Advertisment

নশ্বর স্মৃতি, অবিনশ্বর রাজনীতি

তাপস পাল অসুস্থ ছিলেন, সে কথা জানতেন আম বাঙালি। কিন্তু এই মাসের শুরু থেকে তিনি যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন, সে কথা প্রচারিত হয় নি বাংলার সংবাদমাধ্যমে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
tapas paul death

রাজনীতির রঙ লাগে স্মৃতিতেও। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

রুটি-কাপড়া-মকান, বিজলি-সড়ক-পানি, এসবের মতই মৃত্যুও রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিষয়টি বহুচর্চিত, বহুপঠিত, বহুবর্ণিত। এ রাজ্যে যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁদের সকলেরই চোখে ধরা পড়েছে রাস্তার ধারের ছোট বড় স্মৃতিসৌধ। তার ওপর টাটকা কিংবা শুকনো মালা, কোনও রাজনৈতিক দল বা দেশের পতাকা, সময় বিশেষে ছোটবড় জটলা। নেতারাও আসেন, সঙ্গে তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গো, থুড়ি অনুগামীরা। দুহাত জোড় করা, কিংবা কাঁধের পাশে মুষ্টিবদ্ধ কৌণিক কনুই, এসবই মৃত মানুষের প্রতি জীবিতের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

Advertisment

বিশেষ করে ভাষা দিবসের আবহে একথা তো উঠে আসবেই। বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রাণ গেল রাফিক, জব্বর, বরকত আর সালাম ভাইয়ের। দিনটাকে মনে রাখতে চালু হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তার তেষট্টি বছর পূর্তির কয়েকটা দিন পরে ঢাকায় টুকরো টুকরো হলেন ব্লগার অভিজিৎ রায়। এরপরেও অনেক নাম আসবে - ওয়াশিকুর, অনন্ত, নীলাদ্রি, দীপন। ভাষার লড়াইতে যাঁদের প্রাণ গেল, তাঁরা অংশ হলেন মৃত্যুর রাজনীতির।

এই রাজনীতির দুটি ভাগ। এক হলো স্মৃতির চলমানতা, যেখানে বছরের বিশেষ সময়ে ফিরে দেখা হয় কোনও একটি অতীতের ঘটনা, বিশ্লেষণ করা হয় সেই সময়ের পরিস্থিতি, তাকানো হয় সামনের দিকে। কলকাতার রাস্তায় হেঁটে মাঝরাতে যাঁরা একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করছেন, তাঁদের সমাজবোধকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সত্যিই হয়ত রাজনীতি সেখানে গৌণ। ভাষাদিবসের শহীদ, সেখানে সরাসরি ভোটের অঙ্কে ঢোকে না।

আরও পড়ুন: শুধু কি ভালোটাই মনে থাকে?

তুলনায় চরিত্র কিছুটা আলাদা একুশে জুলাইয়ের। তৃণমূলের এই দিনের সমাবেশ সরাসরি রাজনৈতিক। যুব কংগ্রেসের যে কর্মীরা শহীদ হয়েছিলেন ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাই, তাঁদের কথা বারবার ফিরে আসে সেই দিনের সভায়। সেখানে কোনও ভাষা বা সম্প্রদায়ের প্রশ্ন নেই। ২০১১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে ধরা হত দিনটিকে। তৃণমূল জিতে যাওয়ার পর শহীদ দিবস অনেকটাই বিজয় দিবসের রূপ নিয়েছে। সেই মঞ্চে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছেড়ে এসে নেতা-সমর্থক যোগ দেন তৃণমূলে। শিল্পীরা ভিড় জমান মঞ্চে, একাধারে সংস্কৃতি এবং রাজনীতি চর্চায়। সুতরাং শহীদ স্মরণের সীমানা ছাড়িয়ে ২১ জুলাই অনেক বৃহত্তর প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক কর্মসূচী। রাজনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান ঠিক এভাবেই এগোয়। অর্থাৎ মৃত্যু কখনও স্মরণে, কখনো প্রতিবাদের ভাষায়, কখনও দলবদলে। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রেক্ষিত অস্বীকার করার কোনও উপায় এখানে নেই।

