Advertisment

সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলেন বলেই ভারতরত্ন প্রণব

প্রণববাবু সবসময় বলতেন, "আমেরিকায় প্রধানমন্ত্রীরা বাইবেল স্পর্শ করে শপথ নেন, ভারতে তা হয় না। ভারতে সংবিধানকে স্পর্শ করে প্রধানমন্ত্রী শপথ নেন। এটাই আমাদের শক্তি।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
pranab mukherjee bharat ratna

ভারতের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সম্মান হলো ভারতরত্ন। দেশের রাষ্ট্রপতি, যিনি দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক ব্যক্তিত্ব, এই সম্মান তুলে দেন প্রাপকের হাতে। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এমনকি পদ্মবিভূষণের মতো সম্মানও রাষ্ট্রপতি প্রদান করেন। কিন্তু কাকে কাকে এই সম্মান দেওয়া হবে তা স্থির হয় এক প্রলম্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে একটি বিচারকমন্ডলী গঠিত হয়। তারপর সেই নামগুলি ক্যাবিনেটে মঞ্জুর হয়। ভারতরত্ন হলো ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সেই সর্বোচ্চ সম্মান, যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বা ক্যাবিনেট পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নিজেই নাম চূড়ান্ত করেন। এক্ষেত্রে চাইলে প্রকাশ্যে না হলেও একান্তে রাষ্ট্রপতি কোনও নামের নামের ব্যাপারে 'না' বলে ভিটো দিয়ে দিতে পারেন।

Advertisment

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় অতীতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ভারতরত্ন সম্মান দেন। আর সম্প্রতি প্রণববাবুকেই এই সম্মান দিলেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। প্রণববাবুর নাম প্রস্তাব করেন খোদ নরেন্দ্র মোদীই। মোদী এই সম্মান দিয়ে আসলে গান্ধী পরিবারকেই অস্বস্তিতে ফেলতে চেয়েছেন, এমন একটা ব্যাখ্যা দিল্লির অলিন্দে অলিন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তবে রাহুল গান্ধী এই সম্মানের জন্য প্রণববাবুকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, কংগ্রেস প্রণববাবুর এই প্রাপ্তির জন্য বিশেষভাবে গঠিত, কারণ কংগ্রেসের এক 'আপনজন' তাঁর জনসেবা এবং জাতিনির্মাণে বিশেষ অবদানের জন্য এই সম্মান পেলেন।

তবে রাহুল একথা বললেও, কদিন আগে যখন প্রণববাবুকে এই সম্মান দেওয়া হলো, তখন রাষ্ট্রপতি ভবনের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানটিতে সনিয়া ও রাহুল গান্ধী কেন হাজির হলেন না, এ প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। প্রণববাবু ছাড়া এবছর যে দুজনকে এ সম্মান দেওয়া হয়েছে, তাঁরা দুজনেই প্রয়াত। একজন হলেন ভূপেন হাজারিকা আর অন্যজন হলেন নানাজি দেশমুখ।

নানাজি দেশমুখ আরএসএস-এর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অতীতে রাজনীতি করলেও শেষ জীবনটা তিনি রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে গিয়ে শুধু সমাজসেবার কাজ করেন মধ্যপ্রদেশে। ভূপেন হাজারিকাও একদা আইপিটিএ আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলেন, যেভাবে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা সলিল চৌধুরি বা দেবব্রত বিশ্বাসরা। কিন্তু শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে দূরে সরে ছিলেন। তাঁর পরিচয় ছিল এক মানবতাবাদী শিল্পী হিসেবে। তাই রাজনৈতিক নেতা হিসেবে এবার প্রণববাবুই ছিলেন একমাত্র নাম।

আনন্দের বিষয়, তিনি জীবদ্দশাতেই এই সম্মান লাভের অধিকারী হলেন। ১৯৪৭ সাল থেকে যতজন বাঙালি ভারতরত্ন পেয়েছেন, তাঁদের সংখ্যাও কম। সত্যজিৎ রায় ও রবিশঙ্করের পর তিনিই তৃতীয় ব্যক্তি। বাংলার রাজনেতা হিসেবে তিনিই প্রথম। বাঙালি হিসেবে এজন্য আমরা নিশ্চয়ই গর্বিত। এর আগে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত টি কৃষ্ণমাচারি এবং সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এ সম্মান পান। কলকাতার মানুষ মাদার টেরিজার নাম প্রস্তাব করেন প্রণববাবু স্বয়ং।

মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করার প্রথাই বন্ধ করে দেন। মোরারজি এই রাষ্টীয় ভাবনারই বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এ হলো এক ধরণের বদান্যতা। এজন্য ১৯৭৮ এবং ৭৯, এই দুবছর কোনও পদ্ম সম্মান দেওয়া হয়নি। ১৯৮০ সালের ২৬ জানুয়ারির মাত্র ১২ দিন আগে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে এলেন। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই প্রণববাবুকে ডেকে পাঠালেন। তখন শুধু ক্যাবিনেট নয়, প্রণববাবু রাজ্যসভার দলীয় নেতাও ছিলেন। ইন্দিরা বলেন, "আমি আবার পদ্ম সম্মান চালু করতে চাই।"

