাত্রছাত্রী, সমাজের শহুরে বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিনিধি।

তবে মমতা প্রথমেই প্রতিবর্তক্রিয়ায় বলে বসেন, এই আন্দোলন করছে বহিরাগতরা। এই আন্দোলন করছে বিজেপি আর সিপিএম, যে কারণে সমস্যা মনে হয় জটিলতর হয়েছে। এর মধ্যে এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মৃত রোগীর মধ্যে হিন্দুও আছেন, মুসলমানও আছেন। অসুস্থ রোগীর ধর্ম বড় কথা নয়। অথচ মুসলমান রোগীর মৃত্যুর প্রতিবাদে এক ট্রাক ভর্তি লোক যখন হাসপাতালে ডাক্তারদের আক্রমণ করে, তখন বিজেপি নেতা টুইট করে বলেন, আক্রমণকারীরা মুসলমান ধর্মাবলম্বী বলে মমতার সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

এই অভিযোগ খন্ডন করে তৃণমূল নেতারা জানান, বিজেপি এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিচ্ছে। একথা অবশ্য কেউ বলেন নি যে আক্রমণকারীরা তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী, অথবা মমতা এই আক্রমণ করিয়েছেন। কিন্তু প্রচার শুরু হয়ে যায় যে মমতার "সংখ্যালঘু তোষণের" জন্য সমাজবিরোধীর একটি ক্ষুদ্র অংশ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই প্রচারের হাত ধরেই বাংলার রাজনীতিতে "জয় শ্রী রামের" প্রবেশ হচ্ছে। বিগত লোকসভা নির্বাচনে যা হয়েছে, এই রাজনীতি তারই প্রতিফলন। বিজেপিও ভাবতে শুরু করেছে, দু'বছর পর বিধানসভা ভোটেও এই একই কৌশলে কেল্লা ফতে হতে পারে।

মমতা এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মোকাবিলায় উদ্বিগ্ন। আর তাই আরও আক্রমণাত্মক। এবার তাঁর আক্রমণের বড় হাতিয়ার হলো, ধর্মীয় মেরুকরণের প্রতিবাদে বাঙালির জাতীয়তাবাদী লাইন। তিনি ঘোষণা করেছেন, বাংলায় থাকতে গেলে বাংলা বলতে হবে। বাংলায় ও বাঙালি স্বাজাত্যবাদের এই রাজনীতি দেখে দিল্লিতে অনেকে বলছেন, এ তো শিবসেনার মতো রাজনীতি। ষাটের দশকে হিন্দি বিরোধী তামিল আন্দোলন হয়েছিল, তখনও কিন্তু বাঙালিরা সেভাবে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন করেন নি। তাই আজ ২০১৯ সালে এসে রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করে মমতা কি সফলতা পাবেন? এটা বড় প্রশ্ন। কেননা বলিউডের কারণেই হোক অথবা বিশ্বায়নের প্রভাবেই হোক, এখন আর উগ্র বাঙালি অস্মিতার রাজনীতি সফল হবে না। এখন তো বাঙালি ধনতেরাস বা দিওয়ালির মতো হিন্দি বলয়ের সামাজিক উৎসব পালন করেন। মমতা এই রাজনীতি বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার বিষয় নিয়েও করেছেন।

তাহলে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের কী হলো? চিকিৎসা পরিষেবার বিষয়টা কি তাহলে গৌণ হয়ে গেল? সেটা কোনও ইস্যুই নয়? আর এই স্বাস্থ্য সংকটে কেন্দ্রের ভূমিকাই বা কী? রাজনীতির ধুলোঝড়ে যে রাজনীতি হারিয়ে গেছে সেটি হলো, জুনিয়র চিকিৎসকরা দাবি জানাচ্ছেন কেন্দ্রের কাছেও। স্বাস্থ্য ভারতীয় সংবিধানে যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত। তাই অল ইন্ডিয়া মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের আন্দোলেনের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের বিষয়টি যুক্ত।

চিকিৎসা পরিষেবার উন্নতি সাধনে কেন্দ্রেরও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সরকারি হাসপাতালে যতজন চিকিৎসক প্রয়োজন, ততজন চিকিৎসক নেই। ঘাটতি ভয়াবহ। এ হলো গোটা দেশের সমস্যা। তৃণমূল নেতৃত্ব আরও একটা অভিযোগ তুলছেন - নিট পরীক্ষায় পাস করে বহু হিন্দিভাষী ডাক্তার, যাঁরা বাংলা একদম জানেন না, তাঁরা রাজ্যের গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথাই বলতে পারছেন না। সমস্যার সমাধান হবে কী করে? আসল সমস্যা হলো, পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসার মত একটা জ্বলন্ত বিষয়ের চেয়েও বড় হয়ে উঠল রাজনীতি। বিজেপি বনাম মমতার রাজনীতি। দুঃখের অনুভূতি ছাড়া উপসংহারে আর কিছুই থাকে না।

kolkata news NRS
Advertisment