Advertisment

যে সমাজ সততার পথে বাধা সৃষ্টি করে, তার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হয় মাত্র

কোনও সমস্যার সমাধানে আমার নেওয়া সিদ্ধান্তকে অযাচিত পক্ষপাতিত্ব হিসাবে দেখা হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে আমলারা কাজ করবেন, এটাই প্রত্যাশিত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
ashok lavasa

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

"অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি", অর্থাৎ, সততাই সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি। স্কুলজীবনে ডিবেটের অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয়। এটা অন্য প্রশ্ন যে শেষমেশ পক্ষ এবং বিপক্ষ উভয়েই এ ব্যাপারে একমত হয়ে যেত। যার ফলে বিতর্কের একমাত্র বিষয় তখন হয়ে দাঁড়াত, সততার পুরস্কার কি স্বয়ং সততা, নাকি পরিহার্য মূল্য দিতে হয় তার?

Advertisment

এই নীতির সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। নীতি ব্যাপারটাই তৈরি হয় বিভিন্ন বিকল্পের ভালো-খারাপ বিবেচনা করে নিয়ে। নীতির সংজ্ঞা হতে পারে, "নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নিজের বিবেচনা অনুযায়ী সমীচীন পদক্ষেপ নেওয়া", বা "বিচক্ষণ অথবা যুক্তিযুক্ত আচরণ"। যেটিই হোক, তা যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা করে গৃহীত পদক্ষেপ, শুধুমাত্র সহজাত চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে একজন ব্যক্তির বদ্ধমূল প্রতিক্রিয়া নয়।

সততা কি তাহলে কোন একটি পরিস্থিতিতে বাস্তববাদী এবং বিবেচক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদ্ধতি? না কি কোনও একটি পরিস্থিতিতে নৈতিক প্রতিক্রিয়া মাত্র? যখন কোনও ঘটনায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসে, একাধিক প্রতিক্রিয়ার মধ্য থেকে একটিকে বেছে নেওয়ার সময় আসে, তখন মানুষ হয় স্বভাবজাত প্রবৃত্তির বশে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেয়, বা নেয় অনেক ভাবনাচিন্তা করে।

যেমন ধরুন, একজন অটোচালক কোনও আরোহীর পার্স কুড়িয়ে পেলেন নিজের গাড়িতে। তিনি তখন আরোহীটির খোঁজ করতে পারে, পার্সটি থানায় জমা দিতে পারেন, বা বিষয়টি অটোর মালিককে জানাতে পারেন। যতক্ষণ না তিনি পার্সটি নিজের কাছে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তিনি সততার পথ ধরেই চলছেন। এই সততার জন্য তিনি হয়তো পুরস্কৃত হবেন না। কিন্তু তবু অন্যের জিনিস পকেটস্থ করার পরিবর্তে তিনি বিবেকের ডাকে সাড়া দেওয়াকেই বেছে নিচ্ছেন।

এটা অবশ্য একটু সরলীকৃত উদাহরণ হয়ে গেল। নীতি হিসাবে সততাকে একটা মূল্য দিতেই হয়। অনেকটা বীমার প্রিমিয়ামের মতো। সততার যাত্রাপথ অনেকটা ধর্মের মতো। সরলরেখায় তার চলন, কিন্তু আদতে সরল নয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এ যাত্রা প্রাণশক্তি শুষে নেয় অনেকটা, যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে প্রায়শই। রাস্তার খারাপ অবস্থার জন্য গাড়ি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনেকটা তেমনই। সৎ মানুষরা কিন্তু তবু সেই রাস্তা ধরেই চলতে থাকেন, পরিণতির কথা চিন্তা না করে, প্রায় বেপরোয়াভাবেই। যে সমাজ সৎ মানুষের যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টি করে, সততাকে আঘাত করে, সে সমাজ নিজের অধঃপতনের পথই প্রশস্ত করে।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সততা বিষয়টি বাতিকে পরিণত হওয়া কি কাঙ্খিত? সততার তাগিদ কি এতই আগ্রাসী হওয়া উচিত যে দিনের শেষে শুধু তারই অস্তিত্ব থাকবে সর্বময়? পরিণতির কথা চিন্তা না করে কোনও একটি নীতির লালনপালনে কি এতটা একমুখী হওয়া উচিত, যে শেষ বিচারে সেই নীতি নিজেকে রক্ষা করা ছাড়া বাকি সবকিছু নিয়ে উদাসীন থাকবে? সততার পরিচর্যায় যদি সবাইকে একটি সীমায়িত আদর্শের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হয়, তা সমাজের পক্ষে ফলপ্রসূ হতে পারে না। বরং এতে জন্ম নেয় এমন এক সমাজ, যার কাছে নীতির কষ্টিপাথর ছাড়া আর কিছুই নেই দেখানোর মতো।

