Advertisment

পার্ক সার্কাস অনেক ব্যবধান ঘুচিয়ে দিচ্ছে

পার্ক সার্কাস এখন শহরের মুক্তমনা মানুষের অবশ্য গন্তব্য একটি ঠিকানা। তাঁরা যাচ্ছেন, দেখছেন, শ্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Park Circus Anti caa

কোনও সংগঠিত দল ছাড়াই গড়ে উঠেছে এই আন্দোলন (ছবি- পার্থ পাল)

কলকাতা কি মনে করতে পারে এমন একটা আন্দোলনের নাম? যেখানে কেবল মেয়েরা, কেবল মেয়েরাই পর্দার আড়াল সরিয়ে ঘরকন্না ফেলে রেখে দেশের ফ্যাসিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ধর্নায় বসেছে। ধর্নায় বসেছে পৌষসংক্রান্তির শীতে খোলা আকাশের নীচে। আট মাসের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা— সবাই সেই ধর্নায় সামিল। কোনও রাজনৈতিক দল নেই, কোনও দল বা সম্প্রদায়ের পতাকা নেই। একটাই পতাকা— জাতীয় পতাকা।

Advertisment

কলকাতায় এহেন, প্রকৃত অর্থেই অভূতপূর্ব ঘটনা নিয়ে শহরের সংবাদ মাধ্যমের আগ্রহ যেন শুরুর দিকে একটু কমই ছিল। একটু কেন, খেয়াল করলে দেখা যাবে অনেকটাই কম ছিল। আগ্রহ যে একেবারে নেই এমনও নয়। কারণ ধর্না শুরু হওয়ার আট দিন পরে যখন সেখানে সেলিব্রিটিদের আনাগোনা শুরু হয়েছে তখন সেটা খবর এবং ছবি হিসেবে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঠাঁই পেয়েছে। তার জন্য পার্ক সার্কাসে ধর্নামঞ্চে গান গাইতে মৌসুমী ভৌমিককে কিংবা ভাষণ দেওয়ার জন্য চাকরিতে ইস্তফা দেওয়া আইএএস গোপীনাথ কান্নান আসতে হয়।

কলকাতার যেসব আঞ্চলিক সংবাদপত্র শাহিনবাগে মুসলিম মেয়েদের প্রায় একই রকম ধর্না আন্দোলন নিয়ে প্রথম পাতায় একধিক খবর এবং রবিবাবের ফিচার করার জন্য দিল্লিতে কলকাতা থেকে রিপোর্টার পাঠায়, সেখানে পার্ক সার্কাসের আন্দোলন মাঝেমধ্যে খবর হচ্ছিল ভিতরের পাতায়।

publive-image অনেক বেড়া ভাঙার ছবি ধরা পড়ছে পার্ক সার্কাসে (ছবি- পার্থ পাল)

একটা বিষয় ঠিক যে, পার্ক সার্কাসে মেয়েদের আন্দোলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেই। কারণ তাঁরা মমতাকে চাইছেন না। কলকাতার সংবাদ মাধ্যমের প্রধান খবরই সেখানে গরহাজির, সেটা খবর হয় কী করে? তাছাড়া এ কালে অনেক সময়েই কলকাতা সংবাদ মাধ্যমে খবর হয় ‘তাঁর’ মর্জিকে মান্যতা দিয়ে। অন্য কারণও কি ছিল? কলকাতার সংবাদমাধ্যমের কাছে দিল্লির শাহিন বাগ নিজেই সেলিব্রিটি, পার্ক সার্কাসকে কি সেই মর্যাদা দেওয়া যাবে! কেন দেওয়া যাবে না? সমাজের যে অংশ কলকাতায় সংবাদ মাধ্যমের কাছে চিরকাল ব্রাত্য থেকেছে তাদের কেন হঠাৎ মাথায় তুলতে হবে, এরকম একটা দোটানাও কি কাজ করছিল?

