Advertisment

অঙ্গদান: যতটা প্রয়োজন, আমরা ততটা পারি না কেন?

চক্ষুদান প্রসঙ্গে একবার একজনকে বলতে শুনেছিলাম, "এ জন্মে মরার পর চক্ষুদান করলে পরের জন্মে আমি অন্ধ হয়ে জন্মাব। না বাবা দরকার নেই!"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
organ donation kolkata

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

'অপরিসীম বেদনা'
'অবর্ণনীয় যন্ত্রণা'
'অসাধারণ উপলব্ধি'
'অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন'

Advertisment

বাংলার প্রতিটি মানুষ কুর্ণিশ জানিয়েছেন এই মা-বাবাকে। অহর্ষি ধর। মাত্র তিন বছর বয়সী এই শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গি। বাবা-মায়ের কোল শূন্য। কী অসহায় তাঁরা। অনেক চেষ্টা করেও ছেলের প্রাণ বাঁচাতে পারেননি। কিন্তু অসাধারণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অপরিসীম শোকের যন্ত্রণা এখনও তাঁদের দিবারাত্রির সঙ্গী। তবু, চরম যন্ত্রণাকে এক অনন্য উপলব্ধির আলোয় দেখেছেন অহর্ষির মা-বাবা। এক অননুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মৃত ছেলের অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে। অহর্ষির মৃত্যু-পরবর্তী দৈহিক অবস্থা অনুকূলে ছিল না, সম্ভব হয়নি শরীরের সমস্ত অঙ্গদান, তবে ইতিমধ্যেই তার কর্নিয়া দান করা হয়েছে।

অঙ্গদান এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এদেশে এখনও অঙ্গদান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। চক্ষুদান প্রসঙ্গে একবার একজনকে বলতে শুনেছিলাম, "এ জন্মে মরার পর চক্ষুদান করলে পরের জন্মে আমি অন্ধ হয়ে জন্মাব। না বাবা দরকার নেই!" খাস কলকাতা শহরের বুকে বসে একজন শিক্ষিত মানুষের মুখে একথা শুনে এতটাই চমকে উঠেছিলাম যে এ নিয়ে তর্ক করার স্পৃহাটাও হারিয়ে ফেলি। এমন এক প্রেক্ষিতে অহর্ষির মা-বাবার সিদ্ধান্ত নতুন আশাবাদের কথা বলে। বিশেষত জীবনের অত্যন্ত নেতিবাচক একটি অভিজ্ঞতাকে যেভাবে ইতিবাচক দিকে নিয়ে গিয়েছেন তাঁরা, তা এককথায় অনন্যসাধারণ। নিঃসন্দেহে বিরলের মধ্যে বিরলতম হয়ে থাকবে এই সিদ্ধান্ত।

আরও পড়ুন: রসিকতা যখন অমানবিক, তামাশা যখন বিকৃতি

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে হুগলির অতনু চক্রবর্তীর নাম। এই নভেম্বরেরই ঘটনা। মারাত্মক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে এসএসকেএম-এ ভর্তি হন ২৭ বছরের এই তরুণ। চিকিৎসকদের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে ব্রেন ডেথের দিকে চলে যান অতনু। তাঁর শারীরিক অবস্থা বুঝেই চিকিৎসকরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অতনুর অঙ্গদান বিষয়ে কথা বলেন। তারপর তাঁদের সম্মতিক্রমে অতনুর দু'টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুজন রোগীর শরীরে। ওই দুজনেই এখন ভালো আছেন। চিকিৎসকরা অতনুর অন্যান্য অঙ্গদানের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলেও পরিবারের সম্মতি মেলেনি বলে খবরে প্রকাশ। যদিও প্রথমে রাজিই ছিলেন তাঁরা। পরে কেন মত বদলান, জানা যায়নি।

একদিকে কিডনি দানের মধ্য দিয়ে যেমন অতনুর পরিবার সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করলেন, তেমনই তাঁদের পক্ষ থেকে অতনুর বাকি অঙ্গ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। অঙ্গদান বিষয়ে এখনও যে আমরা ততটা সচেতন নই, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কোথাও যেন একটা দ্বিধা কাজ করে বলে মনে হয়। কী সেই দ্বিধা? নিছক অন্ধ কুসংস্কার? নাকি প্রিয় মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মৃত্যুর পরেও আমাদের মনের দুর্বল জায়গাটা অধিকার করে থাকে?

