Advertisment

নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর ঘিরে প্রশ্ন

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শেখ হাসিনা আজ নিজে যতটা উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে কম উদ্বিগ্ন নন নরেন্দ্র মোদী-ও।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Bangladesh

প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও মোদী। ফাইল ছবি

সামরিক শাসনকে বিদায় জানিয়ে বাংলাদেশে সেই কবে থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজ এত বছর পর বাংলাদেশের ইতিহাসে কি আবার ধর্মান্ধতার পালা শুরু হবে?

Advertisment

৯১ সালে শেখ হাসিনাকে খালেদা পরাস্ত করেন বিপন্ন ইসলাম আওয়াজ তুলে। এর পাশাপাশি তার আর একটা অভিযোগ ছিল হাসিনা ভারতের এজেন্ট। ভোট সেবার ছড়া কাটা হয়েছিল, 'হাছিনা রে হাছিনা। তোর কথায় নাচিনা। তোর বাপের কথায় নাইচ্যা দ‍্যাশ দিছি বেইচ্যা।' তখন বলা হয়েছিল ভারতের কাছে দাসত্ব স্বীকার ক‍রায় বাংলাদেশ হয়ে গেছে যেন তলা বিহীন ঝুড়ি
এরপর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চালচিত্র, বদলে দিয়েছেন। আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তথা জিডিপির সূচকের প্রশংসা হচ্ছে বিশ্ব দরবারে। কিন্তু এহেন অনুকূল পরিস্থিতিতে যখন বিএনপি নামক দলটি দুর্বল থেকে দুর্বলতর‌, তখন হাসিনার বিরুদ্ধে মৌলবাদী শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে আবার উগ্ৰ ইসলামের শক্তি এত মাথা চাড়া দিচ্ছে কেন?

অশ্লীলতার দায় বড় দায়, বিশেষত এ রাজ্যে

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি ঢাকা সফরে যাচ্ছেন। ১৭ মার্চ তাঁর যাওয়ার কথা। 'বঙ্গবন্ধু' শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছেন তিনি। এই সফরের আগে হঠাৎই ঢাকায় বেশ কিছু মৌলবাদী সংগঠন নড়েচড়ে বসেছে। জামাত গোষ্ঠী তো বটেই, এবার হেফাজতে ইসলাম, সঙ্গে চর মোনাইয়ের পিরও হুঙ্কার ছেড়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় 'বঙ্গবন্ধুর'-র নামাঙ্কিত বিমানবন্দরে অবতরণ করলেই নাকি তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাবেন, ঢাকা অচল হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে ফেরত আসতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফর এ জন্য অনিশ্চয়তায়- এমন খবরও প্রকাশিত। প্রধানমন্ত্রী‌ কিন্তু এই সফর বাতিল করার কথা এক মুহূর্তের জন্য ভাবেনি। তবে বাংলাদেশে যেভাবে ইসলামিকরণের চেষ্টা চলছে তা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। প্রায় প্রত‍্যেক দিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কিত রির্পোট আসছে। তিনি ইউরোপ সফর বাতিল করলেন করোনার জন্য। কিন্তু ঢাকার নয়।

তবে ঢাকায় যেভাবে মৌলবাদী সক্রিয় হয়ে উঠে, তার জন্য ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বিজেপির অতি সক্রিয়তা নিশ্চয়ই একটি কারণ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ভারতে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণকে যতই তীব্র করুক না কেন, বা তার জন্য বিজেপির রাজনৈতিক লাভ এই দেশে যাই হোক না কেন, বাংলাদেশে কিন্তু এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু। সে দেশে যদি কোনও হিন্দু মূর্তি ভেঙে যায়, তাহলে এ দেশে সংঘ পরিবারে প্রতিক্রিয়া হয়। হিন্দু শরণার্থী ব্যাপারেও অধুনা বিজেপি সহানুভূতি ব্যক্ত করেছে। ফলে এ দেশে, দিল্লির দাঙ্গায়, যখন বহু মুসলমান নিহত,তখন ঢাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে তার প্রতিক্রিয়া হবে, তাতে অস্বাভাবিকতা কোথায়?

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই থেকেই সেখানে দুটি সত্তার সমন্বয় আছে। একটি বাঙালি সত্তা, অন্যটি ইসলামিক সত্তা। আসলে, বাংলাদেশের ইসলামিক সত্তাকে অবজ্ঞা করাও।তো অনুচিত। শেখ মুজিবুর রহমানের সময়েই তো ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু মুজিবুর এবং পরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ক্রমশ ধর্মনিরপেক্ষতার পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। শেখ হাসিনার সময়েই ঢাকার শীর্ষ আদালতের ধর্ম নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত রায় এবং হাসিনা সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু সাম্প্রতিক ভারতের ঘটনাবলি শেখ হাসিনাকেই বেশ অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এমনিতেই খালেদার দল 'বিএনপি' এবং তৎসঙ্গী জামাত চিরকালই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে যে, তিনি 'ভারতের এজেন্ট'। ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতি তাঁকে আরও বিপদে ফেলে দিল।

দিল্লির অন্ধকার: আমাদের শাসকরা নির্মমতা, বিভাজন, ভয় আর হিংসা ভরা রাষ্ট্র চান

চট্টগ্ৰামের হাটহাজারি মাদ্রাসার মৌলবি আল্লামা শফির আনুরাগীরা হেফাজতে ইসলামি। এরা জামায়াতে ইসলামির চেয়েও কড়া মৌলবাদী। বাংলাদেশে শরিয়তি ব‍্যবস্থা এদের কর্মসূচি। শফি বলেন, মেয়েদের ক্লাস থ্রি-র বেশি পড়ানো চলবে না। তাদের বাড়ির বাইরে বেরনো চলবে না। শফির বয়স সম্ভবত ৯২। মহাসচিব বাবু গরি হেফাজতের দু নম্বর। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসাবে আমার মনে হচ্ছে, ভারতের এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে যতই মৌলবাদীরা সক্রিয় হচ্ছেন, যতই সেখানে ইসলামিক মৌলবাদীরা ঢাকাকে 'কট্টরবাদী' রাষ্ট্রবাদের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন, ততই হাসিনাকেও পাল্টা কৌশল নিতে হচ্ছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রণকৌশল কৌটিল‍্য নীতি। হেফাজতে বনাম জামায়াতের রাজনীতিতে সেই কৌশল আছে কি? গত কয়েক দিন ধরে এই হিংটিংছট প্রশ্নটাই আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি এই নিবন্ধ লিখছি মানেই আমার কথা শেষ কথা- এমন নয়। বরং এ হল মুক্ত চিন্তার খোলামেলা মঞ্চ। যদি ঢাকা বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন মত থাকে, তাঁরা এ লেখা পড়ে জানাবেন।

পরিস্থিতি সামলাতে বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা গেলেন। ঢাকার বিদ্বৎসমাজ তাঁকে ভালবাসেন। কারণ, আমেরিকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হওয়ার আগে তিনি ঢাকায় হাই কমিশনার ছিলেন। তারও আগে তিনি দিল্লিতে সাউথ ব্লকে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ছিলেন। দার্জিলিংয়ের এই মানুষটিকে আমি দেখছি ভালবেসে বাংলাদেশের বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে। তিনি ফিরে এসেও কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে যা রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে এটাই বলা হয়েছে ঢাকায় 'সুপবন বহিতেছে' এমন নয়। ১৭ র্মাচ, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে, প্রধানমন্ত্রী যাবেন। তারপর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখোপাধ্যায় যাঁকে ঢাকার মানুষ অভিভাবক জ্ঞান করেন, তিনি যাবেন। সুস্থ থাকলে সোনিয়া গান্ধীও যাবেন ২৬ এপ্রিল। আবার এ বছর মুজিবুরের জন্মশতবর্ষ, তো আগামী বছর পালিত হবে। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর।