ইদউলফিতর বা ইদুজ্জোহার মতো মুসলমানের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানগুলোও যথেষ্ট কল্কে পায় না আমাদের খবরের কাগজ বা টিভিতে। মহরমের সঙ্গে যেহেতু যানজট ইত্যাদি অন্যবিধ বিড়ম্বনা জড়িয়ে রয়েছে, সেদিক থেকে ওই উদযাপনে খবরের কিছু উপাদান থেকে যায়। পার্ক সার্কাসে মুসলমান মেয়েদের ধর্না নিয়ে খবর করার ক্ষেত্রে সেই রকম কোনও সমাজ-মনোভঙ্গির শিকার ছিলেন কি সংবাদ মাধ্যমের কর্তারা! এই প্রতিবেদক কলকাতায় বাংলা কাগজে দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন প্রতিবেশী মুসলমান সমাজ নিয়ে সংবাদ-কর্তাদের অনাগ্রহ এবং স্বেচ্ছাবৃত অজ্ঞতার গভীরতা। তার তো একটা প্রভাব থাকেই।

কিন্তু দেরিতে হলেও ব্যাপারটা বদলেছে, বদলাচ্ছে। সেটা শুভ দিক। তবে খটকাটা রয়েই যায়, দূরবর্তী শাহিনবাগ যেমন শুরু থেকেই নজরে, প্রদীপের নিচে আলো জ্বালানো পার্ক সার্কাসের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না কেন?

খবরের মতো হাজারো উপাদান ওই পার্কের জমায়েতে। কলকাতায় এই প্রথম কোনও আন্দোলন দশ দিন পেরিয়ে গেল, যা শুরু হয়েছে একান্ত ভাবেই মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে। পরে অবশ্য বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা এবং ছেলেরাও সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। শুরুটা কেমন ছিল?

আগাম কোনও পরিকল্পনা ছিল না। গত ৭ জানুয়ারি দুপুর থেকে মুখে মুখেই রটে গিয়েছিল পার্ক সার্কাস ময়দানে জমায়েতের কথা। কিছুক্ষণের মধ্যে বিপুল উৎসাহে সেখানে জমা হতে শুরু করেন শহরের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম গৃহবধূরা। কারও হাতে জাতীয় পতাকা, কারও হাতে ব্যানার পোস্টার। মুখে স্লোগান। কেউ বেরিয়ে এসেছেন সদ্য হাঁটতে শেখা সন্তানের হাত ধরে। কারও কোলে শিশু। কেউ ভাল করে চলতে পারেন না--- সঙ্গীর কাঁধে ভর দিয়ে চলে এসেছেন প্রতিবাদ জানাতে। কলেজ স্ট্রিট, তালতলা, তোপসিয়া, তিলজলা, খিদিরপুর, পার্ক সার্কাস --- শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে জমা হতে শুরু করেছিলেন তাঁরা।

পার্ক সার্কাস এখন শহরের মুক্তমনা মানুষের অবশ্য গন্তব্য একটি ঠিকানা। তাঁরা যাচ্ছেন, দেখছেন, শ্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন। এমন একটা আন্দোলনে রাজ্য প্রশাসন সাহ্যয্য তো করছেই না, উলটে বিরোধিতা করছে। মেয়েরা শীতের রাত কাটাচ্ছে পার্ক সার্কাসে খোলা আকাশের নীচে। কারণ সেখানে অস্থায়ী ছাউনি গড়ার অনুমতি দেয়নি পুরসভা। গোটা শহর অপ্রয়োজনীয় আলোয় ভরে রয়েছে, অথচ ধর্নামঞ্চ এবং আশপাশটা অদ্ভুত অন্ধকার। পুরসভা সেটাও করে উঠতে পারেনি। আলো বা ছাউনি দেওয়ার অনুমতিই যেখানে নেই সেখানে যে পুরসভা যে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ শৌচালয় পাঠাবেন না, তা বলাই বাহুল্য। ধর্নামঞ্চের পিছনে পার্ক সার্কাস ময়দানের প্রচীন মসজিদের ইমাম সেখানকার শৌচালয় ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে আরও একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা আজান্তেই ঘটে গেছে। ওই মহিলাদের অনেকেই হয়তো এই প্রথম কোনও মসজিদের অন্দরে প্রবেশ করার সুযোগ পেলেন, নামাজ পড়াতো অনেক দূরের বিষয়। আমাদের দেশে সাধারণ ভাবে মসজিদে ঢোকা নিষেধ মেয়েদের। এই আন্দোলন কেবল মেয়েদের মসজিদে ঢোকার অধিকার দেয়নি, তাঁদের নামাজ পড়ারও অনুমতি দিয়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে মেয়েরা এ অধিকার আদায় করেছেন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে।

