Advertisment

গল্পের পুকুর, পুকুরের গল্প

পরিবেশচর্চা বলে কোনও আলাদা বিষয় থাকতে পারে, নাও পারে, কিন্তু জল বাতাস মাটি খাদ্যশস্য – আপামর সমস্ত মানুষেরই ন্যূনতম প্রাথমিক অধিকার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Jol Mati, Environment

ফাইল ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

অনেক অনেক দিন আগে এক দেশের এক গ্রামে থাকত চার ভাই- কুড়ন বুড়ন সরমন আর কৌরাই। চারভাইয়ে মিলে ক্ষেত চাষ করত। বর্ষার দিনে যখন অনেক কাজ, দুপুরেও বাড়ি যাওয়া যায় না, কুড়নের ছোটো মেয়েটি বাবা-কাকাদের খাবার নিয়ে মাঠেই চলে আসত। একদিন হয়েছে কি, মাঠের ঠিক সামনে পড়ে থাকা এক পাথরে মেয়ের পায়ে হোঁচট লাগল। ভারি রাগ হল তার। খাবার নামিয়ে রেখে  নিজের কাস্তেখানা দিয়ে সেই পাথর উপড়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করল। কী অবাক কাণ্ড! পাথরের ছোঁয়া লাগতেই লোহার কাস্তেখানা সোনা হয়ে গেছে। মেয়ে সেই আশ্চর্য পাথরখানা তুলে নিয়ে একদৌড়ে ক্ষেতে। তার মুখে সব কথা শুনে বড়োরা বুঝল পরশপাথর পেয়েছে তাদের মেয়ে। কিন্তু বাড়ি এসে সবদিক ভেবে চিন্তে কুড়ন বলল,

Advertisment

দেখো ভাই, আমরা হলাম চাষীবাসি লোক। নিজেরা খাটি খাই, রাত্তিরে শান্তিতে ঘুমাই। এই সোনা প্রথমে আমাদের শান্তি নষ্ট করবে। তারপর ঘুম যাবে, তারপর নিজেদের মধ্যেকার ভাবভালোবাসা যাবে, লোভ হবে। লোভ থেকে সর্বনাশ হয়। তাছাড়া একান ওকান হয়ে রাজার কানে কথা উঠবে, রাজার লোক এসে সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। কী কাজ! তার চেয়ে চলো, যে কাজে লাগাবে তাকেই দিই- এই পাথর রাজাকেই দিয়ে আসি।

আরও পড়ুন, দরিদ্র অর্থনীতি- নোবেল লরিয়েটদের বই ও দারিদ্র্য দূরীকরণের নয়া দিগন্ত

গল্পের এতটা অবধি সবারই জানা। নতুন হল এর শেষ অংশটুকু। এ গল্পের রাজাও গল্পের মতই। পরদিন কুড়নের হাতে পাথর ফিরিয়ে দিয়ে রাজামশাই সভার মধ্যে বললেন, শোনো কুড়ন, এ পাথর তোমরাই রাখো। এ দিয়ে ভালো ভালো কাজ কোরো।

ভেবেচিন্তে , অন্যদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে সবচেয়ে ভালো কাজই করল চার ভাই- কাছাকাছি গ্রামে গ্রামে খুব বড় বড় জলাশয় খোঁড়ালো। মধ্যপ্রদেশের পাটন অঞ্চলে আজও আছে চারটে প্রকাণ্ড দীঘি- কুন্ডম গ্রামে কুন্ডম সাগর, বুড়াগ্রামে বুড়া সাগর,  মঝগঁওয়া তে সরমন সাগর আর কুঁইয়া গ্রামে কৌরাইসাগর।

এই অপরূপ গল্পটি শুনিয়েছিলেন পরিবেশ-দার্শনিক শ্রী অনুপম মিশ্র। তিনি বলছিলেন কোনও ইতিহাস বইয়ে হয়ত লেখা নেই এই গল্প কিন্তু মানুষের মনের ভেতর দিয়ে, মুখ থেকে মুখে এইসব গল্প চলাফেরা করে। এরকম গল্প আমরাও শুনেছি- সোনাই দীঘি, কমলা সাগর, শুভঙ্করের দাঁড়া…। এই গল্পগুলো কেবল গল্পের চেয়ে আরো অনেক বেশি কিছু বলে। আদি আমেরিকান জাতির লেখিকা লেসলি মারমোঁ সিলকো অদ্ভুত এক সতর্কবার্তা শুনিয়ে রেখেছেন এইসব গল্প সম্পর্কে – ‘ওরা তোমার ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে চায়। বলে কোনো ইতিহাস ছিল না তোমার। ওরা বলে আমাদের গল্পগুলো কেবলই আজগুবি গল্প। বিশ্বাস কোরোনা ওদের কথা। এই গল্পগুলোই কেবল আছে আমাদের, বাকি সব হারিয়ে গেছে। নিজেদের গল্পগুলোকে যত্ন করে ধরে রেখো’।

