আমাজন জ্বলছে। আমরা যখন কাশ্মীরে জাতীয় আইন প্রতিষ্ঠা করছি, কাট মানি নিয়ে শোরগোল করছি, তখন আমাজনের সুপ্রাচীন অরণ্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ দাউদাউ করে জ্বলছে। তাতে কী? আমাজনের জঙ্গল থেকে আমরা কী পাই? পুড়ে গেলে কী পাব না? অনেকগুলো জিনিস পাব না আসলে। যেমন ধরুন অক্সিজেন। পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের কুড়ি শতাংশ সম্ভবত ওখান থেকে আসে। না পাওয়ার তালিকাটা অবশ্য অক্সিজেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বৃষ্টি, শস্য সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে পৃথিবী জুড়ে আমাজনেরা ক্রমশ শুকিয়ে যাবার ফলে, পুড়ে যাবার ফলে।
তা না হয় হল, কিন্তু স্বাস্থ্য বিষয়ক কলামে আমাজনের জঙ্গল নিয়ে কান্নাকাটি করা হচ্ছে কেন? করা হচ্ছে, কারণ পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইস্যু। পৃথিবী জুড়ে, বিশেষত পশ্চিমের উন্নত দেশগুলিতে, কর্তব্যসচেতন চিকিৎসকেরা এখন পরিবেশ নিয়ে রীতিমত সোচ্চার। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত জার্নালগুলোয় পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। কেন? কারণ চিকিৎসকদের কাজ মানুষ বাঁচানো এবং বর্তমান গতিতে পরিবেশ ধ্বংস হতে থাকলে কয়েক দশকের মধ্যে সব মানুষ মরে যাবে। অগত্যা তাদের বাঁচানোর তাগিদে চিকিৎসকদের চেঁচামেচি করতেই হবে।
অবশ্য পরিবেশ নিয়ে চিকিৎসকদের কথা বলার এই উদ্যোগ নিছক স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা বা জীবনশৈলী শিক্ষার মতো নিরীহ মৃদুভাষী বাক্যালাপে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং তা চিৎকৃত হবার সম্ভাবনা বেশি এবং যত দিন যাবে, তা ক্রমশ রাজনৈতিক প্রতিরোধ ও সংঘাতের আকার নেবে। এরকম হওয়া ছাড়া উপায় নেই, কারণ অরণ্য বা পরিবেশ এমনি এমনি ধ্বংস হচ্ছে না, ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রকৃতির এই অসুখ জ্বরজ্বালা বা ডায়াবেটিসের মতো প্রাকৃতিক নয়, বরং আঘাতের মতো মনুষ্যকৃত, অপুষ্টির মতো একটি রাজনৈতিক সমস্যা। আমাজন অরণ্যের উদাহরণটাই ধরা যাক। মনে করা হচ্ছে যে এই আগুন সম্ভবত প্রাকৃতিক নয়। ব্রাজিলের বর্তমান সরকার বিভিন্ন বাণিজ্যগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে আমাজনের জঙ্গল কেটে সেখানে শিল্পায়ন করতে চাইছিল। এই কাজ করার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাধা ছিল, মূলত আমাজন রক্ষাকামী পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে। জঙ্গলটা আগুনে পুড়ে গেলে সবচেয়ে সহজে এই বাধা পেরোনো যায়। তখন পুড়ে যাওয়া জঙ্গল সাফ করে শিল্প-বাণিজ্য করা যাবে। এই কারণে সম্ভবত আগুন লাগানো হয়েছে। এই আগুনের ইতিবৃত্ত নিয়ে সংশয় থাকেও, তবে এ নিয়ে সংশয় নেই এর আগে থেকেই প্রতিদিন দেড়খানা ফুটবল মাঠের সমান অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছিল আমাজনের তটভূমি থেকে। বুলেট ট্রেন চালু করার জন্য ভারতে যে বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি ধ্বংস করার সরকারি পরিকল্পনা হয়েছে, তাও সংশয়ের ঊর্ধ্বে। সারা পৃথিবী জুড়েই এই কাহিনি। এই প্রবণতা কম হবার সম্ভাবনা কম, কারণ অর্থ-বিত্ত যখন মানুষের স্বার্থবোধের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে, তখন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা বেঁচে থাকার উপযুক্ত গ্রহ রেখে যাবার প্রয়োজনটুকুও অনুভব করা কঠিন হয়। এই মুহূর্তে আরও কিছু টাকা কামিয়ে ফেলতে পারাই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। অতএব সংঘাত অনিবার্য, কারণ তার একমাত্র বিকল্প হল প্রজাতির নিশ্চিত মৃত্যুকে বিনা বাধায় মেনে নেওয়া।