কোন প্রসঙ্গে মৃত্যু নিয়ে এতো কথা হচ্ছে তা বলে দেওয়ার জন্যে কোনও পুরস্কার নেই। এ সপ্তাহের শুরুতে (১৮ ফেব্রুয়ারি) চলে গেলেন তাপস পাল। আশির দশকে যে বাঙালিরা বড় হয়েছেন, যাঁদের বয়স আজ পঞ্চাশ ছুঁতে চলেছে, তাদের কাছে 'দাদার কীর্তি' অমর। যে কথাটা এই জায়গায় মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, তা হলো আশির দশক বামফ্রন্টের নতুন থেকে পুরোনো হওয়ার সময়কাল। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ এগোচ্ছে ভূমিসংস্কারের হাত ধরে, অন্যদিকে বাম শাসনে ক্ষমতার স্বাদ জারিত হচ্ছে চোরা নুনের আধিক্যে।

কিন্তু চরম দুর্নীতি নিয়ে তর্কবিতর্ক তখনও এ রাজ্যের রাজনীতির সঙ্গী হয় নি। একথা সকলেই জানেন যে শীর্ষস্থানীয় বামনেতাদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ সবসময়েই খুব কম। আর আশির দশকে বামেদের ক্ষমতার আস্ফালন শুরু হলেও তাদের মাঝের সারির নেতাদের মধ্যে সরকারি শিক্ষক সম্প্রদায়ের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। ফলে সরাসরি পার্টি অফিস থেকে প্রোমোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ তখনও মাথা চাড়া দেয় নি, যা নাকি নব্বুইয়ের দশকে মাঝের সারির বাম নেতাদের আর্থিক এবং সামাজিক দুর্নীতিতে হাতেখড়ি।

আরও পড়ুন: হিন্দু তোষণের রাজনীতি দিয়ে যায় চেনা?

বাংলা সিনেমার রমরমা তখনও কম, আজকের দিনের মতোই। তবে রাজনৈতিক দলের সরাসরি হস্তক্ষেপ সেই সময় টালিগঞ্জে বর্তমানের তুলনায় অনেক কম ছিল। কাজ ফুরিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র শিল্পীদের রাজনীতিতে আসা তখনও শুরু হয় নি। মৃণাল সেন সেই সময় যেমন তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক ছবি করেছেন, তরুণ মজুমদার শুনিয়েছেন একেবারে মধ্যবিত্ত ঘরোয়া বাঙালির কোমল গল্প। মননশীল বাঙালি ‘খারিজ’ দেখে গম্ভীর মুখে সমাজ সংসার নিয়ে আলোচনা করেছেন, আর সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোর স্কুল পালিয়ে দেখেছে ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’। অঞ্জন দত্ত থেকে তাপস পাল সেই সময়ের বাঙালি সংস্কৃতির ব্যপ্তি, মননশীলতার এক কূল থেকে জীবনবোধের অন্য সীমানা।

হিন্দু, বাঙালি, সংস্কৃতিবান এবং মধ্যবিত্ত যে শ্রেণী, তাকে ধরে রেখেছিল সেই সময়ের সিপিএম। সেখানে চলচ্চিত্র শিল্পীরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, দু-একজন নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, কিন্তু আজকের টলিউড এবং রাজনীতির মিশেলের তুলনায় তা একেবারেই আলাদা চরিত্রের। এরপর সত্তর-আশির ‘সিপিএম’ বদলে নব্বুইয়ের দশক থেকে যখন থেকে ‘সিপিয়েম’ হতে শুরু করল, তখন থেকেই বাঙালির গঙ্গাযাত্রার শুরু। তারই অতিবিবর্তিত রূপ এই সহস্রাব্দের বঙ্গ বামফ্রন্ট, পরের দশকের তৃণমূল, কিংবা বিশ-বিশের রাজ্য বিজেপি।