এমন সব গল্প মন দিয়ে শুনিনি বলে, ছোটবেলায় শোনা গল্প যত্ন করে মনে রাখিনি, শিক্ষিত অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে তার মানে বোঝার চেষ্টা করি নি বলে আজ দুদিনের বৃষ্টিতে যখন আমার দেশের সাতশ’ বছরের প্রাচীন শহর ডুবে যায়, সাধারণ বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়ে যায় চিরকালের মৌসুমী বৃষ্টির জনপদের পর জনপদ, আর সেই প্লাবনের অব্যবহিত পরেই, এক-দু’মাসের মধ্যে দেখা দেয় নির্জলতার অভিশাপ, আমরা দিশেহারা হয়ে তাৎক্ষণিক ত্রাণ খুঁজি যেই ত্রাণ কোনো পরিত্রাণ নয়। ডুয়ার্স অঞ্চল, যেখানে হিমালয় পাহাড় থেকে বর্ষাজলের উচ্ছ্বাস নিয়ে ঝড়ের মত নামত নদীগুলি, সেখানে ছিল ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গল। জলের তোড় বাধা পেয়ে পেয়ে নামত, কিছু জল অবসর পেত মাটির ভেতরে চলে যাবার। উত্তরবিহারে কোশী আর তার সাত উপনদীর সংসার নামত নেপালের মাটি-পাহাড় ধুয়ে নিয়ে, সেই সমতল ভূমিতে ছিল ‘চারকোসি ঝাড়ি’ বলে ঘন জঙ্গলের ঘের, যা ঐ পাগল জলপ্রলয়কে ঠেকাত, সামলে নিত। ক্রমে ছিন্ন হয়েছে এইসব প্রাকৃতিক রক্ষাব্যবস্থা। আজ স্বাভাবিক বৃষ্টিতেও প্লাবিত অসম, উত্তরবিহার, উত্তর বাংলা। একটি নদীতেও খাত নেই কোনও।

আরও পড়ুন, নারী ও চিকিৎসাবিজ্ঞান

একদিকে মানুষের অগ্রপশ্চাৎহীন তাৎক্ষণিক লোভ দখল করেছে নদীর পর নদীর নিজস্ব ভূমি, অন্যদিকে জঙ্গল হারানো পাহাড় আর সমতল থেকে হু হু করে নেমে আসছে বন্ধনহীন মাটি। ভরে ফেলছে নদীখাত। যে জল নদী উপছে দুপাশের এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তাকে সযত্নে ধরে রাখবে বাকি বছরের জন্য যে সব পুকুর দীঘি হ্রদ চৌরা, স্বাভাবিক নিম্নভূমির বিল কি জলা, প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই তার। ব্যক্তিগত লাভের জন্য প্রকৃতির জমি দখল করতে থাকা মানুষ ভুলে গেছে এই সহজ কথা যে পৃথিবীর বাইরে কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা সে পাবেনা নিত্যনির্মীয়মাণ ওইসব রাস্তা, মহানগর, প্রমোদস্থল থেকে। তার প্রাণপ্রিয় সন্তানসন্ততিদের ভবিষ্যতও নির্ণীত হবে বিশ্বের অন্যদেরই সঙ্গে। তাই, যে সব বস্তুর যত্ন নেওয়া সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল, সেই পুকুর জলাভূমি জঙ্গল রক্ষার জন্য বিপদ বুঝতে পারা মানুষদের মার খেতে হয়, জেলে যেতে হয়, মামলা করতে হয় প্রায়ই তাদের সঙ্গে যাঁরা দেশকে রক্ষা করার শপথ নিয়েছেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, একথা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল সম্পর্কে বা কোনো বিশেষ ক্ষমতাধারী সম্পর্কেই কেবল প্রযোজ্য, এমন নয়। পরিবেশচর্চা বলে কোনও আলাদা বিষয় থাকতে পারে, নাও পারে, কিন্তু জল বাতাস মাটি খাদ্যশস্য – আপামর সমস্ত মানুষেরই ন্যূনতম প্রাথমিক অধিকার। তার পথ খুঁজে বার করাই এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ।

এই কলামের সব লেখা একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

(জয়া মিত্র দীর্ঘদিন যাবৎ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত)

environment Jol Mati
Advertisment