Advertisment

কোথা থেকে এলো নুসরত জাহানের বিরুদ্ধে 'ফতোয়ার' গল্প?

নিখিল জৈন ও নুসরত জাহান দুজন মানুষ, আইনসম্মতভাবে বিবাহ করেছেন। এতে মহত্ত্ব যেমন নেই, তেমনি নেই সামান্যতম নীচতাও, এটি স্বাভাবিক ঘটনা। এবং দারুল উলুম ইফতা এই বিবাহ নিয়ে কোনও ফতোয়া/অভিমত দেয় নি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
nusrat jahan nikhil jain

নুসরত-নিখিলের বিয়ের ছবি। ছবি সৌজন্যে সোশাল মিডিয়া

তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি নুসরত জাহান সম্প্রতি নিখিল জৈনকে বিয়ে করেছেন। এই বিবাহ ভারতীয় আইনের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম অনুযায়ী, এই পরিণয়ের বিরুদ্ধে নাকি দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফতোয়া জারি করা হয়েছে। সেই মর্মে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে অজস্র।

Advertisment

প্রথমেই বলে রাখা ভাল, এমন কোনও ফতোয়া দারুল উলুম প্রকাশ করেনি। খবরটি সর্বৈব মিথ্যা, যাকে বলা হয় 'ফেক নিউজ'। কীভাবে এই ফেক নিউজ ছড়িয়ে পড়ল, তার আগে কয়েকটি জিজ্ঞাসার নিরসন আবশ্যক।

ফতোয়া কাকে বলে? দারুল উলুমই বা কী? দেশের আইন যে বিষয়কে মান্যতা দেয়, তাকে কি দারুল উলুম ‘অবৈধ’ ঘোষণা করতে পারে?

‘ফতোয়া’ শব্দটি আরবি, যার অর্থ হল 'অভিমত'। কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে সমস্যা তৈরি হলে, তার ধর্মীয় সমাধানকল্পে কেউ যদি মুফতি (আইন-বিশেষজ্ঞ)-র শরণাপন্ন হন এবং তাঁকে ওই সমস্যার সমাধান শরিয়তের আলোকে দিতে অনুরোধ করেন, তাহলে মুফতি শাস্ত্র ঘেঁটে ওই ব্যক্তিকে ধর্মীয় সমাধানের রাস্তা বলে দেন। এটি কখনওই হুকুম জারি নয়। প্রতিটি ফতোয়ার শেষে মুফতি লিখে দেন, 'Allah knows best!'

আরও পড়ুন: নুসরতের সিঁথির সিঁদুর নিয়ে তৃণমূলেই ‘ক্ষোভ’, পাশে লকেট!

দারুল উলুম দেওবন্দ হল একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে দেওবন্দি বা পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেখানকার উলেমা বা পণ্ডিতরা ভারতকে ভাগ করে দুই রাষ্ট্রব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করেন। মৌলানা হোসেন আহমেদ মাদানি সব রকমের হিংসার বিরুদ্ধে উলেমাদের লড়তে বলেন। তাঁরা পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনেরও তীব্র বিরোধিতা করে এক অখণ্ড ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করেন।

দেওবন্দের দারুল উলুম ইফতা ধর্মীয় সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন এলে তার সমাধান দিয়ে থাকেন। তাঁরা স্বতোপ্রণোদিতভাবে কোনও বিষয়ে অভিমত বা ফতোয়া দেন না। দারুল উলুম ইফতা অনলাইনে এই সমাধানসমূহ লিখিতভাবে দিয়ে থাকে। সেখানে নুসরত জাহানের বিবাহ কিংবা সিঁদুর-মঙ্গলসূত্র নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন করেন নি এবং স্বাভাবিকভাবেই দারুল ইফতা তার কোনও উত্তরও দেয় নি; দারুল উলুম ইফতার ওয়েবসাইটে গিয়ে যে কেউ বিষয়টি যাচাই করে নিতে পারেন।

ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দেওয়ানি-বিধি ভিন্ন ভিন্ন। এই সুবিধা/অসুবিধা কেবল ইসলাম ধর্মালম্বীরা পেয়ে থাকেন, সে কথা ভুল। হিন্দু-খ্রিস্টান প্রত্যেকের পৃথক দেওয়ানি বিধি রয়েছে। জৈন বিধির প্রাচীন গ্রন্থ হল ‘ভদ্রবাহু সংহিতা’। পরবর্তীকালে সে সব বিধির পরিবর্তন-পরিমার্জন হয়। জৈন আগমে পাঁচ রকমের বিবাহের কথা পাওয়া যায়। নারীর সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নে জৈন-বিধি হিন্দু-বিধি থেকে পৃথক। ১৯৫৫ সালে জৈন আইনকে হিন্দু আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও জৈনদের কেউ কেউ নিজেদের বিধি পালন করে থাকেন।

নিখিল জৈন ও নুসরত জাহানের বিবাহ জৈনমতে কিংবা ইসলামমতে সম্পন্ন হয়নি। হয়েছে রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে। যেহেতু কোনও ধর্মের দেওয়ানি বিধিতে আন্তর্ধর্মীয় বিবাহের বিধান নেই এবং ওই রকম বিবাহকে অশাস্ত্রীয় বলা হয়; তাই ১৯৫৪ সালে এমন বিবাহের জন্য ভারতীয় সংসদে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট পাশ হয়, অ্যাক্ট ৪৩ অফ ১৯৫৪। ফলে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী, নিখিল-নুসরতের বিবাহ বৈধ ও আইনসম্মত। তাঁরা বিশেষ কোনও ধর্মের দেওয়ানি বিধির সাহায্যের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারস্থ হয়ে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন।

