গত কয়েকদিনে পশ্চিমবঙ্গের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এক ব্যাপক আকার নিয়ে নিয়েছে। কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারদের শুরু করা আন্দোলন রাতারাতি অন্য মেডিকেল কলেজগুলোতে ঝড় তুলেছে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তাররাও এই আন্দোলনের সমর্থনে কর্মবিরতি পালন করেছে। আইএমএ-র সর্বভারতীয় সংগঠন ডাক্তারদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে অন্যান্য কলেজগুলোর ক্ষেত্রেও জুনিয়র ডাক্তারদের হরেদরে একই অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হয়। তাছাড়া সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে এদের ওপর আক্রমণের ঘটনা কিন্তু ঘটেই চলেছিল, প্রতিবাদও হচ্ছিল সাধ্যমত কিন্তু তাদের মূল দাবি কোনও প্রশাসন আজও মেটাতে পারেনি।
আরও পড়ুন, মিছিল থেকে, চিকিৎসকের চোখে
তারা চাইছেন সেই পরিবেশে রোগীর চিকিৎসা করতে যেখানে কোনও অহেতুক ভয়, হুমকি, অপমানকর উক্তি, এবং শারীরিক হিংসার উদ্বেগ নিয়ে তাদের কাজ করতে হবেনা। এটা তো একজন ডাক্তারের কর্মক্ষেত্রে থাকতেই হবে। অথচ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যায় সেই পরিবেশের কোনও গুণগত উন্নতি প্রশাসন করে না। তুলনামূলক ভাবে ভালো পরিকাঠামো সহ হাসপাতাল দিল্লির এইমসের রেসিডেন্ট ডাক্তাররাও প্রতিবাদে সামিল হয়েছে। এতে করে অন্তত এই ব্যাপারটা পরিষ্কার যে গোটা দেশজুড়েই জুনিয়র ডাক্তারদের কাজের পরিস্থিতি খারাপ। ডাক্তার-রোগীর অনুপাত খারাপ হওয়ার ফলে কাজের চাপ অনেক। আছে অধস্তন ডাক্তার হবার চাপ। সর্বোপরি রোগী ও তাদের উৎকণ্ঠিত পরিজনদের চাপ। এর সঙ্গে যোগ করুন স্নাতকোত্তর পরীক্ষা অথবা চাকরির প্রস্তুতি। এতগুলো চাপ সামলে কাজ করা বেশ কঠিন। গবেষণায় দেখা গেছে যে এদের একটা বড় অংশই “বার্নআউট সিনড্রোমের” শিকার, যেখানে কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়, পারিপার্শ্বিক অবস্থার থেকে একটা বিযুক্তি বা ডিসোসিয়েশন ঘটে, মেজাজ বিরক্তিতে ভরে যায়, ঘুমের ছন্দ পালটে যায় এবং একটা অবসন্ন ভাব মনকে ঘিরে থাকে। যে কাজগুলো করলে বার্নআউট কমে যায় যেমন, পরিবার বা প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানো, কাজের থেকে ব্রেক নেওয়া, রিল্যাক্স করা, নিজের শখ বা হবি নিয়ে সময় কাটানো – এগুলো কতটা করার সময় তারা পান সন্দেহ আছে।
আরও পড়ুন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে
ডাক্তারদের প্রতি হিংসার ব্যাপারটা কিন্তু দুনিয়া জুড়েই দেখা যাচ্ছে। ৭৫% এর বেশি ডাক্তাররা তাদের কর্মজীবনে কখনো না কখনো হিংসার সন্মুখীন হয়েছেন। সাম্প্রতিক দুনিয়ার নানা গবেষণা ও সমীক্ষাতে এই তথ্য প্রতিফলিত হয়েছে যা সংখ্যাগত ভাবে চীনে সবথেকে বেশি। এই হিংসা প্রতিরোধের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০-২০ অবধি এক কর্মসূচীও নিয়েছে। যদিও প্রায় সব রকম কর্মক্ষেত্রেই হিংসা দেখা গিয়েছে তবুও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ঘটা হিংসার পরিমাণ শতকরা প্রায় পঁচিশ ভাগ! ২০০০ সালে ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, লেবানন, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর থাইল্যান্ডে করা সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে যে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি ডাক্তাররা বিগত বছরে অন্তত একবার শারীরিক বা মানসিক হিংসার শিকার হয়েছেন। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেনে জিপিদের মধ্যে অধ্যয়ন চালিয়ে দেখা গেছে যে বিগত বছরে এদের শতকরা ৬৫ জন হিংসার শিকার হয়েছিলেন। জার্মানির জিপিদের মধ্যে ২০১৫ সালে করা সমীক্ষা জানাচ্ছে ৫০% ডাক্তারদের প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ হয়েছিল এবং ১০% এই হিংসায় গুরুতর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমেরিকায় ১৯৮০-১৯৯০ এর মধ্যে শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয় হিংসাত্মক আক্রমণের জন্য। বিখ্যাত ডাক্তারি জার্নাল “দ্য ল্যান্সেট” ২০১২ সালে তাদের সম্পাদকীয়তে