আরও একটা জরুরি বিষয়ের দিকে নজর না করলেই নয়। পার্ক সার্কাস বা ‌কসবা অঞ্চলে প্রচুর উর্দুভাষী মানুষ বাস করলেও বাংলাভাষী মুসলমানের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। বাঙালি মুসলমানদের যেহেতু বাঙালি হিন্দুরা নিজেদের পাড়ায় ঠাঁই দেয় না, তাঁদের থাকতে হয় ‘মুসলমান’ হিসেবে বিহারি মুসলমানদের প্রতিবেশী হয়ে। তা সত্ত্বেও তাঁদের সাংস্কৃতিক নৈকট্য না থাকায় মেলামেশা তেমন নেই। বিশেষত বিহারি মুসলমান মহিলারা বাঙালিদের কথাবার্তা, আচার আচরণ, সংস্কৃতি সম্বন্ধে খুবই অজ্ঞ। এই বেড়াটা ভেঙে যাচ্ছে ধর্নায় দীর্ঘ সময় পাশাপাশি বসে থাকতে থাকতে।

অধুনা পার্ক সার্কাস অঞ্চলের বাসিন্দা বর্ধমানের মঙ্গলকোটের হাবিবের পর্যবেক্ষণ, ‘ওরা সারা দিন ধরে বাংলা কথা শুনতে শুনতে, বাঙালি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমাদের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে। না-জানার বেড়াটা ভেঙে যাচ্ছে।’ হাবিবের মতে, এতে দু’পক্ষেরই লাভ। একটা আন্দোলন, কত রকমের বেড়া ভাঙতে ভাঙতে এগোয়। সেটাও দেখার।

Park Circus পার্ক সার্কাসে পৌষ সংক্রান্তির বিকেলে ধর্নাকারী মহিলাদের পিঠে খাওয়ানোর আয়োজন করে সহমন নামের একটি সংগঠন

অজানা আর অচেনার বেড়া তো ভাঙবেই, কারণ শহরের কিছু ছেলেমেয়ে পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে বুধবার ধর্নায় বসা মেয়েদের পিঠে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কলকাতায় দীর্ঘদিন বাস করেও তাঁদের বেশিরভাগই পিঠের স্বাদ জানতেন না, জানতেন না পৌষপার্বণ নামে কোনও উদযাপনের কথা। পড়শিকে জানা চেনার এই প্রাপ্তি তো আন্দোলনে আরও একটা বড়ো প্রাপ্তি।

যেখানে ধর্না চলছে, ওই মাঠেই বসে সংখ্যালঘুদের জন্য ‘সরকারি’ মিলন মেলা। মেলা হয়তো সরিয়ে ময়দানেরও অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু মেয়েদের এই আন্দোলনের শেষ কোথায়? আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, সেটা নিয়ে এখনও কিছু ভাবছেন না তাঁরা। কিন্তু মাথার ওপর তো একটা ছাউনি লাগবেই। সেক্ষেত্রে জাতীয় পতাকা যদি সমান্তরাল করে টাঙিয়ে দেওয়া যায় ধর্ণায় বসা মেয়েদের মাথার ওপরে? তাহলে সেটা তো ছাউনিও হল। জাতীয় পতাকার আশ্রয়ে তাঁরা করবেন রাত্রিযাপন। জানাবেন তাঁদের প্রতিবাদ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ফ্যসিস্ট হুমকির বিরুদ্ধে।

মাঘ মাসের শীত, প্রশাসনের বিরোধিতা, শাসকের ধমকানি বা পুলিশের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ কোনও ভয়ই ছুঁতে পারছে না তাঁদের।

(মিলন দত্ত বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

Citizenship Amendment Act
Advertisment