Advertisment

আরো একটা বই- কৃষি পরাশর বা পরাশর সংহিতা

প্রায় পঞ্চাশটি শ্লোকে পরাশর কৃষককে আকাশ চেনাচ্ছেন। কী দিয়ে? আকাশের যে অক্ষর, সেই গ্রহতারার সংস্থান দিয়ে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Ancient Knowledge

ফাইল ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

এই বইটার কথাও বলতে খুব ইচ্ছে করছে পাঠকদের কাছে।

Advertisment

বহু বছর ধরে শুনেছি এই বইটার নাম- ‘কৃষি পরাশর’। কেউ কেউ বলেন ‘পরাশর সংহিতা’। কৌতূহল ছিল, আগ্রহও ছিল, পরাশর তো এক জ্ঞানী ঋষি। বহু প্রাচীনকালের। কী বলেছেন তিনি কৃষিকাজ বিষয়ে? কী বলে থাকতে পারেন! তারপর একসময় হাতে পাওয়া গেল সে গ্রন্থ। ছোট, মাত্র ২৪৩ টি শ্লোক, অতি সরল সংস্কৃতে রচনা, কিন্তু সব কৌতূহল, সব প্রশ্নকে ছাপিয়ে গেল ঐ শ্লোকটি। কী অভ্রান্ত পারদর্শী সেই জ্ঞান, একমাত্র বিপুল অভিজ্ঞতা  ও তার সারসংক্ষেপের দক্ষতা ছাড়া  এমন তীক্ষ্ণ সরল যুক্তি আয়ত্ত হয় না।

শুরুতেই, তৃতীয় শ্লোকে বলা হচ্ছে, কণ্ঠে কর্ণে চ হস্তে চ সুবর্ণ বিদ্যতে যদি।

উপবাসস্তথাপি স্যাদন্নাভাবেন দেহিনাম।।

Jol Mati Environment Column ছবি সৌজন্য- লেখক

(গলায় কানে হাতে যদি সুবর্ণের গয়নাও থাকে, তবু অন্ন অভাবে তার উপবাসের কষ্ট করতে হয়) এই অকাট্য যুক্তির পর গ্রন্থকার ব্যখ্যা করছেন কেন কৃষিই মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজ। বইটিতে তিনি সেই কৃষিকাজের প্রকৃষ্ট উপায়ই শিক্ষা দিতে বসেছেন। সেই কৃষিও আবার সুদূর অপরিচিত অন্য কিছু নয়, একেবারে সরাসরি ধান্যকৃষি। ধানচাষ।

কে ছিলেন এই পরাশর ঋষি, তিনি কি অভিন্ন মহাভারত উল্লিখিত মহাতেজা পরাশর ঋষির সঙ্গে? এইসব কোনও বিতণ্ডায় না গিয়ে আমরা গ্রাহ্য করে নিই এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বইটির ভূমিকায় মানিত বিশেষজ্ঞদের মত যে ছন্দোবদ্ধ শ্লোকের মাধ্যমে রচিত এই সংহিতার রচয়িতা ঋষি পরাশর অবশ্যই ষষ্ঠ শতাব্দীর আগেকার মানুষ। সেইখানে আমাদের মত পাঠকের জন্য অপেক্ষা করে আরেকটি আনন্দের আবিষ্কার – যে কৃষিপদ্ধতির কথা এখানে বলা হচ্ছে সেই জৈষ্ঠ্যে বীজবপন করে ‘মই’ দিয়ে মাঠের ঢেলা ভেঙে তৈরি জমিতে চাষ করে অঘ্রাণে কাটা ফসলের অন্নপাক সকলের সঙ্গে মিলে খেয়ে ধান গোলায় তোলা- তা একেবারে আজও প্রচলিত বাংলার ধান্যকৃষি।

Cloud Parashar Gyan ছবি- লেখক

ভাবতে ইচ্ছা হয় যে জ্ঞানী পরাশর যেখানকারই মানুষ হোন না কেন, তিনি বাস করেছেন এই আমাদের পূর্বদেশেই। এখানকার চাষবাসই তাঁর গ্রন্থের প্রতিপাদ্য শিক্ষাবিষয়। সেই ধারাবাহিকতায় পরাশরের ‘অন্ন প্রাণাং অন্ন বলং অন্নং সর্বার্থসাধনম’ এই অন্নস্তুতি অনেক শত বছর পেরিয়ে যখন প্রায় প্রত্যক্ষ শুনি আমারই কবির কণ্ঠে ‘অন্ন প্রাণ অন্ন বাক্য অন্নই চেতনা’(বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)  নিমেষে সহস্রাধিক বছরের এপার ওপার জুড়ে এক সেতুবন্ধ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আমি নিজের সংস্কৃতির ভূমি আবিষ্কার করি, খুঁজে পাই নিজের শেকড়। ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের উচ্চারিত ‘ভারতীয় কৃষির বয়স অন্তত দশ হাজার বছর’ এই তথ্য নতুন আশ্বাস দেয় আমার ভিত্তিচ্যুত অস্তিত্বকে।

