"পুলিশ তুমি যতই মারো,
মাইনে তোমার একশো বারো!"
আমাদের কৈশোরকালের কথা। পশ্চিমবঙ্গে তখন কংগ্রেস সরকার। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কঠোর হাতে, মোটামুটি দমন-পীড়ন নীতিতে চলছে রাজ্য। লক্ষ্য, বাম আন্দোলন খতম করা। বামপন্থীরাই মূলত পুলিশের রোষে। বিশেষত নকশালপন্থী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। পুলিশের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ নীতি, ঘটছে নিচুতলার পুলিশকর্মী খুন হওয়ার মতো ঘটনা। বিভেদ এবং শাসনের চিরকালীন রাষ্ট্রীয় নীতি ও কৌশল আজকের মতো তখনও বিভ্রান্ত করেছে মানুষকে। খুন-জখম-বনধ-অবরোধে জেরবার রাজ্যের মানুষ। অদ্ভুত এক অবিশ্বাসের প্রহর সেটা।
পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে যোগ দিল কেন্দ্রের রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স। ঠিক সেই সময়ই বাম দলগুলির সদস্য তরুণ তুর্কিদের মুখে প্রথম শুনি ওপরের দুটি লাইন। এটা যে পুলিশের অবস্থানকে বিদ্রুপ করে, সেটা বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। অথচ শুধু সেই সময় নয়, সবসময়ই পুলিশের যে ভূমিকা, তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্রশক্তির অঙ্গুলিহেলনে। পুলিশ শাসনতন্ত্রের একটি যন্ত্র মাত্র। শাসননীতি সে ঠিক করে না। তবু পুলিশই আমাদের কাছে ভিলেন। সর্বকালে, সব পরিস্থিতিতে।
আরও পড়ুন: আজ কা গুন্ডারাজ, আর আমাদের ভাগ্যে কাঁচকলা?
পুলিশি অত্যাচার, পুলিশের অনৈতিক কান্ডকারখানা, পুলিশের কায়েমী স্বার্থ, এসব আমরা প্রায়ই বলে থাকি। আমি বলছি না, পুলিশের মধ্যে অসাধু চক্র নেই। অসততাও আছে। সেটা সব পেশাতেই আছে। কিন্তু বাকি সব পেশার তুলনায় পুলিশের কাজে ঝুঁকি যে অনেক বেশি, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। পেশার কারণে অনেক কিছুই নেই তাঁদের জীবনে। পরিবারের জন্য সময় নেই। ডিউটির ক্ষেত্রে ইচ্ছে-অনিচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দ ভাবার কোনও প্রশ্নই নেই।
পুজো, বড়দিন, ঈদ বা যে কোনও উৎসবে আমরা মেতে উঠি পুলিশের ভরসাতেই। ঠিক সেই সময় একজন পুলিশকর্মী বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা কিভাবে কাটাচ্ছেন, ভাবি না কিন্তু আমরা। পাশাপাশি নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ডিউটিকেই আগে রাখতে হয় তাঁদের। নির্ধারিত ডিউটির বাইরেও যে কোনও সময়, যে কোনও জায়গাতেই পরিস্থিতি সামলাতে ছুটে যেতে হতে পারে একজন পুলিশকর্মীকে।
দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি নিয়ে প্রচুর অভিযোগ শোনা যায়। যেন বাকি সবাই তাঁদের দায়িত্ব পালনে একেবারে নিখুঁত। পুলিশকে কাটাছেঁড়া করার সময় এটা আমরা মনেই রাখি না। একই ভাবে পুলিশকে ঘুষখোর বলার আগেও বোধহয় নিজেদের মুখগুলো আয়নায় দেখে নেওয়া প্রয়োজন। ঘুষটা দিচ্ছে কে? আমি-আপনিই তো! আমরাই অপরাধ ঢাকতে, সহজে কাজ হাসিল করতে, অসাধু লেনদেন চালিয়ে যেতে, পুলিশকে উপঢৌকন দিয়ে থাকি। দিয়ে এসেছি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা কি, সবাই জানেন।
আরও পড়ুন: গুরুগিরি: বাঙালি ও ভারতীয়দের ঐতিহ্য
আসল কথা হলো সিস্টেম। এই সিস্টেমের অঙ্গ আমার-আপনার মতোই পুলিশও। আসুন এই বিষয়টাকে আমরা পরিষ্কার দুটি ভাগে বিভাজন করি। জটিল দিকটাই প্রথমে বলে দেওয়া যাক। এদেশে আইন ও প্রশাসনের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের কায়েমী স্বার্থ, ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক গোলকধাঁধা, ভাষা ও সংস্কৃতির জটিলতা, সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত কীভাবে জড়িয়ে থাকে, এটা এখন একজন শিশুও জানে। পুলিশের হাত-পা-মাথা সবই বাঁধা সেখানে। তারা চাইলেও বহু ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারে না।
সিস্টেমের আর একটি দিক হলো পরিকাঠামো। আজকের অপরাধীরা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যতদূর এগিয়ে গেছে, আমাদের প্রশাসনিক পরিকাঠামো সেই পর্যায়ে গেছে কি? গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথা ছেড়েই দিলাম। শহর বা শহরতলীতেও যথাযথ ফোর্স, অস্ত্র, গাড়ি, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে কম্পিউটার ইত্যাদি না থাকায় প্রায়ই কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হন পুলিশকর্মীরা।
খবরে মাঝে মাঝেই দেখা যায়, জনতার দ্বারা থানা ঘেরাও, আক্রমণ ইত্যাদি ঘটনা। এই জনতাও কিন্তু সব সময় নিরীহ সমাজের প্রতিভূ থাকে না। তারা হয় কোনও রাজনৈতিক দলের আশ্রিত। নয় জনতার আড়ালে অপরাধের মুখ। সেখানেও পুলিশকেই সাবধানী হতে হয়। কেন না, ঘটনাস্থলে পুলিশ মারা গেলে আমাদের কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমজনতার মুখোশ পরিহিত কোনও অপরাধী মারা গেলে মুহূর্তের মধ্যে সেটা ইস্যু হয়ে যায়। কারা ইস্যু বানায়, কেন বানায়, তার উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: জাতের নামে বজ্জাতি আর কতদিন?