আঁতেল ছবি না হলেও 'দাদার কীর্তি' কিংবা 'ভালোবাসা ভালোবাসার' নায়ক তাপস পাল থেকে উন্নয়নের বাংলার উত্তেজিত সাংসদ বঙ্গজীবনের সেই অভিযোজনের সাক্ষী। সেই সংস্কৃতি আজকের চন্দননগর থেকে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা ছুঁয়ে জলঙ্গীর ধারে কৃষ্ণনগরে গিয়ে মিশেছে। তাপস পাল অসুস্থ ছিলেন, সে কথা জানতেন আম বাঙালি। কিন্তু এই মাসের শুরু থেকে তিনি যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন, সে কথা প্রচারিত হয় নি বাংলার সংবাদমাধ্যমে। তাই ভোরবেলা হঠাৎ তাঁর চলে যাওয়ার খবর অবশ্যই আলোড়নের তুলেছে এই বাংলায়।

আরও পড়ুন: রাজনীতিতে দলবদল: সোমনাথ চ্যাটার্জি থেকে বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়দের ভূমিকা

টেলিভিশনের পর্দায় স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে কিন্তু এই অকালপ্রয়াণ সম্পূর্ণ হলো না। বরং শেষযাত্রায় সঙ্গী হলো তীব্র বিতর্ক। তৃণমূল নেত্রী সরাসরি অভিযোগ তুললেন বিজেপির বিরুদ্ধে। কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের চক্রান্তেই নাকি তৃণমূলের বেশ কিছু নেতানেত্রীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অনেকে মারা যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির ডাইনি খোঁজার চক্করে। এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হবে অনেক।

তবে মৃত্যুতে তাপস পাল শুধু সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলেন না তাঁর শৈল্পিক সত্ত্বা, বরং খেয়াপারের পারানি হিসেবে রয়ে গেল অনেকটা রাজনীতি। মৃত্যু বড় দুঃখের, তবে অতিপরিচিত প্রিয়জন, নিকটাত্মীয় বা বন্ধুর কাছে। তার থেকে দূরের যে কোনও মানুষের দুঃখপ্রকাশই শুধু প্রকাশ মাত্র। তাতে দুঃখ থাকে না মোটে। সেই চুকচুক-টুকু আমাদের নায়কের অভিনয় মনে রেখে সাতসুরে মিললেই সবচেয়ে সম্মানিত করা যেত এক অসাধারণ অভিনেতাকে।

তাই আসুন, স্মৃতিচারণায় কৃষ্ণনগর ভুলে যাই। আশির দশকে লেকটাউনের মিলন সংঘের মাঠে এক মেলা উদ্বোধনে এসেছিলেন তাপস পাল। ডেকেছিলেন কোনও রাজনৈতিক নেতাই, কিন্তু নায়ক তখন নেতা নন। আমার সমবয়সী এক বন্ধু সেই কিশোর বয়সে সোজা ঝাঁপ মেরেছিল অভিনেতার পায়ের ওপর। চারপাশ থেকে সাঙ্গোপাঙ্গোরা ছুটে এসেছিল। কিন্তু তাদের সরিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে সেই সময়ের তাপসদা বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন নাম না জানা বুবাইকে। সেকথা ভেবে এই লেখার সময় যেটুকু চোখ ছলছল, সেটাই সবচেয়ে বেশি পাওনা অবিনশ্বর অভিনেতার।

একই রকম বুক ভার আজ কৃষ্ণা বসু চলে যাওয়ার খবরে। রাজনীতি এখানে গোহারা হেরেছে। পরিবার পরিজনের একযোগে কান্নাভেজা গলায় গেয়ে ওঠা গানে মহাসিন্ধুর ওপারে চলে গেলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গ্রন্থকার এবং সমাজবিজ্ঞানী। রাজনীতি পড়ে থাকল তাঁর পায়ের কাছেই।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Anyo Paksha
Advertisment