Advertisment

বিধানসভায় সিএএ বিরোধিতা: শ্যাম রাখি, না কুল

পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় কিছুটা অন্যরকম। এখানে ত্রিশ শতাংশ আন্দাজ অধিবাসী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

দেশের কয়েকটি রাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)-বিরোধী প্রস্তাব পাশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা। তবে এ এমন এক বিষয়, যার প্রেক্ষাপটে নজর দেওয়া জরুরি। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিকপঞ্জি আর জাতীয় জনগণনাপঞ্জি এই মুহূর্তে দেশের শুধু বহু আলোচিত বিষয়ই নয়, 'জ্বলন্ত বিষয়'। তার এমনই 'রাজনৈতিক' দাপট যে দেশে অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার সময়ও পাওয়া যাচ্ছে না।

Advertisment

কোনো সন্দেহ নেই যে ভারত জুড়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ নিয়ে যে আলোড়ন, আন্দোলন চলছে, স্বাধীনতা-উত্তর কালে তার তুলনা পাওয়া ভার। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পক্ষে বা বিপক্ষে জড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রায় প্রত্যেকেরই এ বিষয়ে কিছু বক্তব্য আছে। যেহেতু বিষয়টা দেশের মানুষের প্রাত্যহিক জীবন ও ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত, সেই কারণেই সাধারণভাবে 'মৌন' জনসাধারণ এত 'মুখর' হয়ে উঠেছে।

ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে এ এক ব্যতিক্রমী সময়, চ্যালেঞ্জিংও বটে। মাঝেমধ্যে ঘটে যাওয়া হিংসার ঘটনা বাদ দিলে সাধারণভাবে সিএএ-সংক্রান্ত প্রতিবাদ ও সমর্থন তর্কবিতর্ক, মিটিং-মিছিল, ধর্না আর সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। তবে আম জনতা যে অবস্থান নেয় তার সঙ্গে রাজনীতিবিদদের অবস্থানের কোথায় যেন কিছুটা ফারাক চোখে পড়ে। আসলে সরকার বা প্রশাসনের চালিকাশক্তি হিসেবে যারা থাকেন, তাঁদের গতিবিধি তো আর পাঁচজনের মত হওয়ার কথাও নয়। এরই এক বহিঃপ্রকাশ ঘটছে দেশের কয়েকটি প্রদেশের বিধানসভায়।

ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও প্রচলিত বহুদল-ভিত্তিক নির্বাচনী পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় সরকার যে দল বা জোটের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, বিভিন্ন রাজ্যে সেই দল বা জোটের অংশীদার থাকতেও পারে বা নাও থাকতে পারে। যেমন, কর্ণাটকে, ত্রিপুরায়, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল রাজ্য চালাচ্ছে, বিহারে নেতৃত্ব দিচ্ছে কেন্দ্রের জোট সঙ্গী, আবার কেরালা, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ আর পাঞ্জাবে শাসন করছে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা জোটের বিরোধী পক্ষ। প্রত্যেক দলেরই 'জনস্বার্থ' বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানাবার তাগিদ থাকে, আর সিএএ-র মতো বিষয় হলে তো কথাই নেই! সুতরাং আমরা দেখছি, একদিকে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ওই আইনের সমর্থনে পদক্ষেপ গ্রহণে রাজ্য সরকার বদ্ধপরিকর, অন্যদিকে বিজেপি-বিরোধী শক্তি যে রাজ্যে ক্ষমতায় বহাল, সেখানে সরকারি মহলে বিরোধিতার বাতাবরণ বিদ্যমান।

একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বিজেপি-শাসিত রাজ্যে রাজ্য সরকারের সমস্যা তুলনায় কম। রাজ্যবাসীকে সিএএ-র ‘উপযোগিতা’ বোঝানোর চ্যালেঞ্জ আছে ঠিকই, তবে সংসদের উভয় কক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশ করা আইনকে পাশ কাটানোর পদ্ধতি প্রকরণের হদিশ করার চ্যালেঞ্জ তো নেই। অন্যদিকে, বিজেপি-বিরোধী শক্তি যেখানে ক্ষমতায় আছে, সেখানে সমস্যা জটিল। যে সংবিধানের কথা সারা দেশে হচ্ছে, যে সংবিধান স্বাধীনতার এত বছর পর জনতার হাতে হাতে ঘুরছে, সেই সংবিধান যে বলে নাগরিকত্বর প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারই 'অভিভাবক'। এ প্রসঙ্গে নাগরিকত্ব আইন (১৯৫৫) রাজ্য সরকারের 'বিপথে' চলবার সুযোগ রাখেনি। তাই সিএএ-বিরোধী ক্ষমতাসীন দলের কাছে এখন 'শ্যাম রাখি, না কুল রাখি' পরিস্থিতি। দেশের সংবিধান মানার শপথ নিয়ে রাজ্যে সরকার চালাবার কাজে নেমে সংবিধানের নিয়মবিধি মেনে পাশ করা 'ভয়ঙ্কর' 'জনবিরোধী' আইনের বিরুদ্ধাচারণ করার কৌশল বার করা নিশ্চিতভাবেই সহজ কাজ নয়।

কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব আর রাজস্থান বিধানসভায় এই আইন বাতিল করার প্রস্তাব এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল তো বটেই। সম্মুখ সমরের বাইরে গিয়ে এক ধরনের 'ছায়া যুদ্ধ' জারি রাখা এই কৌশলের অঙ্গ। যদি ভারতের জনসাধারণের সংখ্যাধিক্যের ভোটে (কত শতাংশের ভোট বা দেশের কোন অঞ্চলের কত ভোটে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও) ক্ষমতায় আসা সরকার এই আইন 'জনকল্যাণে' পাশ করে থাকে, তাহলে রাজ্যগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে (সেখানেও শতাংশ বিতর্ক আছে) ক্ষমতায় আসা সরকার 'জনস্বার্থে' এই আইন বাতিলের প্রস্তাব করা (রাজ)নৈতিকভাবে সঠিক কাজ বলে মনে করছে l "অপর পক্ষ যদি পারে তো আমরাই বা পারব না কেন" - এই মনোভাব এখানে কাজ করছে।

এই কৌশলের এক প্রতীকী তাৎপর্যও আছে। ফল যাই হোক না কেন, সংসদীয় আঙিনায় একটা প্রতিবাদ তো নথিভুক্ত হলো। সংবিধানের নির্দেশ আর 'জনস্বার্থ' বা 'দেশের স্বার্থ' মিলেমিশে বিষয়টাকে জটিল করে তুলেছে বলেই হয়তো, অন্তত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, প্রাথমিকভাবে এই প্রক্রিয়ায় শাসকদলের কিছু দ্বিধা ছিল l কংগ্রেস, সিপিএম এ নিয়ে টিপ্পনি করতেও ছাড়েনি। সম্প্রতি কলকাতায় লেখক-সমাজকর্মী অরুন্ধতী রায়ও বলেছেন, সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে বিধানসভার ভূমিকা তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এতে একদিকে যেমন এই কৌশল সিভিল সোসাইটির একাংশের সমর্থন পায়, অন্যদিকে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার চাপও বাড়ে। ওই যে বললাম, আম জনতা যা দ্বিধাহীনভাবে করতে পারে, প্রশাসকদের ক্ষেত্রে তা ততটা সহজ হয় না। এছাড়াও, ভোট বড় বালাই! এক তরফের ভোট টানতে গিয়ে অন্য তরফ হাতের বাইরে চলে যাওয়া রাজনৈতিক অঙ্কে বাঞ্ছনীয় নয়। দেখা যাচ্ছে পাঞ্জাব, রাজস্থান ছাড়া অন্যান্য কংগ্রেস-শাসিত রাজ্য এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে মুখ খোলেনি। একদিক থেকে দিল্লি বিধানসভার মেয়াদ শেষ হওয়ায় অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই ফ্যাসাদ থেকে মুক্তি পেয়েছেন l

এবার পশ্চিমবঙ্গের কথায় আসা যাক। পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় কিছুটা অন্যরকম। এখানে ত্রিশ শতাংশ আন্দাজ অধিবাসী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। আবার সহজে স্বীকার করা হোক বা না হোক, এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অস্মিতার এক চোরাস্রোত বয়ে চলেছে, যা সাম্প্রতিককালে মাঝে মধ্যে ছলকে সামনে উঠে আসছে। অন্য দিক থেকে দেখলে, এই রাজ্যের আনাচে কানাচে এক ‘radical’ মনন বিদ্যমান। সিএএ নিয়ে সারা রাজ্যে তো কম হৈচৈ হচ্ছে না l দিল্লির শাহিনবাগের ধর্না বেশি প্রচার পেলেও কলকাতার পার্ক সার্কাসের অবস্থান কম যাচ্ছে না। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দিচ্ছেন বিক্ষোভে। সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভে সামিল হচ্ছে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।

মিটিং-মিছিল, বিক্ষোভ সমর্থন মোটেই কলকাতা শহরে সীমাবদ্ধ নেই। এরই মধ্যে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে প্রধান মুখ যে হয়ে উঠেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, তা তাঁর সমালোচকরাও মানছেন। এই 'প্রধান' ভূমিকা রক্ষা করতে তিনি নিজেও সচেষ্ট। সম্ভবত সে কারণেই দিল্লিতে সিএএ নিয়ে বিরোধী দলগুলির মিটিং-এ যাননি তিনি। যদিও বসপা, আপ-এর মতো দলও এই বৈঠকে যায়নি। তাঁর অনুপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করে মমতা বলেছেন, নিজের রাজ্যকে এই আন্দোলনের অভিমুখ করতে তিনি ব্যস্ত।

আবার এও ঠিক যে শত বিরোধিতা সত্ত্বেও  মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কিছু বাধ্যবাধকতা থাকার কথা। চাপ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী ও গৃহমন্ত্রী বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীরা আইনি পরামশ নিলেই বুঝতে পারবেন কেন্দ্রীয় আইন অলঙ্ঘনীয়। যোগ্য প্রশাসক ও জননেত্রীর মিশেল যেমন কাম্য, তেমন এই মিশেলে টানাপোড়েনও থাকে। অস্থির সময়কালে সমস্যা এও হয় যে যা ‘স্বাভাবিক’ তা অস্বাভাবিক লাগে। তাই মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী একান্তে বৈঠক হলে তা সন্দেহের চোখে দেখা হয়। খুব কৌশলী অভিজ্ঞ রাজনীতিককেও এসব ক্ষেত্রে সরু সুতোর ওপর চলতে হয়।

খুব সংকীর্ণভাবে না দেখে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখলে এর মধ্যে অন্য একটি বিষয়ও চোখে পড়ে। তা হলো, সংবিধান ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক। জটিল বিষয়। এখানে বিশদ আলোচনার সুযোগ নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এই সম্পর্ক তো বেশ সহজ। সংবিধান যদি গণতন্ত্রের ভিত্তি হয়, যা কিনা ভারতের ক্ষেত্রে সত্যি, তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা তবু তৈরী হয়, বিশেষ করে সংবিধান কী চাইছে সে বিষয়ে যখন বিশ্লেষণ আলাদা হয়ে যায়, প্রবল মতপার্থক্য হয়। সিএএ ও আনুষঙ্গিক পদক্ষেপগুলি এখানে প্রাসঙ্গিক, কারণ ওই আইনের সমর্থক ও বিরোধী দু'পক্ষই তাঁদের মতো করে সংবিধানকে মেনে চলার দাবি করছেন। কেউ বলেননি, আমরা যা করছি তা সংবিধানের বাইরে গিয়ে করছি।

এই আইনের বিরোধীরা মনে করছেন, এর ফলে সংবিধানের মূলভিত্তি - সমানাধিকার, ধর্মনিরেপেক্ষতা ইত্যাদি দুর্বল করা হলো। আইনের সমর্থনে পাল্টা যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানে কিছু রদবদল আনতেই হয়। কারণ, সংবিধান 'জীবন্ত নথি' (living document), ফসিল নয় l মোদ্দা কথা, মাঠঘাটের রাজনীতির সঙ্গে সংসদীয় রাজনীতি মিশে থাকলেও তাদের ধরন আলাদা। ঠিক এই কারণেই বিধানসভায় প্রস্তাব এনে ‘সংবিধান রক্ষা’র পথে যেতে হয়। তা নিয়ে ঢক্কানিনাদও করতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। যদি টেকনিক্যালি তা সাংবিধানিক আইনের বাইরে হয়, তাও। রাজনীতির বাধ্যবাধকতা এখানে আইনের মুখোমুখি হয়।

যাই হোক, সিএএ-র বল এখন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট এই আইনের ওপর স্থাগিতাদেশ না দিয়ে এই আইনের বিরুদ্ধে জমা পড়া আবেদনের জবাব দিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে মাসখানেক সময় দিয়েছে। দেখতে হবে, সেখান থেকে কী রায় আসে। এরই মাঝে সিএএ নিয়ে চাপান উতোর চলছে, চলবে!

(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

bjp Mamata Banerjee caa
Advertisment