Advertisment

অনলাইন বিতণ্ডা এবং শালীনতার সীমা-পরিসীমা

মানুষের ভিতর কী পরিমাণ বিদ্বেষের বিষ জমা থাকে, ভিতরের সেই বিষ কোন ময়লা আবর্জনায় মাখামাখি হয়ে নির্গত হতে পারে, সেটা শুধু ফেসবুক বিচরণের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
social media manners

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে 'মিম', 'ট্রোল', এই বিষয়গুলো আজ সকলেরই জানা। যতক্ষণ পর্যন্ত এগুলো নির্ভেজাল মজা, সামান্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা আরও উন্নতভাবে বললে 'স্যাটায়ার' করার ভাবনার মধ্যে ছিল, ততদিন মেনে নেওয়া যাচ্ছিল। সেখানে বরং অনেক ক্রিয়েটিভ প্রয়োগ থাকত। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যেত। একটা নতুন ট্রেন্ড, নয়া প্রজন্ম এবং নয়া প্রযুক্তি, কিছু নিয়ম ভাঙার খেলা তো হবেই। কিন্তু মুশকিল হলো, সামান্য ছাড় পেলেই আমরা সীমানা ছাড়াই। তখন স্বাধীনতার পূর্ণ অপব্যবহার। শিক্ষা, রুচি, বিচার, বিবেচনা জলাঞ্জলি দিয়ে শোভনতা, শালীনতার বেড়া ভাঙার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি আমরা।

Advertisment

কথায় বলে বাক-সংযম। সামাজিক ক্ষেত্রে একটা সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি এক পাঠ। একই সঙ্গে আচার-ব্যবহার। বড়দের সঙ্গে, ছোটদের সঙ্গে, মোদ্দা কথা সমাজের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে কিভাবে কথা বলব, কেমন ব্যবহার করব, তার একটা সুস্পষ্ট গাইডলাইন অলিখিতভাবে মেনে চলাটা সামাজিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে। এটাকে নিছক অনুশাসন কিন্তু বলা যাবে না। এটা সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার একটা ফর্মূলা। এবার এই ফর্মূলা কেউ মানবে কিনা সেটা যার যার নিজের বিবেচ্য। আমরা যারা মেনে এসেছি, তারা এতে সুফল পেয়েছি নিশ্চয়ই। তার মানে এই নয়, আমরা প্রতিবাদ করি না। এই নয় যে সামাজিক বৈষম্য বা অন্যায়, অসামঞ্জস্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে মুখ খুলি না। কিন্তু সবটাই একটা রীতি মেনে করি। কী সেই রীতি, না, কোনও অবস্থাতেই নিজের শিক্ষা ও রুচিকে নিম্নগামী করব না। যেটা করব, সেটা শালীনতা, শিষ্টতার সীমা বজায় রেখে।

নিঃসন্দেহে পারিবারিক শিক্ষাটা এখানে কিছু শতাংশ হলেও উল্লেখের ভাগিদার। বাকিটা নিজের ওপর। মনে পড়ছে শৈশবে, উঠতে-বসতে অভিভাবকদের এ ব্যাপারে রীতিমতো নজর থাকত আমাদের ওপর। কোথায় কী বলব, কতদূর বলব - তার একটা স্পষ্ট নির্দেশিকা মেনে চলতে হতো আমাদের। আমাদের সময়ের সব শিক্ষা ভালো আর এখন কোনও শিক্ষাই নেই, এমন কথা বলাটা নিশ্চয়ই খুব একপেশে হয়ে যাবে। কিন্তু এটা তো ঠিক, কথাবার্তা, আচার-ব্যবহারের সেই শিক্ষা আজও কাজে লাগে আমাদের। একটা সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ বজায় রাখতে অনেকটাই সাহায্য করে।

