গত ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান করোনাভাইরাস সঙ্কটে অর্থ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে টানা চার ঘণ্টার একটি 'টেলিথন' করেন, যার শেষে প্রায় ৩ বিলিয়ন টাকা সংগ্রহ করে ফেলেন তিনি। এরপরেই তাঁর পছন্দের ধর্মযাজক তারিক জামিলকে বলেন প্রার্থনা করতে। ভণ্ড এই যাজক প্রথমে আপত্তি জানালেন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে 'লড়াই' শব্দটিতে, কারণ এই মহামারী "আল্লার অভিশাপ", এবং তাঁর মতে দুর্নীতিপরায়ণ ও লালসাগ্রস্ত দেশের উচিত, এর জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করা। ইমরান সমেত গোটা দেশ সেই পুরোনো অভ্যাসমত মাথা নুইয়ে শুনলেন।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে COVID-19 এর মোকাবিলায় পাকিস্তানের নীতি নির্ধারণে ডাক্তারদের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন দেশের ধর্মীয় নেতারা। এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের কবলে পড়েছেন পাকিস্তানের ১০,৫০০ মানুষ, মৃত্যু হয়েছে ২৮০ জনের। ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-এ-ইনসাফ (পিটিআই) এবং দেশের "শীর্ষ" ধর্মযাজকদের "ঐক্যমতের" ফলে দিনে পাঁচবার মসজিদে যাওয়ার, তৎসহ রমজানের বিশেষ প্রার্থনার (কবে এই ধর্মীয় কর্তাবাবুরা চাঁদ দেখবেন তার ওপর নির্ভর) সরকারি অনুমোদন জারি হওয়ার পরই সাড়া পড়ে যায় ডাক্তার মহলে।
তারপর এক আজব ব্যাপার ঘটে। পাকিস্তানের আর এক বর্ষীয়ান যাজক, মুফতি মুনিব, করাচির একটি ছাদে উঠে রমজানের চাঁদ দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু খুঁজে পেলেন না। ইসলামিক লুনার বা চান্দ্র ক্যালেন্ডার প্রতিমাসে দিব্য চাঁদ ওঠার সঠিক সময় জানিয়ে দেয়, কিন্তু অবশ্যই এই ধর্মযাজকদের তার ওপর কোনও আস্থা নেই। বৃহস্পতিবার যখন চাঁদের দেখা মিলল না, তখন মুফতি ঘোষণা করে দিলেন যে পরের দিন রমজানের উপবাসের প্রথম দিন হবে না। তবে সৌদি আরব রমজান ঘোষণা করে দিল, এবং পেশাওয়ারের বিদ্রোহী মোল্লা পোপালজাইও দাবি করলেন, তিনি চাঁদ দেখতে পেয়েছেন। এবার তাই হবে যা আগেও বহুবার হয়েছে, উপবাস নিয়ে বিভাজিত হয়ে পড়বে পাকিস্তান, এবং দুটি ঈদ পালিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান নিজে কখনোই ডাক্তারদের অনুগামী হন নি - যদিও মহামারীর চিকিৎসা করতে গিয়ে এর শিকার হয়েছেন ডজন ডজন চিকিৎসক - কারণ দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষদের জীবিকা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ঢুকে পড়লেন মোল্লারা, নেতৃত্বে মুফতি তাকি উসমানী, যাঁর পাকিস্তানে কর্তৃত্বের বহর, এবং আরবদের সঙ্গে দহরম মহরমের ভয়ে, সকলেই থরহরি কম্প। এক্ষেত্রে তিনি খোলাখুলি বিরোধিতা করলেন সৌদি রাজপরিবার এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলির, যারা সমস্ত জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ইমরানের সরকার একটি অবাস্তব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মসজিদ কর্তৃপক্ষকে 'তিন-মানুষের নমাজ' পড়তে দেওয়ার। এবার ওই 'চাঁদ সন্ধানকারী' সরকারিভাবে নিযুক্ত মুফতি মুনিবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উসমানী ঘোষণা করলেন যে সরকার অনুমোদিত নমাজ গ্রহণযোগ্য নয়, এবং আগের মতোই মসজিদে ভিড় জমানোই উচিত। এবার এঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসে ইমরান শেষমেশ মসজিদে প্রার্থনার অনুমতি দিয়েই দিলেন, যার ফলে দাবানলের মতো ছড়াল মহামারী। উভয় পক্ষ একমত হয়ে বললেন, নমাজ পড়ার সময় তিন ফুটের দূরত্বে বসবেন ভক্তরা, যা সম্ভব হবে বলে কেউই বিশ্বাস করছেন না।
তাঁদের চিঠিতে পাকিস্তান ইসলামিক মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ডাক্তাররা বলেছেন যে মসজিদ যদি খুলে দেওয়া হয়, তবে ভাইরাসের রোগীদের দায় নিতে পারবে না দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাঁরা হুঁশিয়ারি জারি করেছেন যে "দেশের সব মসজিদে প্রার্থনাকারী অধিকাংশ মানুষেরই বয়স ৫০-এর ওপরে, যার ফলে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা খুব বেশি"। তাঁরা জানান যে "গত ৪৮ ঘণ্টায়" মসজিদে প্রার্থনাকারী "৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষের" বয়স ৬০ বা ৭০-এর ঘরে। ডাক্তারদের বক্তব্য, "স্পষ্টতই বয়স্কদের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে যে অন্যতম প্রতিরোধ নীতি, তা লঙ্ঘিত হয়েছে।"
বর্তমানে দারিদ্র সীমার নীচে বাস করেন পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ, যাঁদের সন্তানেরা বেড়ে ওঠে নিখরচার মাদ্রাসায়। এই মাদ্রাসাগুলির বিশ্বদর্শন মূলত জেহাদ পন্থা, এবং আধুনিক জীবনযাপনের বিরোধিতার ভিত্তিতে গঠিত। একটি তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে ছিল আনুমানিক ৩০০টি মাদ্রাসা; আজ সেই সংখ্যাটা ৩৫ হাজারেরও বেশি। দারিদ্র এবং অশিক্ষার এই আবহে অবহেলিত জনসমাজের মানসিক অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম।
ভারতেও সংখ্যালঘু মুসলমানরা, যাঁদের আমরা টিভিতে দেখেছি হিন্দু নজরদার কমিটির সদস্যদের হাতে প্রহৃত হতে, ক্রমশ ধর্মমুখী হচ্ছেন। অতি সাধারণ মুসলমান দোকানদাররা তাঁদের দৈনিক রোজগার নিশ্চিত করেই পাঁচবার নমাজ পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদগামী হন। এবং শিকার হয়ে যান দক্ষিণ এশিয়ায় বাড়তে থাকা ধর্মীয় বিভাজনের। পাকিস্তানে অন্তত সাধারণ জনতাকে মসজিদ থেকে দূরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে, এবং পাল্লা দিয়ে বাড়বে COVID-19 এর দাপট।
(লেখক 'নিউজউইক পাকিস্তান'-এর সম্পাদকীয় উপদেষ্টা)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন