Advertisment

হেফাজতে আবার একটি মৃত্যু

আইন মোতাবেক, সুপ্রিম কোর্ট এবং মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশিকা মেনে পক্ষপাতহীন তদন্ত চলছে কিনা তা দেখা উচিত ছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের। কিন্তু সেই সমস্ত সংস্থা সরকারের হিজ মাস্টার্স ভয়েস-এ রূপান্তরিত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Custodial Death, Sinthi Death

অলংকরণ- অভিজিত বিশ্বাস

কয়েক বছরে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ষাটের উপরে। প্রথমদিকে শোরগোল ওঠে। মিডিয়া কভারেজ পায় হেফাজতে হিংসা ও হ্ত্যার ঘটনা, মানবাধিকার সংগঠন সহ নানা রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদও নজরে আসে। তারপর? অন্য ঘটনাি চাপে হারিয়ে যায় "উর্দিপরা সমাজবিরোধীদের" অত্যাচারের কথা।

Advertisment

সংবাদে প্রকাশ "চুরি করা সামগ্রী" কেনার অভিযোগে প্রৌঢ় রাজকুমার সাউকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। সিঁথি থানার পুলিশের অত্যাচারে তিনি আজ নিহত। আইনরক্ষকদের প্রাথমিক কাজ, আইনের শাসনকে রক্ষা করা, আইনের নিয়মবিধি মেনে তদন্ত করা। কেন এ কথা বলা হয়, তা বারে বারে মানবাধিকার আন্দোলন, সুপ্রিম কোর্ট এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ব্যাখ্যা করেছে, এমনকী স্পষ্ট নির্দেশিকা ও আচরণবিধি জারি করা হয়েছে। "যতক্ষণ না পর্যন্ত অপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অভিযুক্ত বন্দি নির্দোষ" - আন্তর্জাতিক সর্বজনীন ন্যায়বিতারের মূল স্তম্ভ। কিন্তু তদন্তের নামে পুলিশ তার নিজের হেফাজতে ধৃতকে নিয়ে গিয়ে যাবতীয় "থার্ড ডিগ্রি" দেয়; বন্দি মারা যান, যেমন গিয়েছেন রাজকুমার সাউ, যেমন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বড়তলা থানার লক আপে মারা গিয়েছেন ভূষণ দেশমুখ।

বাংলা ভাষা ও ভাবনায় ইংরেজি আধিপত্য

আন্তর্জাতিক স্তরে তো বটেই, এমনকী ভারতীয় আইনেও হেফাজতে হিংসা নিষিদ্ধ। কিন্তু তবু পুলিশের নির্যাতন করাটাই দস্তুর। সুপ্রিম কোর্ট একাধিক মামলার রায় দান কালে বলেছেন, হেফাজতে হিংসা সভ্য সমাজের সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ, বলেছেন ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা, বলপূর্বক নিখোঁজ ও হত্যা, হেফাজতে হিংসা ও হত্যা এই তিনটেই গণতান্ত্রিক সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করা উচিত। এবং তার জন্য চাই সরকারে আসীন রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা।

পরিবর্তে আমরা কী দেখছি? ২০১১ সালের পূর্ববর্তী সরকারের আমলে আমরা দেখেছি, দোষী পুলিশকে কোনও সাজা দেওয়া হত না বা নামমাত্র সাজা দেওয়া হত- যেমন একমাসের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ। বদলি, সার্ভিস বুকে উল্লেখ। ব্যাস! জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে সাড়া জাগানো ঘটনায়- লালবাজার লকআপে ইদ্রিশ আলির হত্যা। এ ক্ষেত্রে দোষী সাত পুলিশ অফিসারের কোনও শাস্তি হয়নি, সমরেন্দ্রনাথ দেব কমিশনের বিচারবিভাগীয় রিপোর্ট বের হবার পরেও।

"মা-মাটি-মানুষের" সরকারের আমলে জনবিক্ষোভ সামাল দেবার জন্য নতুন কৌশল শুরু হয়েছে, অভিযুক্তকে পুলিশদের ক্লোজ (দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি) করে দেওয়া। তারপর? বিক্ষোভ থিতিয়ে গেলে, উত্তেজনা কমে গেলে, দোষী পুলিশদের আড়াল করার যাবতীয় নথি তৈরি হয়ে গেলে, পুলিশের বানানো ভাষ্যটাই আদালতে স্বীকৃতি পাবে, হেফাজতে বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, পুলিশ তখপরতার সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বন্দি মারা যান। এই বয়ানে পুলিশের কর্তব্যে গাফিলতি দেখা যায় না। ক্লোজ পুলিশ পুনরায় আনক্লোজ হয়ে গেলেন। অত্যাচার, হত্যা করেও অব্যাহতি পাওয়া (Culture of Impunity)-র সংস্কৃতির কুঐতিহ্য আজও চলছে। শাসকের রং বদলালেও সংস্কৃতি বদলায়নি।