কী আছে এই কৃষি সংহিতায়?  কোন নতুন শিক্ষা দেবার চেয়ে বিশেষ বিষয়ে বিস্তৃত বিক্ষিপ্ত আচরিত জ্ঞানকে সংহত বিধিবদ্ধ ভাবে ধারণ করাই সংহিতার ধর্ম। কোন বিধিসমূহ শিক্ষা দিচ্ছেন ঋষি? এম এ ক্লাসের ছাত্রীকে যেমন প্রাইমার পড়ান না শিক্ষক, পরাশর ‘কৃষকাণাং হিতার্থায়’ কৃষকদের চাষবিধি শেখাচ্ছেন না। কৃষির যে সব প্রধান কাজ, সেই মাটি চষা, সেচ, ফসল  কীভাবে কাটতে, ঝাড়াই-বাছাই করতে হয়, কেমনভাবেই বা তৈরি করতে হয় শস্যগোলা এসব বিষয়ে প্রায় কিছুই বলছেন না তিনি। আশ্চর্য সুন্দর অবতারণা দিয়ে তিনি পাঠককে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য দুটি জায়গায়- মেঘ চেনা আর ফসল ওঠার পর কৃষক-গৃহস্থের কর্তব্য। অর্থাৎ শিক্ষা দিচ্ছেন অপেক্ষাকৃত কম আচরিত গভীরতর বিষয়ের গুরুত্ব নিয়ে।

‘বৃষ্টি কৃষির মূল, জীবনেরও মূল বৃষ্টি। সুতরাং প্রথমে অতি যত্নে বৃষ্টিজ্ঞান লাভের চেষ্টা করতে হবে’- এই প্রস্তাবনা দিয়ে পরাশর প্রবেশ করছেন বৃষ্টি শাস্ত্রে। কী পাঠ বৃষ্টিশাস্ত্রের? মেঘপরিচয়। শ্লোকের পর শ্লোক ধরে ঋষি শিক্ষা দিচ্ছেন কীভাবে মেঘ অধ্যয়ন করতে হয় কারণ মেঘই তো বৃষ্টির ভান্ডার। বুঝতে পারি জলবিরল রাজস্থান কেন আকাশকে ডাকে ‘হাকরো’ নামে। ‘হাকরো’ তো স্পষ্টতই ‘সাগর’। মাটিতে যার নদীসাগর নেই সে দেশ তো সকল জলের আকর জানে আকাশকেই। আকাশই তাই তার সাগর।

নামাঙ্কিত বর্ষা যদিও মাত্র দু মাস কিন্তু বছরের বাকি সময়েও তো কমবেশি বৃষ্টিপাত হতেই থাকে। কী করে চাষী মেঘ পড়তে শিখবেন?  প্রায় পঞ্চাশটি শ্লোকে পরাশর কৃষককে আকাশ চেনাচ্ছেন। কী দিয়ে? আকাশের যে অক্ষর, সেই গ্রহতারার সংস্থান দিয়ে। কবে কোন দিক থেকে কেমন মেঘ কতোখানি উঠলে, কোনদিকে কতোদূর ছড়িয়ে পড়লে কতোটা বৃষ্টিপাত হবার কথা- সেই শিক্ষা রয়েছে বইটির প্রায় এক পঞ্চমাংশ জুড়ে। এইখানে একটা শঙ্কা থেকে যায়। আমাদের মত ছাত্রছাত্রী, প্রথম থেকে যাদের শিক্ষার অভ্যাস তৈরি হয়েছে নিজেদের দেশের শিক্ষাবিষয়গুলির বাইরে থেকে, চারিপাশের প্রাকৃতিক বস্তুর সঙ্গে যাদের শিক্ষার কোন যোগ গড়ে ওঠেনি, গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান দিয়ে আকাশের ক্যালেন্ডার এবং ম্যাপ চেনাটা তাদের কাছে জ্যোতিষচর্চার মত লাগতে পারে।

বস্তুত, সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বইয়ের সম্পাদকরাও। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মৌর্য আমল থেকে মানে অন্তত দুহাজার বছর আগে থেকে সিংহল ও পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য নিয়মিত সমুদ্রযাত্রা করার প্রচলন ছিল ভারতবর্ষে, যখন কি না ভারতবর্ষে পৌঁছবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে মানচিত্রহীন ভাবে আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া পৌঁছচ্ছিলেন অন্যদেশের অভিযাত্রীরা। কী ছিল তবে ভারতীয় মাল্লাদের সমুদ্রপথ চেনার দিশা?