চিনে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে রোগী ও তাদের আত্মীয়দের আক্রমণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। চিনা সরকার হাসপাতালে কড়া পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও এটা কমেনি! “দ্য ল্যান্সেট” এর ২০১৪ সালে প্রকাশিত সম্পাদকীয় আবার এই বিষয়ে মন্তব্য করে যে ডাক্তারদের কাজের চাপ অনেক বেড়েছে (ডাক্তার প্রতি ১০০ আউটডোর রোগী) কিন্তু পরিষেবাগত উন্নতি সমানহারে না হওয়ায় রোগীরা ক্রমাগত অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ও হিংসার প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু এই লেখায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হল- ‘শুধুই রোগীর অসন্তোষ ডাক্তারদের প্রতি বর্ধিত আক্রমণের মূল কারণ নয়। বরং এটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার রোগ লক্ষণ, যা প্রতিনিয়ত ডাক্তার ও রোগী দুই পক্ষকেই শিকার বানায়।‘
আরও পড়ুন, চিকিৎসায় কর্মবিরতি, মানুষের হয়রানি- কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ
ভারতে সব থেকে বেশি (৫০%) হিংসার ঘটনা ঘটে আইসিএউ-তে আর ৭০% ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটান রোগীর আত্মীয়রা। মহারাষ্ট্র আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে সব ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে সেখানে রোগীর আত্মীয়, স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক নেতা এমনকি পুলিশকেও হিংসা ঘটানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে! দিল্লীর একটি হাসপাতালে ২০১৬ সালের সমীক্ষা বলছে যে বিগত এক বছরে ৪০% জুনিয়র ডাক্তাররা হিংসার শিকার হয়েছেন।
কিন্তু কেন এরকম বারবার ঘটছে? কিছু নতুন আইন হওয়া সত্ত্বেও ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হিংসা কিন্তু কমছে না। এখানেও প্রথম প্রশ্নটাই উঠবে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে। সেই ঔপনিবেশিক আমলে শুরু হওয়া ব্যবস্থার কি ঠিকঠাক সংস্কার এখনও আমরা করতে পেরেছি? অধিকাংশ পরিবর্তনই এসেছে কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থার সুপারিশে আমাদের নিজেদের পরিস্থিতি খতিয়ে অধ্যয়ন করে, তার অনুকুলে সৃষ্টি কোনো পরিকল্পনায় নয়। স্বাস্থ্যনীতির ঘোষণাপত্রে যাইই থাকুক শেষ বিচারে কিন্তু তা গরিবদের সহায়ক হয়নি। এখনও স্বাস্থ্যের জন্য একজন গরীব মানুষকে সারা বছরে তার পকেট থেকে যা খরচ করতে হয়, সেটা তার বিমার খরচ থেকে অনেক বেশি। তার একটা বড় কারণ আউটডোর চিকিৎসার জন্য বীমা নেই। অথচ ইনডোরের তুলনায় আউটডোরে অনেক বেশি মানুষ চিকিৎসার জন্য আসেন। ডাক্তারি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্য থেকে কিন্তু উপনিবেশিক মানসিকতা যায়নি। সেই উচ্চ-নীচের নানান থাকে-বন্দি এক জটিল স্তরে তা বিভক্ত। ক্ষমতা এখানে দলগত সাম্যের ভিত্তিতে বণ্টিত নয়- পদ, শ্রেণি ও জাতপাতের ভিত্তিতে সংগঠিত। ঊর্ধ্বতন কর্মীর বশ্যতা স্বীকারের মধ্যে দিয়ে তা ধাপে ধাপে প্রবাহিত। হিংসার অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে ডাক্তার পিছু রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়াতে অপেক্ষা করার সময় বেড়ে যাওয়া এবং মূল পরামর্শের সময় কমে যাওয়া। রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতার অভাব। ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে যথাযথ ও স্বচ্ছ কথোপকথনের অভাব। মিডিয়ার ভূমিকাও ইতিবাচক নয়। স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিবেদনগুলির সিংহভাগই ডাক্তারদের ভিলেনের ভূমিকা দিয়ে থাকে। গড়ে দশটা রিপোর্টের মধ্যে হয়ত একটি কি দুটি পাওয়া যাবে যেখানে ডাক্তারের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। এমন কোনো রিপোর্ট পাবেন না যেখানে জুনিয়র ডাক্তাদের হাড়ভাঙা খাটুনির কথা বলা হচ্ছে বা কোনও সমষ্টিগত স্বাস্থ্যপ্রচেষ্টার প্রশংসা করা হচ্ছে। সেগুলি পাবে বিভাগীয় প্রধান, অধিকর্তা বা মন্ত্রীরা।
আরও পড়ুন, কেন হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ রাখতেই হল?