সংঘাত প্রয়োজনীয় যদি হয়ও, তবে তার জন্য পেশাদার রাজনীতিবিদেরা আছেন, পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আছেন। কেন চিকিৎসকেরা স্টেথোস্কোপ ফেলে, ছুরি-কাঁচি ইঞ্জেকশন ফেলে চেঁচামেচি করতে পথে নামবেন এসব সমস্যাতে? নামবেন কারণ তাছাড়া দুনিয়ার সব রোগীকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই। পরিবেশ সংক্রান্ত ইস্যুতে চিকিৎসকদের তরফে সচেতনতা ও সক্রিয়তা নতুন নয়। আয়ুর্বেদে সুস্থ জীবনের জন্য প্রকৃতির সঙ্গে শরীরের সমন্বয় রক্ষার কথা বলা আছে। সুপ্রাচীন গ্রীসে হিপোক্রেটাস চিকিৎসকদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন ঋতু, বায়ুর গতি ও অভিমুখ, মাটি ও জলের চরিত্র সহ পরিবেশের সব দিকগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: আয়ুষ চিকিৎসক, অ্যালোপ্যাথি ও দেশ
লন্ডনের কলেরা মহামারী ঠেকাতে গিয়ে চিকিৎসক আবিষ্কার করলেন জলে দূষণ ঘটছে এবং তা রোধ করাই এই মহামারী রোখার প্রধান উপায়। এভাবে একের পর এক সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে পরিবেশের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তীকালে দেখা গেছে স্নায়ু, মস্তিষ্ক, রক্তের বিভিন্ন রোগ হয় শিসা (লেড) ঘটিত দূষণের ফলে। ভারতের মতো দেশে চর্মরোগ, এমনকি চামড়ার ক্যান্সার কিছু এলাকায় বাড়তে থাকায় গবেষণা করে দেখা গেল জলে আর্সেনিক দূষণের ফলে এই রোগের উৎপত্তি। ভৌমজলের অতি ব্যবহারের ফলে ভিন্ন স্তর থেকে আর্সেনিক এসে পানীয় জলে মিশছে। অন্যান্য বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবে বিভিন্ন দূষকের ভূমিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সদর্থক পরিবর্তন আনার জন্য সরকারকে চাপ দিতে চিকিৎসকদের একক বা সংগঠিত ভাবে লড়তে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অন্য পেশার মানুষদের পাশে ডেকে নিতে হয়েছে, যার প্রয়োজন ক্রমশ বাড়ছে।
চিকিৎসকদের তরফে এজাতীয় প্রচার ও প্রতিরোধ সর্বদা সহজ হয়নি, বিশেষত যখন ক্ষতিকর রাসায়নিকগুলির সঙ্গে কোনো শক্তিশালী বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত থেকেছে। একটা সহজ উদাহরণ হল তামাক। সিগারেট, চুরুট বা অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য বিভিন্নরকম ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফুসফুসের জটিল রোগ ইত্যাদির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সেই বিষয়ে প্রতীতি হবার পর থেকেই চিকিৎসকদের তরফ থেকে এই বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি তামাকু নিয়ন্ত্রণের জন্য শাসকদের উপর চাপ তৈরি করা চলছে। আমেরিকায় এই সংক্রান্ত গত এক শতকের ইতিহাস নজর করলে স্পষ্ট দেখা যাবে চিকিৎসকমহল বনাম বিশাল তামাকু উৎপাদক বাণিজ্যগোষ্ঠীর দড়ি টানাটানি লড়াই। একবার চিকিৎসকেরা সরকারকে দিয়ে তামাকু নিয়ন্ত্রণে কোনো একটি পদক্ষেপ করাতে সমর্থ হন তো কিছুদিনের মধ্যেই শিল্পমহল জোর খাটিয়ে সেই প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করে দেন। শিল্প-বাণিজ্য মহল থেকে এরকম উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক প্রয়াস, সরকারি অলিন্দে টাকা ছড়ানো থেকে শুরু করে মিথ্যা ও অর্ধসত্য ভিত্তিক অপবিজ্ঞান প্রচার… সবকিছু চলতে থাকে। এই বৃহৎ পুঁজির বাণিজ্যমহল আর্থিক দিক থেকে এতটাই এগিয়ে যে পূর্ণ উদ্যম সত্ত্বেও কেবলমাত্র চিকিৎসক বা শিক্ষকদের পক্ষে এঁদের সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন। এই প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের বড় অংশের অংশগ্রহণ প্রয়োজন, অথচ বাজারের দখল যাঁদের হাতে, তাঁরা এমনভাবে প্রচার চালান যে অনেক মানুষ তার দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হন।
