ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়ার হুমকি এখন ম্রিয়মান। কেন্দ্রীয় এজেন্সির বিরুদ্ধে হুঙ্কারও কমেছে। মেট্রো বিভ্রাটে বৌবাজারের ঘটনায় কোনও দোষারোপ নয়, বরং এক হয়ে কাজ করার বার্তা। শেষমেষ বিধানসভায় শাসক ও বিরোধী দুই দলের ধস্তাধস্তি, বাকবিতন্ডা থামালেন অভিভাবকের মতই। এমনকী কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়েও সহযোগিতার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে রাজনৈতিক মহলে এই সমস্ত বিষয় নিয়ে জোর চর্চা চলছে গত কয়েক দিন ধরেই। কী এমন ঘটল, যার ফলে এমন পরিবর্তন? রহস্যটা ঠিক কোথায়? আক্রমণের পাল্টা আক্রমণ ছিল যাঁর মূল পন্থা, সে নীতি এখন অনেকটাই বদলেছে। এখন দেখেশুনে পা ফেলছেন তৃণমূল সুপ্রিমো।
ভোটগুরু প্রশান্ত কিশোর ও আইপ্যাকের সঙ্গে তৃণমূলের চুক্তি হওয়ার পর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। 'দিদিকে বলো' নিয়ে রাজ্য জুড়ে প্রচার করছে তৃণমূল। তাছাড়া জনসংযোগ বৃদ্ধি করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছে তৃণমূল নেতৃত্ব। অভিজ্ঞ মহলের মতে, সব থেকে বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভঙ্গিমায়। অগ্নিকন্যা মমতা, এখন 'প্রশান্ত' মমতা।
সারদা কাণ্ডে মুকুল রায় প্রথম দিন থেকে বলে আসছিলেন তিনি সিবিআইয়ের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা কী ছিল তা তিনিই ভাল জানেন। সিবিআইয়ের মুখোমুখি হয়ে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে তিনি বলেছিলেন তাঁকে তলব করলে ফের তিনি আসবেন। তৃণমূল কংগ্রেসে তখন তোলপাড় হয়ে যায়। সিবিআই বা ইডির ব্যাপারে সবসময়েই খড়্গহস্ত ছিলেন মমতা। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে বিজেপি। সে পরিস্থিতি সম্ভবত বদলেছে। সূত্রের খবর, সাম্প্রতিক সাংগঠনিক বৈঠকে সিবিআইকে তদন্তে সহযোগিতার কথা বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘোষণার পিছনেও কি প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকা রয়েছে? প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলের।
সব থেকে বড় বিষয়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়েছিল। শহরের বাইরে কর্মসূচিতে ব্যস্ত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন সেতু ভাঙা নিয়ে মেট্রো কতৃপক্ষের সঙ্গে রাজ্য সরকারের চরম মতবিরোধ হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীও ঘটনার দায় চাপিয়েছিলেন মেট্রোর ওপর। কিন্তু এবার মেট্রোর সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে বৌবাজারে কয়েকশো পরিবারকে গৃহহীন হতে হয়েছে। ঘর ছাড়তে হয়েছে মন্ত্রী তাপস রায়কেও। বহু বাড়ি ভেঙে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি, "এই সময়ে দোষারোপের পালা নয়। এক হয়ে কাজ করতে হবে।" মেট্রোর বিরোধিতা করে কোনও শব্দ প্রয়োগ করেননি তিনি। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এর আগে কখনও এতটা সংযত দেখা যায়নি মুখ্যমন্ত্রীকে। রাজ্যবাসী এতদিন আক্রমণাত্মক ও প্রতিআক্রমণাত্মক ভূমিকাতেই মমতাকে দেখে এসেছেন। সারা দেশও তাঁকে তেমনভাবেই চিনেছে।
শুক্রবার বিধানসভায়ও বেনজির ঘটনা ঘটিয়ে নজির স্থাপন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শাসক ও বিরোধী পক্ষের গণ্ডগোল চলাকালীন নিজের দলের বিধায়কদের ধমকে বসার নির্দেশ দিয়েছেন। বিরোধীদের নিজেদের আসনে বসার আবেদন জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই ধীর-স্থির ভূমিকা রাজ্য রাজনীতিতে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে এসবের সঙ্গে সকলেই খুঁজছেন প্রশান্ত কিশোরকে। দীর্ঘ বছরের রাজনৈতিক অধ্যায়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এহেন ভূমিকায় দেখেনি বাংলা।