এই দুর্বলতা অথবা কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলতে পারলে কী হয়, সেই দৃষ্টান্তও কিন্তু আমাদের সামনে আছে। ছাব্বিশ বছরের তরুণী মাম্পি ঘোষের হৃদযন্ত্রের সমস্যা বহু পুরোনো। একটা সময় হৃদযন্ত্রের অপারেশন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যবশত, অপারেশনের সময়েই ব্রেন ডেথ হয় মাম্পির। পরিবারের অবস্থা কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয় না। তবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তাঁরাও। তাঁদের সম্মতিতে মাম্পির লিভার ও দুটি কিডনি প্রতিস্থাপিত করা হয় তিনজন রোগীর শরীরে, যা তাঁদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে আজ।

এমন আরও ঘটনা বারবার উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে। যদিও এই ঘটনাগুলি মূলত কোনও কঠিন অসুখ বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে যাওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে নেওয়া তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত। এটা নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু অঙ্গদানের মূল বিষয়টা অন্যত্র।

আরও পড়ুন: মারণ নেশার নাম এখন স্মার্টফোন, কিন্তু আমি জানি, মুক্তি সম্ভব

অঙ্গদান আদতে এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আন্দোলন, প্রক্রিয়া, পরিক্রমা যেটাই বলি, তার প্রেক্ষিত কিছুটা ভিন্ন। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি তাঁর জীবিতকালেই স্বেচ্ছায়, যাকে বলে সম্পূর্ণ আইন মেনে সইসাবুদ করে, নিজের সম্পূর্ণ দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারেন। অঙ্গদান আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত মানবিক এক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলে। মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির কাছে আর কীই বা মূল্য শরীরের। কিন্তু এর দ্বারা যদি অপর একজন সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সক্ষম হন, তবে তার চেয়ে পুণ্যের কাজ আর কী হতে পারে?

বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রেও পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। যে ব্যক্তি তাঁর অঙ্গদান করেছেন, তা যেন যে মানুষটির প্রয়োজন, তাঁর শরীরে যথাসময়ে স্থাপন করা হয়। নাহলে যে সমস্তটাই ব্যর্থ। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের পক্ষ থেকে এই ভূমিকা যথাযথভাবে পালিত হয়নি দেখা যায়। এমনও শোনা গেছে, দাতা জীবিতকালে তাঁর পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর পরিবার তাঁর ইচ্ছের সম্মান রক্ষার চেয়েও গুরুত্ব দিয়েছেন নিজেদের বিশ্বাস ও সংস্কারকে।

আবার নিছক গাফিলতির ঘটনাও ঘটে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্রুটিও অনেকসময় এর কারণ হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে এটা একটা জটিল ও জরুরি সমস্যা। হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে খবর দেওয়া, অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া, সময়মতো মৃতের শরীর থেকে অঙ্গ ছেদন করে তাকে প্রতিস্থাপনের জন্য নিয়ে যাওয়ার আয়োজন, এই সবই আধুনিকতম পরিকাঠামো ছাড়া অসম্ভব। তবে সদিচ্ছা থাকলে কী না হয়, এই আপ্তবাক্য মেনেই এর মধ্যেও কিছু মানুষ তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন।

একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল না হলেও অনেকটাই দূর। দুর্গাপুর মিশন হাসপাতাল থেকে গ্রিন করিডোর তৈরি করে ১৭৫ কিলোমিটার সড়কপথ পেরিয়ে কিশোরী মধুমিতা বায়েনের অঙ্গ কলকাতার এসএসকেএম-এ নিয়ে আসার খবর সকলেরই জানা। পাঁচটি অঙ্গ দান করে পাঁচজন মানুষকে নতুন জীবন দেয় মধুমিতার ব্রেন ডেথ হওয়া শরীর। চারটি জেলার পুলিশ অতন্দ্র প্রহরায় একযোগে কাজ করে। মাত্র ২ ঘন্টা ১৫ মিনিট সময়ে মধুমিতার অঙ্গ এসে পৌঁছয় দুর্গাপুর মিশন হাসপাতাল থেকে এসএসকেএম-এ। সদিচ্ছা ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না।

