Advertisment

এক দেশ এক নেতা এক আদর্শ এক ধর্ম এক শ্লোগান: এই কি ভবিতব্য?

যে যে যুক্তিগুলো আসছে সেগুলো নিয়ে নাগরিক পরিসরে আলোচনা চালানো জরুরি। ২০১৮ সালে আইন মন্ত্রক থেকে বলা হয় যে এই সাংবিধানিক কাঠামোতে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ করানো সম্ভব নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
PM Narendra Modi

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বার অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এক দেশ এক ভোট ইস্য়ু নতুন করে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (ফাইল ছবি)

১৭ তম লোকসভা শেষ হয়েছে। নতুন সাংসদেরা শপথ নিয়ে ফেলেছেন। শপথ নেওয়ার সময়ে 'জয় শ্রী রাম' ধ্বনি শোনা গেছে। এগুলো এখন আর নতুন খবর নয়। নতুন করে যে খবরটা আসছে তা হল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী আবার “এক দেশ এক নির্বাচন” এই বিতর্কটাকে সামনে এনেছেন। তবে অনেকের কাছে নতুন শোনালেও এই বিষয়টি কিন্তু একেবারেই নতুন নয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬৭ কিন্তু ভারতে নির্বাচন হত একসঙ্গেই। ১৯৫৭ সালে দেখা যায় প্রাথমিকভাবে যেভাবে ভাবা হয়েছিল সেখানে বেশ কিছু সরকার বাতিলের পরে সেই একসঙ্গে ভোট বিষয়টা ৭৬ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।এনেছেন। ১৯৫৯ সালে কেরালাতে প্রথম নাম্বুদিরিপাদের সরকার ভেঙে দেওয়া হয় সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে তারপরে ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেরালাতে আবার বিধানসভা নির্বাচন হয় তারপর থেকে ক্রমশ বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন বিভিন্ন বছরে হয়ে আসছে। ১৯৬৭ সালে এটা ৬৭ শতাংশে থেকে এসে ঠেকে। ১৯৭০ সালে এই নির্বাচন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে বাজপেয়ীর সরকারের সময় লাল কৃষ্ণ আদবানি আবার এই প্রস্তাবকে সামনে আনেন। তাহলে এখন আবার নতুন করে এই আলোচনা সামনে আনা হচ্ছে কেন? গত ২০১৮ সাল থেকেই রাজনৈতিক মহলে এই আলোচনাটা ঘরাফেরা করছিল কিন্তু রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ সহ ৪টি বিধানসভায় বিজেপির ফলাফল দেখার পর নরেন্দ্র মোদী এই প্রস্তাবকে তখনকার মতো স্থগিত করেন কিন্তু এবারে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে আসার পর তিনি আবার এই “এক দেশ এক নির্বাচন” বিষয়টিকে আবার জোরের সঙ্গে সামনে এনেছেন।

Advertisment

আরও পড়ুন, সন্তোষ রাণা: সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক সমাজবিপ্লবী

যে যুক্তিগুলোকে সামনে আনা হচ্ছে একটু নজর করলেই বোঝা যাবে সেগুলো কতটা ফাঁপা। প্রথমে বলা হয়েছে যে প্রতিটি রাজ্যে যদি প্রায় প্রতি বছর নির্বাচন হয় তাহলে যে নির্বাচনী বিধি লাগু হয় তার ফলে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হয়। সুতরাং ৫ বছরে একবার যদি সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রস্তরে একবার নির্বাচন হয় তাহলে দেশের উন্নয়ন কে আটকায়? আরও যে কথাটা সামনে এসেছে তা হল এক দেশ এক নির্বাচনের ফলে খরচ কমবে। কিন্তু যদি গত লোকসভা নির্বাচনের দিকে খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে যারা এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে তাঁরাই সবচেয়ে উঁচু গলায় এই বিষয়ে আওয়াজ তুলছে। সরকারি খরচ কম হলেও ঘুরিয়ে যা  আকাশছোঁয়া খরচ কিছু কিছু দল করেছে তা দেখিয়ে দেয় এই খরচ কমানোর বিষয়টির কোনও অর্থই নেই। একদিকে খরচ কমানো আর অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর খরচ বেড়ে যাওয়া এই দুটোর মধ্যে কোনও সামঞ্জস্যই নেই, সুতরাং এই যে খরচ কমানোর যুক্তি সেটা একেবারেই খাটে না।