প্রশ্ন হলো, এই যদি আমাদের সমাজের স্বাভাবিক রীতি বা চিরায়ত সাংস্কৃতিক কাঠামো হয়, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া কি এর বাইরে? সেখানে কি কথা বা ব্যবহারের কোনও ব্যাকরণ মানার দরকার পড়ে না? সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিত আজ সবাই। সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব একালে অসীম। আমাদের যাপিত জীবনের নিয়ন্ত্রক বহু ক্ষেত্রে। আর এখান থেকেই শুরু এক অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক সমস্যার। যেটা গোড়ায় বললাম, সুসম্পর্ক বজায় রাখার ফর্মূলা, সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া। সেই রীতি বা ফর্মূলা না মানার এক জ্বলন্ত নিদর্শন এখন ফেসবুক খুললেই পাতায় পাতায় প্রকট। যে যাকে যা খুশি বলছে, যেভাবে পারছে অপমান করছে, গালিগালাজের তো কোনও সীমাই নেই।

কারও বিরুদ্ধে আক্রমণের ছুরি শানানোর প্রথম ধাপটাই হলো তাকে অকথ্য গালিগালাজ, খিস্তিখেউড় এবং নানাভাবে কলঙ্কিত করা। একটা শ্রেণী প্রবলভাবে সক্রিয়, যারা দিবারাত্র এটাই করে। এরা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ভালো কিছু, যা সমাজের অগ্রগতির পক্ষে, সেটা করে না। এরা প্রযুক্তির সাহায্যে লোকজনকে নিয়ে নোংরা মিম বানায়, ট্রোল করে, তারপর তা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দেয় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার সর্বত্র। ভাইরাল করা, ভাইরাল হওয়ার ব্যাপারটাকে এখন ভাইরাস অর্থাৎ রোগজীবাণু ছড়ানোর সঙ্গে নির্দ্বিধায় তুলনা করা যেতে পারে।

সত্যি কথা বলতে কী, মানুষের ভিতর কী পরিমাণ বিদ্বেষের বিষ জমা থাকে, ভিতরের সেই বিষ কোন ময়লা আবর্জনায় মাখামাখি হয়ে নির্গত হতে পারে, সেটা শুধু ফেসবুক বিচরণের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়। আর তার টার্গেট যদি কোনও মহিলা হন, তবে তো কথাই নেই। বস্তুত, মহিলাদেরই তুলনায় বেশি টার্গেট করা হয়। এবং তার যে কী কদর্য রূপ! একটি ছবি, কিছু শব্দের প্রয়োগে কিভাবে একটি নারীকে অপমানিত করা যায়, তার অজস্র নিদর্শন সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি আমরা। এও একপ্রকার ধর্ষণ যদি বলি, তাহলে বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে না।

শুধু পোস্ট বা কমেন্টও যদি দেখি, সেখানেও সহমত না হলেই আক্রমণ। আর সেই আক্রমণের ভাষাতেও লাগামছাড়া শব্দের প্রয়োগ। অশ্লীল, অশালীন ভাষা নির্দ্বিধায় একে অপরকে বলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলের সভ্য, সমর্থক হলে তো কথাই নেই। অপর পক্ষকে ছোট করতে কোনও যুক্তি বা তথ্য প্রণয়ন নয়। তেড়ে গালি দাও তাকে বা তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে বহু ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে সামাজিক কাজকর্ম করে এমন সংস্থার মধ্যেও দেখেছি চরম ঔদ্ধত্য। তারই অনুষঙ্গে অকথা, কুকথা, কোথাও উচ্চারণ করা যায় না এই পর্যায়ের গালিগালাজ। এদের কথোপকথন পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, ফেসবুকের পাতাতেই কি এভাবে নিজেদের প্রকাশ করে এরা? নাকি মুখোমুখি হয়ে ভাব বিনিময়েরও এটাই রীতি? বলতে খারাপ লাগে, পরিণত বয়স্ক অনেক মানুষের মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। রাগ, ক্ষোভ, জ্বালা বিরক্তি প্রকাশে এই ধরনের ভাষার ব্যবহার কি অপরিহার্য?