আরও পড়ুন: ‘সব পেয়েছির দেশে’ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানরা

চিকিৎসকদের জন্য জরুরি শুধুই পরিবারের সম্মতি নয়, খুঁজে বের করতে হয় গ্রহীতাকেও। তার সঙ্গে রয়েছে একের অঙ্গ ওপরের দেহের সঙ্গে ম্যাচ করার জটিলতা। ফলে, চিকিৎসকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ সাপেক্ষ এই বিষয়টা। তবে সমস্ত প্রতিকূলতার মাঝেও এই চ্যালেঞ্জ নিতে চিকিৎসকরা প্রস্তুত। তাঁদের কথায়, অঙ্গ পাওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

এদেশে এখনও অঙ্গদানের হার আশানুরূপ নয়। বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে এই বোধ ও চেতনা জাগ্রত হওয়া আশু প্রয়োজন। মানবধর্ম হলো সর্বশ্রেষ্ঠ। এই বিশ্বাসেই অহর্ষির মা-বাবা কুসংস্কারমুক্ত মন নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। এরই সঙ্গে বলতে হয় বর্ধমানের সঞ্চিতা কুন্ডুর কথা। ৭২ পার করা এই বৃদ্ধ পরিচারিকা এগিয়ে এসেছেন মরণোত্তর দেহদানের মহৎ উদ্দেশ্যে। সঞ্চিতার ইচ্ছে, মৃত্যুর পর তাঁর দেহ ডাক্তারি পড়ুয়াদের পড়ার কাজে লাগুক। শোনা যায়, টিভিতে মধুমিতা বায়েনের অঙ্গদানের খবরেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন সঞ্চিতা। প্রথাগত শিক্ষা নেই তাঁর। অথচ কী অপূর্ব বোধ ও চেতনার প্রকাশ। মধুমিতার ঘটনাটি ঘটে ২০১৮-র নভেম্বরে। তার পরের ডিসেম্বরেই সঞ্চিতা এই সিদ্ধান্ত জানান। সত্যি তো, শুভ কাজে দেরি কেন ? দেরি করেননি সঞ্চিতা। অনুপ্রাণিত হয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন আমাদের।

প্রত্যেক রাজ্যে অঙ্গদানের জন্য নিজস্ব রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা আছে। যাঁরা অঙ্গদান করতে চান, তাঁদের এখানে নিজেদের নাম রেজিস্ট্রি করাতে হবে। ইন্টারনেটে এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য মিলবে। একজন ব্যক্তি তাঁর কোন কোন অঙ্গ দান করতে পারেন, সে বিষয়ে সবসময় চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সাধারণভাবে অঙ্গদানের কোনও বয়স নেই। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ছাড়াও সম্পূর্ণ দেহদান সম্ভব। এটা ডাক্তারি পড়ুয়াদের পঠন ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে একান্ত জরুরি।

আরও পড়ুন: ঘরের হিংসা ঘরেই শেষ হয় না

প্রসঙ্গত, ইন্টারনেট সকলের আয়ত্তে না-ও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি স্তরে যাঁরা যেভাবে এই কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের দিক থেকে কিছু পদক্ষেপ জরুরি। বহু মানুষ আজকাল এই বিষয়ে সচেতন। তাঁরা চাইছেন, মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গ দান করতে। কিন্তু জানেন না কোথায়, কীভাবে কাজটা করবেন। তাঁদের জন্য আঞ্চলিক স্তরে হেল্পলাইন বা তথ্য প্রণয়নকেন্দ্র থাকলে এই প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে।

এরই পাশাপাশি অঙ্গদানের দৃষ্টান্ত তো আছেই। মিডিয়ার ভূমিকা এক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক। সকলে খবরগুলি জানতে পারছেন সহজেই। যেমন করে মধুমিতার খবর অনুপ্রাণিত করেছে সঞ্চিতাকে, ভবিষ্যতে তেমন করেই ছড়িয়ে পড়ুক এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক চেতনা ও বোধের খবর। আগল ভাঙুক অন্ধ কুসংস্কারের।

Advertisment