আরও পড়ুন: মৌলবাদীদের তোয়াক্কা না করে ইস্কনে নুসরত

জৈন/হিন্দু সিভিল ল অনুযায়ী কিংবা ইসলামি দেওয়ানি বিধি অনুযায়ী এই ধরণের বিবাহ সঙ্গত কিনা, এখন যদি কেউ সেই প্রশ্ন তোলেন, পণ্ডিতরা শাস্ত্র ঘেঁটে তার উত্তর দেবেন; সেই উত্তর কখনওই রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতা নয়। তা হল অভিমত বা ফতোয়া। সেই অভিমত বা ফতোয়া কোনও ব্যক্তির নয়, বরং শাস্ত্রের, ধর্মীয় সাহিত্য সমূহের। তার নিন্দা বা প্রশংসা করা যায়।

কিন্তু এমন অভিমত কেন ঝড় তোলে দেশে? নুসরত জাহান কিংবা নিখিল জৈন সামাজিকভাবে উচ্চ কোটির মানুষ, কিন্তু বহু নিম্ন কোটির মানুষের জীবনে এমন অভিমত ঝড় তোলে বৈকি। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে এমন কোনও ফতোয়া দেওয়া হয় নি। জনৈক মৌলভি নুসরত-নিখিলের বিয়ে নিয়ে কিংবা নুসরতের সিঁদুর পরা নিয়ে নিজস্ব মন্তব্য করেছেন।

এমন নানা মত অনেকেই দিয়ে থাকেন। কয়েকদিন আগে দেখলাম, দুই ধর্মের দুই ‘প্রাজ্ঞ’ ব্যক্তি বললেন, ভিন্নধর্মী নারীদের ধর্ষণ করা বৈধ। এমন ব্যক্তি-ফতোয়ার পিছনে আছে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব এবং মহিলাদের অবমানব ভাবা। নিখিল-নুসরতের বিবাহ নিয়ে তাই কোনও মৌলভি-বিশেষের আপত্তির পিছনে যতটা না ধর্ম, তার চেয়ে বেশি কাজ করে পিতৃতান্ত্রিকতা। ওই মৌলভি আবার মুসলমান পুরুষ ও অমুসলমান নারীর বিবাহে আনন্দে উদ্বাহু হয়ে ওঠেন; ঠিক যেমন নিখিল-নুসরতের বিবাহ নিয়ে যাঁরা বিশেষ ধর্মের মুণ্ডপাত করছেন ও প্রসন্নতার ভাব দেখাচ্ছেন, তাঁরাই আবার অকথা কুকথার বন্যা বইয়ে দেবেন যদি আন্তর্ধর্মীয় বিবাহে পুরুষটি হন মুসলমান। নিখিল জৈন ও নুসরত জাহান দুজন মানুষ, আইনসম্মতভাবে বিবাহ করেছেন। এতে মহত্ত্ব যেমন নেই, তেমনি নেই সামান্যতম নীচতাও, এটি স্বাভাবিক ঘটনা।

এবং দারুল উলুম ইফতা এই বিবাহ নিয়ে কোনও ফতোয়া/অভিমত দেয় নি।

আগেই বলেছি, ফতোয়া নিয়ে শাস্ত্রীয় অভিমত এমন হলেও তার একটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব থেকে যায়। সেই প্রভাবের কুনজরে পড়েন সাধারণ মানুষ, আর ওই ব্যক্তিবিশেষের ফতোয়া নিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ান।

আরও পড়ুন: ‘স্বামীর কথায় নুসরত কি বিজেপিতে যাচ্ছেন?’

এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ২০১৮ সালে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট ফতোয়া জারির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একটি ধর্ষণের ঘটনায় পঞ্চায়েতের ‘হুমকি’ জারির প্রেক্ষিতে কোর্ট জানায় যে ফতোয়া হল অসাংবিধানিক ও বেআইনি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের এই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্ট বলে, ফতোয়া বা অভিমত কোনও ডিক্রি নয়, তা কাউকে বেঁধে ফেলে না বা তা কারোর উপর জোর করিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় না। এটি উপদেশ বা অভিমত মাত্র।

প্রতিবেশী বাংলাদেশের আদালত অবশ্য ফতোয়া নিয়ে অন্য মত পোষণ করে। ২০০১ সালে উচ্চ আদালতের দুই বিচারপতি, মহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ জানায়, ফতোয়া হল অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। একমাত্র আদালতই আইনসংক্রান্ত প্রশ্নে মতামত দিতে পারে। কেউ যদি ফতোয়া দেn তবে ফৌজদারি বিধি অনুসারে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হবে। তার পর তা নিয়ে চলে অনেক টনাপোড়েন। ২০১০ সালে বিচারপতি গোবিন্দচন্দ্র ঠাকুর ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বেঞ্চ জানায়, ফতোয়ার নামে বিচার করা বা শাস্তি দেওয়া হলো অবৈধ।

আমাদের দেশে খাপ পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্মের নেতানেত্রীরা যে ধরণের ফতোয়া জারি করেন তা বেশিরভাগ সময়ে মানবাধিকারের পরিপন্থী হয়ে পড়ে। আর এ সবের শিকার হন দলিত (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) ও মহিলারা।

পুনশ্চঃ নুসরত জাহান সম্পর্কে দারুল উলুম ইফতা কোনও ফতোয়া/অভিমত জারি করে নি। 'ফেক নিউজ' কেন ছড়ানো হয়, কেন বিদ্বেষ প্রচার করা হয়, কেনই বা মানুষ হিংসার দ্বারস্থ হয়, এই প্রশ্নগুলো জানা। উত্তরগুলোও সহজ। কিন্তু পরিণতি নিষ্ঠুর ও করুণ।

Nusrat Jahan
Advertisment