এই আচরণ, ব্যবহার, মুখের ভাষা নিয়ন্ত্রণের কি কোনও উপায় আছে? প্রয়োজন যে আছে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু এর শুরুটা কোথা থেকে হবে? আগে তো এর কুফল সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে, এটা সভ্যতা নয়। এটা করে চললে শিক্ষা, বুদ্ধি, যুক্তির চর্চা ক্রমশ কমতে থাকবে। সবথেকে বড় কথা, যাঁরা এর ভিকটিম হচ্ছেন, তাঁদের কথা ভাবা দরকার। তাঁরা যে অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যান, তার ক্ষতিপূরণ করবে কে? সাধারণভাবেও ফেসবুকের সবাই যে এটা পছন্দ করে, এমনটাও নয়। এমন তথাকথিত বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে গিয়ে কতজনকে আনফ্রেন্ড আর ব্লক করা যায়? এতে তো সুস্থ ভাবনার আদানপ্রদানটাই বন্ধ হয়ে যাবে।

জানি না, আজকের সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণকারী কতজন মানুষ এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। আইন করে, অর্থাৎ সেন্সর করে কি এই ট্রেন্ড বন্ধ করা সম্ভব? এ প্রসঙ্গে একটা ছবির কথা মনে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এক চেনা মহলে আড্ডা হচ্ছে একদিন। কেউ সাংবাদিক, কেউ বিনোদন জগতের। একজন আমাকে প্রশ্ন করল, "দিল্লি বেলি"দেখেছ? না দেখলে দেখে নাও। নয়তো মিস করবে।" ছবিটা সদ্য মুক্তি পেয়েছে। কিছুটা বিতর্কও তৈরি করেছে। বিষয়টা সেটা নয়। সেই সময় আমার কর্মব্যস্ততা এতটাই চলছিল, যে, ইচ্ছে থাকলেও সব ছবি হলে গিয়ে দেখা হতো না। সিনেমা নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও ছবির প্রিমিয়ারে অন্যকে পাঠাতে হয়েছে, এমনটাও ঘটেছে। অতএব টিভিই ভরসা।

আমার এই অবস্থার কথা ওই আড্ডা মহলের সবাই জানে। আর আমার ভাবনার সূত্র ধরেই একজন বলে ওঠে, "কবে টিভিতে আসবে, সেই আশায় যদি থাকো, তবে, 'দিল্লি বেলি' দেখার ইচ্ছা তোমাকে ত্যাগ করতে হবে।" কেন? প্রশ্নের জবাবে যা জানলাম, টিভিতে যখন ছবিটা দেখানো হবে, তখন তাহলে পুরো সময়টাই সংলাপের বদলে 'বিপ' শুনতে হবে। আমরা সবাই খুব হেসেছিলাম এটা নিয়ে, মনে পড়ছে। কিন্তু, এটা সত্যি, এ ছবি সত্যি কোনও ভারতীয় চ্যানেল সেই সময় দেখাতে পারেনি, সংলাপে অত্যধিক গালিগালাজ ব্যবহারের কারণে। এই প্রয়োগ নিঃসন্দেহে গল্পের প্রয়োজনে। কিন্তু টিভি যেহেতু পারিবারিক বিনোদন মাধ্যম, তাই এই বাধ্যবাধকতা।

যাই হোক, যেহেতু ওয়েব মিডিয়া অত নীতি পুলিশি নিয়ে মাথা ঘামায় না, সেন্সর আইন তত কড়া নয় এখানে। তাই একটি ওয়েবসাইটে সেদিন দেখলাম 'দিল্লি বেলি' আছে। তা সত্ত্বেও বলব, সাধারণভাবে ভারতীয় সিনেমা বা বিনোদনের যে কোনও মাধ্যমে আজও এই বিধিনিষেধ আছে। ফেসবুক যদি এর আওতায় কখনও আসে, তাহলে এই মুহূর্তের যা অবস্থা, তাতে ওই পুরোটাই প্রায় 'বিপ বিপ'! সেদিনটা আসার আগে কি সচেতন হব আমরা?

Facebook Social Media twitter Whatsapp
Advertisment