রাত্রির প্রহরে প্রহরে আকাশের ওই জ্যোতিষ্কগুলির স্থান পরিবর্তনকে দীর্ঘ দীর্ঘকাল মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করে তৈরি হয়েছিল সেই পথনির্দেশক মানচিত্রটি। ওই একই পথ মেঘের যাতায়াতেরও। আর মেঘের পথ, তার আনাগোনার শাস্ত্র ভালোকৃষকের  পক্ষে একেবারে প্রাথমিক জ্ঞানের বিষয়। অভ্যস্ত যে সেচব্যবস্থা তা কৃষক জানেন নিজের নিত্যকর্ম আর প্রজন্মবাহিত অভিজ্ঞতার ফলে। তাই ‘বৃষ্টিমূলাং কৃষি’কারী কৃষককে সেচ সম্পর্কে কিছু না বলে পরাশর চলে যাচ্ছেন পরিশ্রমে অধীত জ্ঞান তার হাতে তুলে দেবার যত্নে। বৃষ্টি বেশি হবে না কম, অনেকটা জায়গা নিয়ে হবে না অল্প জায়গায়- সেই অতি প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার মত লক্ষণবিচার শেখাতে, অর্থাৎ প্রকৃতির নিজস্ব ভাষার পাঠ দিতে , শুরু করলেন।

সেই প্রাচীন শাস্ত্রে লক্ষণ অনুযায়ী মেঘেদের চারটি নাম- আবর্ত সংবর্ত পুষ্কর দ্রোণ। ‘একদেশেন আবর্ত সংবর্ত সর্বতো জলম। পুষ্করে দুষ্কর বারি দ্রোণে বহুজলা মহী।।’ এই প্রাথমিক লক্ষণের পর প্রতিমাসের বিচার - বৃষ্টি হবে কি হবে না, কিরকম থাকবে রৌদ্রতাপ, ফসলের ওপর কী প্রভাব হতে পারে তার, প্রত্যেকটি মাস ধরে ধরে তার বিবরণ দেওয়া চলছে। গ্রন্থের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ধরে, পঞ্চন্নটি শ্লোকে এই পাঠদানের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মেঘের পরিচয় ছাড়াও রয়েছে কুয়াশা বাতাস বজ্রবিদ্যুৎ ইত্যাদি নানান লক্ষণের কথাও। এমনকি বলা আছে বৃষ্টির দেবতা (ইন্দ্র) সর্বদাই বর্ষণ করেন দশভাগ সমুদ্রে, পাঁচভাগ পর্বতে আর চারভাগ সমতল পৃথিবীতে।

ঐ গ্রহনক্ষত্র-ঘটিত নির্দিষ্ট হিসাব ছাড়াও  শ্লোকের পর শ্লোকে পরাশর কৃষককে শেখাচ্ছেন অদ্ভুত সব অনুপুঙ্খ যা মনে পড়িয়ে দেয় বিশ বছর আগেও পুরুলিয়ার বরাবাজারে জঙ্গলঘেঁষা গ্রামে সাঁওতাল গ্রামবৃদ্ধদের আবহাওয়ার পুর্বাভাস গণনাপদ্ধতি। পৌষমাসের প্রথম সাতদিন ভোরে, সূর্য ওঠার আগে জঙ্গলে গিয়ে রাত্রে গাছের পাতার ওপর শিশির ও ধুলোর অনুপাত এবং নকশা দেখে তাঁরা সারাবছরের গ্রীষ্ম, বর্ষণ ও শীতের আগাম লক্ষণ বলতে পারতেন। বীরভূমে, উজ্জয়িনীতে, অসমের শিবসাগরে প্রাচীন মানুষেরা আজও হাতে করে ধুলো উড়িয়ে দেখে বলতে পারেন বৃষ্টি হবে কি না, কতক্ষণ পর হবে।

এইসব নিয়মে কোনো জাদুবিদ্যা নেই, এ তাঁরা খুব স্বাভাবিক প্রকৃতিপাঠেই  জানেন। তাই পরাশরের ‘পৌষমাসে যদি কুয়াশাচ্ছন্ন বৃষ্টিপাত হয় তবে পরবর্তী সপ্তম মাসে মহী বারিপূর্ণ হবে’ কিংবা ‘পৌষমাসের শুক্লপক্ষে যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে সংবৎসর পৃথিবী জলপূর্ণা হবেন’ এসব কথাকে আর অলীক জ্যোতিষচর্চা মনে হয়না। যাঁরা সে শাস্ত্র সহজে জানতেন, তাঁদের পঠনভাষা আর আমরা জানি না- এ কথাই কেবল সত্য হয়ে থাকে।

এই কথা ঠিক যে আজ বাতাস যে পরিমাণ ধোঁয়া ধুলো বাষ্পে বোঝাই তাতে আশ্বিন পৌষ বৈশাখ নির্বিশেষে আকাশ ধূমাবৃত, অধিকাংশ শহর কোন কোন গ্রাম অঞ্চল থেকেও চাঁদের সিত-অসিত, শুক্ল কৃষ্ণপক্ষ ঠাহর হয় না। যা একসময়ে এইদেশের নিত্যচর্চিত জ্ঞান হিসাবে মানুষের সামাজিক জীবনের অঙ্গ ছিল, আজ তার চিহ্নমাত্র থেকে বঞ্চিত আমরা। এমনকি, এই জ্ঞান যে ছিল কোথাও সে কথাও অজানা। কতো প্রাচীন মহামূল্য সম্পদের মতই এই জ্ঞানের চিহ্ন বইটির কথা মনে এল। এর অন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাগ ছিল ফসল তোলার পরেকার সামাজিক ক্রিয়াদির নির্দেশ। সে বলা যেতে পারে পরে আবার কখনও।

আপাতত এই।

এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে

Jol Mati
Advertisment