আরও পড়ুন, আমাদের রাজনীতি: সমালোচনার অধিকার

তাহলে কি অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে এই বিষয়টাকে সামনে নিয়ে আসার পিছনে? অবশ্যই আছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় বা তার পরবর্তীতে সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রক্রিয়াতে সঙ্ঘ পরিবার যা কিনা বিজেপির রাজনৈতিক চালিকাশক্তি তাঁরা কখনই এই স্বাধীনতা এবং সংবিধানকে মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা মনে করেন এই সংবিধানের মধ্যে কোনও হিন্দুত্ব নেই, এই সংবিধান বিভিন্ন পশ্চিমি দেশ থেকে ধার করা। গোলওয়ালকর যাকে এখনও সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম মাথা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয় তিনি ১৯৪০ সালে নাগপুরে এক ভাষণ দেওয়ার সময়ে বলেন ‘আরএসএস এক পতাকা, এক আদর্শ, এক নেতৃত্ব, এক ধর্ম দেশের কোনে কোনে ছড়িয়ে দিতে চায়’ শুধু তাই নয় তাঁরা ভারতের জাতীয় পতাকাকেও মান্যতা দিতে বাধ্য নন। তাঁরা মনে করেন যে ভারতের পতাকায় যে ৩টি রঙ আছে তা অশুভ এবং সত্যিকারের হিন্দুরা কখনোই এই পতাকাকে মন থেকে মেনে নেবেন না। একদিন পুরো ভারতবর্ষ তাঁদের গেরুয়া পতাকার কাছে মাথা নোয়াবে। ১৯৬১ সালে গোলওয়ালকর আরও বলেন যে ‘আজকের এই যে সরকারের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তার মধ্যেই নিহিত আছে বিচ্ছিন্নতাবাদের সুত্র, এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কখনোই এক দেশ এক জাতি এই ধারনাকে মান্যতা দেয় না, সুতরাং এই ধারণাকে সম্পূর্ণ ভাবে উপড়ে ফেলতে হবে, সংবিধানকে সংশোধন করতে হবে এবং এক দেশ এই ধারণা চালু করতে হবে’। বিভিন্ন বইতে গোলওয়ালকর এই সম্পর্কে লিখেও গেছেন। তার লেখাতেই পাওয়া যায় যে তাঁর ইচ্ছে ছিল বিভিন্ন স্বাধীন এবং স্বশাসিত রাজ্যের পরিবর্তে তাঁরা একটি একীকৃত দেশ চান।

আরও পড়ুন, মুজফফরপুরের মহামারীর রাজনীতি

তার মানে বোঝা যাচ্ছে যে ,ভারতের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আছে তাকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলাটাই উদ্দেশ্য। এক দেশ এক নির্বাচন হলে কেন্দ্র শক্তিশালী হবে আর অঙ্গরাজ্যগুলো ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে। জিএসটির মধ্যে দিয়ে এই কাজটি শুরু হয়েছে। প্রথম যখন জিএসটি চালু হয়েছিল তখনও বিরোধীরা একই অভিযোগ তুলেছিলেন। প্রথমে যেটা বুঝে নেওয়া জরুরি তা হল ভারতবর্ষ কি একটা পুরো দেশ নাকি সংবিধান অনুযায়ী এই দেশ কথাটার অন্য কোনও সংজ্ঞা আছে? যা ভারতের নাগরিকেরা জানলেও মেনে নিতে চান না বা বুঝতে চাইছেন না? আসলে আসাম থেকে গুজরাট কিংবা কেরালা থেকে কাশ্মীরে যে সব ধরনের বৈচিত্র্য় রয়েছে তাকে ধ্বংস করাটাই মূল উদ্দেশ্য। সারা দেশে যেভাবে এক ধর্ম এক আদর্শ চাপানোর চেষ্টা চলছে, সবাইকে জয় শ্রী রাম বলানো তারই অঙ্গীভূত। আসলে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন সরকার মনে করে যে ভারত একটি অখণ্ড দেশ যার খাওয়া, পরা, ধর্মাচরণ থেকে শুরু করে তাঁর নাগরিকত্ব কিংবা পরিচিতি সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা একীকরণের ছোঁয়া থাকবে। সেই জন্যই ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও কাউকে নিরামিষ খেতে হবে বা জয় শ্রী রাম শ্লোগান বা আধারের মতো একটা পরিচিতি বহন করতে হবে। আসলে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার আমাদেরকে কোনোভাবে বোঝাতে চাইছে যে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটার আর কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। কেন্দ্রে একটা শক্তিশালী সরকার থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যে কেন্দ্রীভূত বলের সঙ্গে একটা অন্য়ান্য় বলের যে সূক্ষ্ম সমীকরণ আছে সেটাই আমাদের সংবিধান এবং আমাদের দেশকে গত ৭৫ বছর ধরে চলমান রেখেছে। এই সম্পর্ক কোনও ভাবে ধ্বংস হলে কোথাও একটা স্থিতিশীলতা চলে যায়।

আরও পড়ুন, জরুরি অবস্থার স্মৃতি আজও প্রাসঙ্গিক

সুতরাং যে যে যুক্তিগুলো আসছে সেগুলো নিয়ে নাগরিক পরিসরে আলোচনা চালানো জরুরি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্তরে আলোচনা করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। ২০১৮ সালে আইন মন্ত্রক থেকে বলা হয় যে এই সাংবিধানিক কাঠামোতে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ করানো সম্ভব নয়। সে জন্য সংবিধান সংশোধন শুধু নয়, ১৯৫১ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অফ পিপলস অ্যাক্ট, লোকসভা এবং বিধানসভার কার্যপ্রণালী এবং আরও বেশ কিছু আইন বদল করতে হবে। কিন্তু প্রায়োগিক দিক বাদ দিলেও যে সমস্যার কথাটা মাথায় রাখা জরুরি, তা হল এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন রাজ্যের ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যাবে এবং বিজেপির মতো অর্থবলে বলীয়ান একটি দল ছাড়া কারও পক্ষেই এই নির্বাচন লড়া সম্ভব হবে না।

এ প্রসঙ্গে একটা জরুরি কথা না বললেই নয়। বিরোধীরা যেভাবে ছন্নছাড়া হয়ে আছেন তাতে কি তাঁরা আদৌ পারবেন এই লড়াইকে সামনে নিয়ে আসতে! নাকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ দেখতে গিয়ে আমাদের স্বপ্নের ভারতবর্ষকে গেরুয়া পতাকার নিচে আত্মসমর্পণ করাবেন তা সময়ই বলবে।

(সুমন সেনগুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার। মতামত ব্য়ক্তিগত)

PM Narendra Modi RSS
Advertisment