আর অপরাধ দমনে গিয়ে মার খাওয়া বা মৃত্যুর মুখে পড়া তো ইদানীং জলভাত হয়ে গেছে। এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ উত্তর প্রদেশে ইন্সপেক্টর সুবোধ কুমার সিংয়ের হত্যা, যে মামলায় মূল অভিযুক্তরা জামিনে ছাড়া পেয়ে আপাতত জেলের বাইরে। এতে সমাজের বা রাষ্ট্রের কিছু এসে যায় বলে মনে হয় না । যে যখন, যেখানে, যেভাবে পারছে পুলিশকে মেরে দিচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই এর আগাম আভাস থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে প্রতিরোধ করার কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
দেশের নামী-দামি জন প্রতিনিধিদের (প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা , রাজ্যপালগণ বা বিরোধী নেতা প্রমুখ) নিরাপত্তায় যাঁরা থাকেন, বহুবার দেখা গেছে, তাঁদের নিজেদেরই কোনও নিরাপত্তা নেই। জনরোষের মুখে প্রথমে তাঁরাই পড়েন, এবং পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেয়ে যান। সমালোচিত হন, মন্ত্রী ও নেতাদের গালি শোনেন। তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু কেউ বিষয়ের গভীরে ঢোকে না। পরিকাঠামো জনিত তীব্র সমস্যা থেকে রাজনীতির নোংরা খেলা, ইন্ধনের অভাব নেই। আগুনে জল ঢালতে হয় পুলিশকেই, সেই নিজের জীবন বিপন্ন করে, সব পক্ষের কাছে অপ্রিয় হয়ে।
এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য 'স্টেট অফ পুলিসিং ইন ইন্ডিয়া রিপোর্ট ২০১৯'। এটি এমন এক সমীক্ষা, যেখানে ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ এশিয়ার পুলিশি ব্যবস্থার সঠিক অবস্থানকে যথাযথ তুলে ধরা হয়েছে। তাদের কাজের পরিবেশ, পারিবারিক পরিস্থিতি, তাদের প্রতি ঘটে চলা নানা বৈষম্যমূলক আচরণ, সবই উঠে এসেছে এই রিপোর্টে। দেশ জুড়ে কর্মরত পুলিশকর্মীরা জানিয়েছেন কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, সাহায্য, তাঁদের দায়িত্ব, সামগ্রিক পরিস্থিতি ইত্যাদির প্রেক্ষিতে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, মতামত ও অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন: অঙ্গদান: যতটা প্রয়োজন, আমরা ততটা পারি না কেন?
এরই সঙ্গে উঠে এসেছে আম জনতার সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও। বড়ই স্পর্শকাতর বিষয় নিঃসন্দেহে। দেশে ও সমাজে উত্থিত নানা অবস্থার প্রেক্ষিতে হিংস্রতার যে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে ইদানীং, তাই নিয়ে পুলিশের মধ্যেও এক উদ্বেগজনক বাতাবরণ সৃষ্ট হয়েছে। ২০টি রাজ্য এবং দিল্লি পুলিশের ১১,৮৩৪ জন কর্মী ও ১০,৫৩৫ পুলিশ পরিবারের সদস্য এখানে জানিয়েছেন তাঁদের অন্তরকথা। রাজ্যভিত্তিক তুলনামূলক আলোচনাও হয়েছে, উঠে এসেছে নানা তথ্য।
এই রিপোর্টে একটা বিষয় উপলব্ধ হচ্ছে, পুলিশি ব্যবস্থায় আরও ভালো পরিষেবা পেতে হলে নীতি নির্ধারণের জায়গাটা অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত হতে হবে। গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অপরাধীর দল আধুনিক হচ্ছে, পুলিশকে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে পরিকাঠামোয় চূড়ান্ত উন্নতি প্রয়োজন। একটি নিপুণ ও নিখুঁত ডেটাবেস সংরক্ষণ ব্যবস্থা দরকার, যা সাহায্য করবে আজ এবং আগামীদিনে পরবর্তী প্রজন্মের পুলিশকর্মীদেরও। আর বদলাতে হবে পুলিশের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। সহানুভূতি না হোক, যথার্থ মূল্যায়নটুকু তো করতেই হবে।