প্রণববাবু প্রমাদ গোনেন। বলেন, "এত অল্প সময়ের মধ্যে পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ এসব সম্মান দেওয়া যাবে না। তবে আমরা ভারতরত্ন সম্মান দিতে পারি।" কাকে দেওয়া যায়? এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদারের নাম মাথায় আসে প্রণবের। ইন্দিরা লাফিয়ে ওঠেন। দারুন ব্যাপার। প্রণববাবু শুধু একবার চেক করে নেন যে তিনি আলবেনিয়ার নাগরিকত্ব এখনও রাখেননি তো! দেখা গেল না, তিনি ভারতীয় নাগরিক।

নরেন্দ্র মোদী ২০১৯-এর প্রজাতন্ত্র দিবসের ঠিক একদিন আগে, অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি, প্রণববাবুকে ফোন করে বলেন, "প্রথা অনুসরণ করে আমার নিজেরই আপনার কাছে গিয়ে এ প্রস্তাব দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এখন সময় কম তাই বলছি, সরকার আপনার নাম ভারতরত্নর জন্য স্থির করেছে। আপনি সম্মতি দিলে আমি রাষ্ট্রপতিকে বলব। আমি এ প্রস্তাব দিলে রাষ্ট্রপতি সঙ্গে সঙ্গে তাতে সহমত পোষণ করেছেন। কিন্তু আপনার সবুজ সংকেত ছাড়া রাষ্ট্রপতির কাছে আমি নামটা চূড়ান্ত ধরতে পারছি না।" প্রণববাবু তারপর রাজি হলেন।

কোনও সন্দেহ নেই, প্রণববাবু বাংলার যোগ্য সন্তান। তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, তিনি কিন্তু সংঘাতের পথে না গিয়ে সকলকে নিয়ে, অর্থাৎ নানা মতের মানুষকে নিয়েই চলতে আগ্রহী। খুব সাধারণ এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আজ তিনি কোথায় এসে পৌঁছেছেন, সেটাও দেখার বিষয়। তাঁর জন্ম কীর্ণাহারের মিরিটি গ্রামে। স্কুলের লেখাপড়াও সেখানে। তরুণ বয়সে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশোনা করেন। হাফ প্যান্ট পরা ছেলে, কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে। তখন প্রণব ছিলেন ধীর, স্থির, মিতবাক। লাজুক স্বভাব ছিল তাঁর।

সিউড়ি কলেজ থেকে পাস করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি বিষয়ে এমএ করেন। এলএলবি ডিগ্রিও প্রাপ্ত হন। তারপর দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি কলেজে অধ্যাপনা। তখনও কিন্তু প্রণববাবু জানতেন না, তাঁর ভবিষ্যৎ কোন পথে। ষাটের দশকের মধ্যভাগে মেদিনীপুরের আগস্ট আন্দোলনের নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় দল ত্যাগ করে নতুন দল বাংলা কংগ্রেস গঠন করলে শুরুতেই প্রণববাবু তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা কংগ্রেসের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। এমনকি ওই বাংলা কংগ্রেসের সংবিধানের খসড়াও লিখেছিলেন সেদিনের নবীন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

বাবা প্রয়াত কামদা কিঙ্কর ভারতের এক বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাজ্য কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। সম্ভবত এই গান্ধীবাদী নেতার প্রভাব প্রণববাবুর উপর ছিল। অর্থাৎ রাজনীতি তাঁর রক্তে ছিল। ১৯৬৯ সালে অজয় মুখার্জি তাঁকে বাংলা কংগ্রেস এর সদস্য হিসাবে রাজ্যসভায় পাঠান। তারপর প্রণববাবু আর কখনই পিছনের দিকে তাকান নি। সুদীর্ঘ যাত্রাপথ। শেষ জীবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দপ্তরে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়। শোনা যায়, গান্ধী পরিবার এ ঘটনায় অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু যখন তাঁরা দেখলেন, প্রণববাবু নাগপুরের মঞ্চ থেকে নেহরুর ভারত ভাবনার প্রয়োজনীয়তার কথাই ছত্রে ছত্রে তুলে ধরলেন, তখন সবাই চুপ। আসলে প্রণববাবু নামক মানুষটি থেকে রাজনীতিকে কখনই আলাদা করা যায় না। তিনি রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা মানেন না, চান আলাপ আলোচনা।

প্রণববাবু মানছেন, নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে ভারত এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে হাঁটছে। প্রণববাবু সবসময় বলতেন, "আমেরিকায় প্রধানমন্ত্রীরা বাইবেল স্পর্শ করে শপথ নেন, ভারতে তা হয় না। ভারতে সংবিধানকে স্পর্শ করে প্রধানমন্ত্রী শপথ নেন। এটাই আমাদের শক্তি।" প্রণববাবুর আরও এক উক্তি, "সংবিধানই হলো আমার ধর্মগ্রন্থ, আর সংসদ হলো মন্দির।" প্রণববাবুর সবচেয়ে বড় শক্তি, তিনি সারাজীবন সব ধরণের মত ও পথের মানুষকে নিয়ে চলেছেন। এই সহিষ্ণুতার তিনি এক জীবন্ত উদাহরণ।

৪০ বছর এই সংসদে তিনি দাপটের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। জীবনে যদি কোনও দুঃখ থেকে থাকে, সম্ভবত সেটা একটাই - প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা। সোনিয়া প্রণবকে নয়, মনমোহনকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য। রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন অবশ্য সে দুঃখ মোচন করেছিল অনেকটাই। তবে সবশেষে ভারতরত্নের সম্মানলাভের পর প্রণববাবুর জীবনে আর কোনও অভিমান থাকল না কারোর প্রতিই।

Advertisment