ঔপনিবেশিক শিক্ষার কুপ্রভাব এখনও যায়নি। যেভাবে যা পড়ানো হয় সবই স্মৃতি পরীক্ষার জন্য, জ্ঞান ও কুশলতা যাচাইয়ের জন্য ততটা নয়। তার জন্য দরকার ছিল শিক্ষার পরিসরটিকে আরো গণতান্ত্রিক করে তোলার যেখানে আলোচনা, প্রশ্ন আর বিতর্কের মধ্য দিয়ে শিক্ষাকে সমাজ আর রাজনীতির সাথে মিলিয়ে পড়ার। এথিক্স, আর মেডিকাল হিউম্যানিটিজের ওপর জোর দেওয়ার। কারণ মেডিকাল শিক্ষায় ব্যাপকভাবে ব্যক্তিপুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটায় শিক্ষা আজ কিনে ফেলা যায় কিন্তু এটা কে বোঝাবে যে এই শিক্ষার প্রাণভোমরা এথিক্স আর মেডিকাল হিউম্যানেটিজ। যা পয়সা খরচ করলেই পাওয়া যায়না। স্বাস্থ্য পরিষেবা একটি ক্রয়জাত বিষয়ে পরিণত হবার জন্য ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক পরিণত হয়েছে প্রোভাইডার-কনজিউমারে যা বাজার ও কনজিউমারিজমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, কোনো মানবিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য নয়। তাই নবীন ডাক্তারদের একতরফা দোষ দিয়ে লাভ নেই, তারা যা শিখছে তার ফলে রোগী ও তার পরিবারের সাথে তাদের যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে এ আর আশ্চর্য কী! রোগীরা একটা সংখ্যা হয়েই থেকে যাবে। জুনিয়র ডাক্তারদের এব্যাপারে গভীর আত্মানুসন্ধান ও আত্মসমালোচনার দরকার রয়েছে। রোগীরা, বিশেষত গরীব রোগীরা বাধ্য হয়ে তাঁদের কাছে আসেন, তাঁদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা, তাঁদের লক্ষণগুলি পড়ে ফেলার জন্য তাদের সহমর্মিতার সাথে বোঝা আজ খুব খুব দরকার। নিজেকে অবহেলিত আর ছোট মনে করলে রোগীর মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।
জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মক্ষেত্রে হিংসার শিকার না হতে চাওয়ার দাবি ন্যায্য, সে দাবিকে অগ্রাহ্য করে প্রশাসন পার পেতে পারেনা, তেমনিই ডাক্তারদের এটাও ভাবতে হবে যে সশস্ত্র পুলিশ পিকেট আর সিসিটিভির জাল বিছিয়ে হেনস্থা আর শারীরিক হিংসার হাত থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া যাবেনা। রোগী ও তার পরিবারের সাথে মানবিক সম্পর্কের বন্ধন কীভাবে গড়ে তোলা যায় কীভাবে সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ আরো দৃঢ় করা যায়। এটাই দিতে পারে স্থায়ী সুরক্ষা।
(অমিতরঞ্জন বসু ছত্তিসগড়ের শহীদ হাসপাতালের চিকিৎসক)