পূর্ব মেদিনীপুরের এক দোকানদার বড় অদ্ভুত এক দাবি করেছেন। সুতাহাটার সবজি বিক্রেতা অক্ষয় দাসের বক্তব্য, গত মঙ্গলবার সকালে দোকান খুলে তিনি দেখেন, মালপত্র সব ছত্রখান, ওলটপালট তরিতরকারি। যথাস্থানে নেই ক্যাশবাক্সও। কিন্তু একটি পয়সাও খোয়া যায়নি। কী খোয়া গেছে জানেন? দোকানে যে ক'টা পেঁয়াজের বস্তা ছিল, প্রায় সব! আনুমানিক ৫০ হাজার টাকার পেঁয়াজ উধাও হয়েছে অক্ষয়বাবুর দোকান থেকে, সঙ্গে কিছু আদা-রসুনও।
হাসির কথা বা ভুয়ো খবর ভাবছেন? বা হোয়াটসঅ্যাপ জোক? একেবারেই ভুয়ো নয়, রীতিমত সংবাদ সংস্থার যাচাই করা খবর। তবে হোয়াটসঅ্যাপ জোক বলতে মনে পড়ল, কিছুদিন ধরে একটি তিন লাইনের জোক ঘুরছে সর্বত্র, নিশ্চয়ই নজরে পড়েছে অনেকেরই। দুই বান্ধবীর কথোপকথন, তার সারমর্ম এই - "'ছেলেটা খুব বড়লোক মনে হয়'; 'কী করে বুঝলি?' 'মুখে পেঁয়াজের গন্ধ পেলাম'।" কলকাতায় ডেকার্স লেনে নাকি স্যালাডে পেঁয়াজ দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমাদের অফিসের সামনের দোকানে পেঁয়াজি ভাজা হচ্ছে না আপাতত।
সমস্যা অবশ্য শুধু বাংলার নয়। খবরে প্রকাশ, গুজরাটের সুরাটেও নাকি চুরি হয়েছে ২৫০ কিলো পেঁয়াজ, যার বর্তমান বাজারদর আন্দাজ ২৫ হাজার টাকা। সারা দেশে পেঁয়াজ নিয়ে আলোড়ন, সমবেতভাবে ময়দানে নেমে পড়েছেন অর্থনীতিবিদ এবং আবহাওয়াবিদরা, বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে মৌসুমি বায়ু দেরিতে বিদায় নেওয়ায় অকালবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ পেঁয়াজের ফসল, যার প্রভাব পড়েছে বাজারদরের ওপর।
বেশ, মেনে নেওয়া গেল যে ফসল কম হওয়ায় বাড়ছে দাম। কিন্তু তাই যদি হবে, তবে দেশের সর্বত্রই তো এক দাম হওয়া উচিত। গড়িয়াহাট বাজারে ৯৫ টাকা কিলো, আর আলমবাজারে ১০০, এমন কী করে হয়? এবং এই বা কী করে হয় যে এনফোর্সমেন্ট ব্র্যাঞ্চের বা সরকার দ্বারা গঠিত বিশেষ টাস্ক ফোর্সের হানার পরেই ঝপ করে দাম পড়ে যায়, ফের দু'দিন পর যে কে সেই? অতি সরলবুদ্ধির মানুষও এটা বুঝে গেছেন যে পেঁয়াজ 'হোর্ড' করা হচ্ছে, অর্থাৎ স্টকে জমা করা হচ্ছে, যাতে দাম আরও বাড়লে বাজারে একটু একটু করে ছাড়া যায়। কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা হচ্ছে। কতকটা শেয়ারের মতো আর কী।
প্রশ্ন হলো, সেই সেপ্টেম্বর মাস থেকেই কিন্তু বেড়ে চলেছে দাম। শুরু হয়েছিল ৭০ টাকা কিলো দিয়ে, আজ যা সেঞ্চুরি পার করে ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। পেঁয়াজ এমন একটি সবজি, যা প্রত্যেক বাড়িতেই, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে, অতি প্রয়োজনীয় বস্তুর তালিকায় পড়ে। তো এই দু'মাসে এমন কোনও দীর্ঘমেয়াদী সরকারি পদক্ষেপ কি নেওয়া গেল না, যাতে দাম কমানো না হোক, অন্তত দামে সমতা আনা যায়? এখন যা পরিস্থিতি, তাতে তো ব্যবসায়ীরা মোটামুটি নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী দাম ঠিক করে নিতে পারেন চাইলে। এই দামের ওঠাপড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সরকার, অন্তত রাজ্যস্তরে, এটাও কি মেনে নিতে হবে?
এমনও নয় যে শুধু পেঁয়াজেরই দাম বেড়েছে। এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে টম্যাটো কিনেছিলাম ৫০ টাকা কিলো, আজ কিনলাম ৬০ টাকায়। এই এক সপ্তাহে আমার রোজগার দশ টাকা কেন, দশ পয়সাও বাড়ে নি। আদা ১৬০ থেকে ২০০ টাকা প্রতি কিলোর মধ্যে আনাগোনা করছে, লঙ্কা ১৫ থেকে ৪০ টাকা। তা এই আনাগোনা ঠিক কার নিয়ন্ত্রণে?
লোকে বলতেই বলে, আলু-পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা। এদেশে এমন অনেক গৃহস্থালি আছে, যেখানে আলুভাতে পর্যন্ত বিলাসিতা, যেখানে দু'টুকরো পেঁয়াজ আর দুটো লঙ্কা দিয়ে একথালা ভাত খাওয়া হয়ে যায়। সেই অতি সামান্য খাদ্যেও যখন হাত পড়ে, তখন না খেয়ে শুকিয়ে মরার আতঙ্ক গ্রাস করলে কি তা অযৌক্তিক?
'আলু' শব্দটা উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে আয়ারল্যান্ডের 'পোটেটো ফ্যামিন' বা 'আলু দুর্ভিক্ষের' কথা। ১৮৪৫ থেকে ৪৯ সালের মধ্যে এই দুর্ভিক্ষের কারণে মারা গিয়েছিলেন ১০ লক্ষের বেশি মানুষ, আয়ারল্যান্ড ছেড়ে পালিয়েছিলেন প্রায় সমপরিমাণ, যার ফলে দেশের জনসংখ্যা কমে গিয়েছিল ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। বলা বাহুল্য, স্রেফ আলুর আকালেই সীমিত থাকে নি এই দুর্ভিক্ষ, পরিণত হয়েছিল বৃহত্তর খাদ্য সঙ্কটেও। যার একাধিক কারণের মধ্যে ছিল সরকারি নীতির ব্যর্থতা, পুঁজিবাদের অনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন, এবং একফসলি চাষের প্রথা।
শুরুটা কিন্তু হয়েছিল আলুর ফসলের ব্যর্থতা, এবং চড়চড় করে বাড়তে থাকা আলুর দাম দিয়েই। একটা সিঁদুরে মেঘের ছায়া কি দেখা যাচ্ছে না?