এত উৎসবের মধ্যে সম্প্রতি ঢাকা শহরের পুর নির্বাচনও হয়ে গেল। সেখানে মাত্র শতকরা ২৩ ভাগ ভোট কেন পড়ল, তা নিয়ে ঢাকার সংবাদমাধ‍্যমে প্রশ্ন উঠেছে। মানুষ কি তবে কিঞ্চিৎ অনিহার মধ্যে ? ভারত সরকারের জন্য না হলেও বিজেপির রাজনীতিও কি কোনও প্রভাব ফেলেছে?

এই অবস্থায় যদি হাসিনা সরকার হেফাজতেপন্থীদের প্রতি নরম মনোভাব নেন, তাতে কিন্তু ভারতের বিদেশ সচিবও প্রমাদ গুনবেন। এতে অবাক হওয়ার কী আছে? ২০১৮-'১৯ সালের পয়লা জানুয়ারি যে- সিলেবাস ছাত্রছাত্রীদের জন্য তৈরী হয়, তা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাদ না গেলেও তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় (বঙ্কিম ভ্রাতা) কেন বাদ গেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার খোদ নজরুলের কবিতায় 'সজীব করিব মহাশশ্মান' -কে বদলে 'গেরস্থান' করে দেওয়া নিয়েও বির্তক হয়। এটা হয়, হেফাজতের সুপারিশে। আর এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, দিল্লির দাঙ্গার পর হেফাজতে-র সুপারিশ সমস্ত সরকারি স্কুলে নমাজ পড়া বাধ‍্যতামূলক করতে হবে। খাবিজি মাদ্রাসাগুলোর গুরুত্ব বাড়ছে। তারা তো বিজ্ঞান-অঙ্ক পর্যন্ত পড়ানোর বিরুদ্ধে। এখন আধুনিক চিকিৎসার বদলে জলপড়া দিয়ে চিকিৎসা ব‌্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাইছে।

আধুনিকতার বদলে এই পশ্চাৎমুখী যাত্রার সঙ্গে যদি শেখ হাসিনাকেও আপস করতে হয়, তবে খুব দুঃখ হবে। বিজেপির তা নিয়ে উদ্বেগ থাক বা না থাক, প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশ মন্ত্রকের আছে। কারণ, বাংলাদেশ আজ ভারতের জন্য বড়-ই গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ নিয়ে চিন বিশেষ উৎসাহী। শুধু পদ্মা সেতু নয়, বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রকল্প চিন করছে। করোনা ভাইরাসের জন্য কিছু প্রকল্প বিলম্বিত হবে কি না, তা নিয়ে এই মুহূর্তে ঢাকাও চিন্তিত। লাখ লাখ কোটি টাকার প্রকল্প। যা ভারতের পক্ষে সম্ভবই নয়।

শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম নেত্রী। খালেদা জেলে। বিএনপি-র অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের মতো। কিন্তু হাসিনা তো চিরদিন ক্ষমতাসীন থাকবেন না প্রকৃতির নিয়মে। হাসিনার পর কে, তা নিয়েও কূটনীতির বৃত্তে নানা নৈশভোজে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। পুত্র-কন্যা এখনই না এলে নিকটাত্মীয়রা দায়িত্ব নেবেন কি না,তা নিয়েও আওয়ামি লিগের বহু শীর্ষ নেতা প্রয়াত। এই দলটার অবস্থাও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতো। শতছিন্ন দামি কার্পেটের মতো।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শেখ হাসিনা আজ নিজে যতটা উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে কম উদ্বিগ্ন নন নরেন্দ্র মোদী-ও। আমরা সবাই স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষে এক শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে দেখতে চাই।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Bangladesh
Advertisment