পাশাপাশি কিন্তু মানবাধিকারের ধারণা শক্তিশালী হয়েছে। আইনের নানা দিক, সামান্য হলেও পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু তা মানা হয় না। যেমন, এই সিঁথির ঘটনাটাই ধরুন না। ২০০৫ সালের সংশোধনী অনুসারে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হলে বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট সুরতহাল করবেন। এক্ষেত্রে তা হয়নি। দুই, ময়না তদন্তের সময়ে মৃতের নিকটাত্মীয়-পরিজনদের উপস্থিত করাতে হবে, তাঁদের সামনেই ময়নাতদন্ত হবার কথা। হয়নি। তিন, সমস্ত ময়নাতদন্ত পর্বটির ভিডিও তুলে রাখতে হবে এলং অ-সম্পাদিতভাবে ভিডিওটিই "সিল" করে দিতে হবে। আইনমাফিক তা করা হয়েছে কিনা সে কথা জানা যায়নি এখনও। চার, সাধারণভাবে, হেফাজতে হিংসা ও হত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায় না। সিঁথির ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী আছেন। তাঁর বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারি বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বয়ান নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে।  স্বাভাবিক। কারণ, অভিযুক্ত পুলিশের সহকর্মীদের হেফাজতে বা তত্ত্বাবধানে আসুরা বিবি কয়েকদিন ছিলেন। ফলে তিনি মিথ্যা বয়ান নথিভুক্ত করাতে পারেন এমন সন্দেহের কথা উঠেছে। আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত সাক্ষী সুরক্ষার আইন নেই। সুপ্রিম কোর্ট ২০০৩ সালের এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক সুপারিশ আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারগুলি গ্রহণ করেনি। ১৯৮ তম প্রতিবেজনের উল্লিখিত আইন কমিশনের উপর ধুলো জমছে। পুলিশ যেহেতু অভিযুক্ত এবং যেহেতু পুলিশ সহকর্মীদের মধ্যে "ভ্রাতৃত্বের বন্ধন" কাজ করে, সেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী আসুরা বিবির জীবন এই মুহূর্তে সবচেয়ে সংকটে। মানবাধিকার আন্দোলন দাবি করে তাঁকে বিচারবিভাগীয় তত্ত্বাবধানে নিরাপদে রাখার এবং তাঁর চাপমুক্ত অবস্থাকে সুনিশ্চিত করার।

নশ্বর স্মৃতি, অবিনশ্বর রাজনীতি

শঙ্কিত করে আধা-বিচারবিভাগীয় ক্ষমতার অধিকারী রাজ্য মহিলা কমিশনের বা রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের হিরণ্ময় নীরবতা। তাদের হস্তক্ষেপ করার আইনি ক্ষমতা রয়েছে, কোনও আবেদন জমা না পড়লেও। আসুরা বিবির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য তাদের উদ্যোগ কাঙ্ক্ষিত ছিল। আইন মোতাবেক, সুপ্রিম কোর্ট এবং মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশিকা মেনে পক্ষপাতহীন তদন্ত চলছে কিনা তা দেখা উচিত ছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের। কিন্তু সেই সমস্ত সংস্থা সরকারের হিজ মাস্টার্স ভয়েস-এ রূপান্তরিত।

স্বীকার্য, সংস্থাগুলির ক্ষমতা কম, তারা "নখদন্তহীন" বাঘ। বিজেপি সরকার যৎসামান্য ক্ষমতাকেও আরও সংকুচিত করে দিয়েছে। তবু সংস্থাগুলি সামান্য নড়া-চড়া করেও জানান দিতে পারত যে তারা নেহাৎ সাইনবোর্ড হয়ে টিকে নেই, বেঁচে রয়েছে।

নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে তৈরি হওয়া এই সমস্ত সংস্থার করুণ হাল-হকিকৎ দেখে ২০০৬ সালের বিখ্যাত প্রকাশ সিং মামলায় সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, সমস্ত রাজ্যে (কেন্দ্রশাসিত রাজ্য সহ) বাধ্যতামূলক ভাবে পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে হবে, প্রধান বিচারপতির সুপারিশ করা প্যানেল থেকে একজন বিচারপতিকে (হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত) সেই কর্তৃপক্ষের শীর্ষে রাখতে হবে। রাজ্য, জেলা স্তর পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে এই কর্তৃপক্ষ গড়ে উঠবে। যাদের অন্যতম কাজ হবে পুলিশের গুরুতর বেআইনি কাজের তদন্ত করা। তার মধ্যে রয়েছে হেফাজতে হত্যাও।