বস্তুত চিকিৎসকদের সংগ্রামের ক্ষেত্র বহুদিন ধরেই বিস্তৃত হচ্ছে। নিজের ক্লিনিক বা হাসপাতালের বাইরে বস্তিতে, গ্রামে, কারখানায় হানা দিয়ে কাজ করার গুরুত্ব ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হবার পরেই 'পাব্লিক হেলথ' বা 'কম্যুনিটি মেডিসিন'-এর মতো বিষয় ও বিভাগ চালু হয়, যা আজ এমবিবিএস পাঠক্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: গ্রামীণ চিকিৎসক
না, কাজ মানে শুধু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ওষুধ দেওয়া নয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং তার ভূমিকা আবিষ্কার করে তার সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়াও পড়ে। বালি খাদান, কয়লা খাদান, অ্যাসবেসটস কারখানায় কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের ফুসফুসের যে ক্ষতি হয় বা অত্যুচ্চ শব্দের যন্ত্রের পাশে বহুক্ষণ কাজ করায় আসে যে বধিরতা, তার জন্য শ্রমিকদের সুরক্ষা ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে মালিকদের বাধ্য করার মতো রাজনৈতিক লড়াইও এর অংশ।
বর্তমানে এই লড়াইটা আরও বড় মাপের হতে চলেছে। পৃথিবী স্বয়ং বিপন্ন এখন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যে 'Planetary Health' নামক বিষয়ের উদ্ভব হয়েছে। এই বিষয়ে কাজ করার জন্য সংগঠন গড়ে উঠেছে। এভাবে বিশ্বের স্বাস্থ্য বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে না পড়লে 'বিশ্ব-স্বাস্থ্য' (পৃথিবীর সব মানুষের স্বাস্থ্য) বাঁচানো যাবে না, তা পরিষ্কার। অথচ এই কাজটি করতে গেলে শক্তিমানদের স্বার্থে আঘাত লাগবেই। দূষণের বেশিরভাগ অংশ শিল্পজনিত, বড় কৃষি উৎপাদন বা পশু খামারের অবদান। এর প্রতিটির বাণিজ্যিক মূল্য অপরিসীম। মুনাফার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মস্তিষ্ক বরং মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে রাজি, কিন্তু আর্থিক লাভ কমাতে রাজি নয়। তাই দূষণ কমানোর যাবতীয় উদ্যোগ রুখে দেবার চেষ্টা চলছে নানা যুক্তিতে। পরিবেশ সংক্রান্ত গবেষণা ও ভবিষ্যদ্বাণীগুলিকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো সবচেয়ে শক্তিশালী ও মুনাফা-বান্ধব রাষ্ট্রনায়কেরা বিশ্বের উষ্ণায়ন জাতীয় সমস্যাগুলিকে মিথ বলে উড়িয়ে দিয়ে আলাস্কা, আমাজনের অরণ্য ইত্যাদিকে ধ্বংস করে আরও কিছু টাকা কামিয়ে নেবার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন।
এদিকে অর্থনীতির অবস্থাও খারাপ। বাজার যত বেশি চাপে পড়বে, তত বেশি মরিয়া হয়ে উঠবে। অদূর ভবিষ্যতে মানুষ বনাম মুনাফার লড়াই কঠিনতর হতে চলেছে। তার ফলাফলের ওপরেই নির্ভর করবে মানুষ প্রজাতির বাঁচা-মরা। এই রোগ সারানোর জন্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের লড়তে হবে অবশ্যই, কিন্তু লড়তে হবে সাধারণ মানুষকেও। বস্তুত কোনো রোগই চিকিৎসক একা সারিয়ে দিতে পারেন না। চিকিৎসক সাহায্য করেন, সেরে ওঠেন রোগী নিজেই। মানুষের চেষ্টা অতি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের এবং নিজের বাস-গ্রহের মৃত্যু ঠেকাতে সবাইকে সচেতনভাবে সচেষ্ট হতে হবে। এখনই।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক। মতামত ব্যক্তিগত)