পশ্চিমবাংলায় এই ধরনের সংস্থা গড়ে উঠেছিল ২০১০ সালে অন্য কায়দায়, অন্য রূপে। তারও কোনও অস্তিত্ব নেই আজ। মানবাধিকার আন্দোলনের দাবি-দাওয়ার তালিকাতেও তা আজ অনুপস্থিত। সরকার যেন ওয়াক-ওভার পেয়ে গিয়েছে।

বিপরীতে দেখছি, হেফাজতে হত্যা ঘিরে রাজনৈতিক নাটকের পুনরাবৃত্তি। এক সময়ে দেখেছি, সত্তর দশকের যাবতীয় সন্ত্রাসের, হত্যালীলার বিচার হবে, ইত্যাদি প্রতিশ্রুতিভঙ্গের ইতিহাস। দেখেছি ভিখারী পাশোয়ানকে পুলিশ কর্তৃক নিখোঁজ করে দেবার মামলায় মানবাধিকার সংগঠনকে সরিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব যার ইতিহাস কিছু তথ্য বিভ্রাট সহ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে (দ্রষ্টব্য- শ্যামলেন্দু বিশ্বাসের বই)। এই বইয়ে মামলাটির হারিয়ে যাবার কাহিনিও রয়েছে। একইভাবে দেখেছি রিজওয়ানুরের মর্মন্তুদ মৃত্যু (২০০৭, সেপ্টেম্বর)। এ মামলায় আমি ও নজরুল রিজের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রেও সেই একই রাজনৈতিক দল শাসক দলে রূপান্তরিত হবার পর সব উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে "ইনসাফ" পাবার ব্যাপারে।

সিঁথির ঘটনায় পথে নেমেছে বাস্তবের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। তাদের প্রতিবাদ আরও ভণ্ডামিতে ভরা। উত্তর প্রদেশ সহ সমস্ত দেশে তারা রাষ্ট্রীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে, ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের গুলি করে মারতে বলছে, প্রতিবাদী নারীদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে, তারাই এখানে বেআইনি হেফাজত হত্যার বিরুদ্ধে পথে নেমেছে।

তবে পুরো ছবিটাই হতাশার নয়। আজও কতিপয় মানবাধিকারকর্মীর নিরলস চেষ্টায় টিকে আছে রাজ্যের নানা আদালতে হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাগুলি। যেমন, আলিপুরে মহম্মদ আলমের মামলা, সিউড়িতে আনন্দ বিশ্বাস মামলা, সিবিআই আদালতে খড়গপুরের সৌমেন্দ্র মণ্ডলের মামলা। পরিবারের ঐকান্তিক, অদম্য নিষ্ঠার ফলে যেমন পুলিশের সাজার নির্দেশ হয়েছিল, তেমনই মা পদ্মরানি ঠাকুরের চেষ্টায় কমল ঠাকুরের হত্যা মামলায় পুলিশের সাজা হয়েছিল, এপিডিআরের চেষ্টায় বালির ঘটনায় সাজা হয়েছিল।

হেফাজতে হিংসা, হত্যা, পদে পদে পুলিশের বেআইনি কার্যকলাপ আমাদের মনে করিয়ে দেয় আধা সরকারি নজরদারি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা, সরকারি অনীহা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আইনের শাসনের পরিবর্তে শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে আইনরক্ষকদের চলার অভ্যাস, উচ্চতর পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি না দেওয়া ইত্যাদি।

এটাই কি ভবিতব্য? না। শুনলে অনেকের হাসি পাবে (বিশেষ করে যাঁরা সঠিকভাবেই মনে করেন যে পুলিশ রাষ্ট্রযন্ত্রের নীপিড়ক অংশমাত্র), বহু উত্তর ঔপনিবেশিক দেশে পুলিশ-সেনাবাহিনীকে গণতান্ত্রিক করার  চেষ্টা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশ সহ সমস্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ভাবতে বলা, তাদের কর্তব্য আইন মেনে চলা, মানুষকে প্রকত অর্থে সেবা করা, শাসক দলের সেবাদাসে পরিণত না হওয়া, ক্ষমতা প্রয়োগের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা অনুশীলন করা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা, ঊর্ধ্বতনের বেআইনি নির্দেশ অমান্য করা।

এসব চালু হলে অনেকের আশা দেশ হেফাজতে হত্যামুক্ত, অত্যাচার মুক্ত হয়ে উঠবে অচিরেই।

(সুজাত ভদ্র মানবাধিকার কর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)

Human Rights
Advertisment