সৎ তাঁরাই, যাঁরা নিজের কাজের প্রতি সৎ এবং কোন পারিপার্শ্বিক প্রভাবমুক্ত থেকে, যাঁরা সৎ ভাবে নিজের পরিশ্রমকে সামাজিক সুফলে পরিণত করার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ, জনগনের বৃহত্তর চাহিদার কথা মাথায় রেখে যদি কোনও সরকারি আমলা কোনও সিদ্ধান্ত নেন, সেটা কিন্তু সবসময় অসৎ কাজ নয়। শাসনযন্ত্রের বর্তমান চাপের কাছে নতিস্বীকারই বরং অসততা।

জনস্বার্থকে কোনভাবে বিঘ্নিত না করে যদি কোনও সরকারি আধিকারিক কোনও ব্যক্তিবিশেষের উপকার করেন, তাকে অসৎ কাজ বলা যায় না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার তালিকায় ফেলা যায় না কাজটিকে। নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বরিষ্ঠ পদাধিকারীদের থাকা উচিত। হাজারো নিয়মকানুন আর বিধিনিষেধের সমষ্টিগত বেড়াজালে অনেক সময় ব্যক্তিবিশেষের কোনও জটিল সমস্যা উপেক্ষিতই থেকে যায় আমাদের সমাজব্যবস্থায়। স্রেফ যান্ত্রিকভাবে নিয়মনীতির অনুশীলনেই যদি আমলারা আসক্ত হয়ে পড়েন, তাহলে আমলাতন্ত্র ক্রমে এক জগদ্দল পাথরে পরিণত হয়, মানুষের হিতসাধনের পরিবর্তে যার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় নিয়মকানুনের রক্ষণাবেক্ষণ।

দুর্নীতিরোধ সংক্রান্ত আইনের (Prevention of Corruption Act) উদ্দেশ্য হল অসৎ উদ্দেশ্যে নেওয়া কোনও সিদ্ধান্তের প্রতিরোধ করা। কিন্তু তা যদি কোনও সদর্থক উদ্যোগকে স্তিমিত করে দেওয়ার ভূমিকা নেয়, তখন কিন্তু আবার আমলারা নেহাত হুকুম তামিলকারী ভৃত্যে পরিণত হন। কোনও সমস্যার সমাধানে আমার নেওয়া সিদ্ধান্তকে অযাচিত পক্ষপাতিত্ব হিসাবে দেখা হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে আমলারা কাজ করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। সমস্যা সমাধানে তাঁদের ক্ষমতাকে যদি আটকে দেওয়া হয় নিয়ন্ত্রণের ঘেরাটোপে, তখন আমলারা পর্যবসিত হন নখদন্তহীন নেহাতই সাদামাটা এক পরাজিত সৈন্যবাহিনীতে।

একজন সৎ মানুষের মূল চরিত্রবৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সত্যবাদী। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, একজন সৎ মানুষ সেটা মূলত নির্ধারণ করেন তাঁর অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে। তাঁর সিদ্ধান্তের পরিণতি কী হতে পারে, কতটা ঝুঁকি থাকতে পারে সেই সিদ্ধান্তে, এ নিয়ে একজন সৎ মানুষ কদাচিৎ ভাবিত থাকেন। আর ঠিক এখানেই 'ভালো' হওয়ার সমস্যা। কেউ সততাকে বোকামো আখ্যা দেবেন, কেউ বলবেন বিচক্ষণতার অভাব। 'বিচক্ষণতাই' সফল আমলাদের 'রক্ষাকবচ' কিনা!

অন্য সব কিছুর মতো জীবনে সততারও একটা মূল্য আছে। সেই মূল্য চোকানোর জন্য প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে প্রস্তুত হওয়াটাও সৎ পথে চলার প্রক্রিয়ার একটা জরুরি অংশ। বলা হয়ে থাকে, সৎ থাকাটাই সততার পুরস্কার, এবং শেষমেষ সততা তার স্বীকৃতি পায়ই। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় এই 'শেষমেষ' যে কবে আসবে, তার কোন স্থিরতা নেই। অপেক্ষা অনেকসময় দীর্ঘায়িত হয়েই চলে। যাঁরা সততার বিপক্ষে, তাঁরা মেনে নিতে পারেন না সততার উদযাপন, এবং প্রত্যাঘাত করেন। একাকী কষ্টযাপনের মাধ্যমে সততার মূল্য চোকাতে হয় সৎ মানুষটিকে। শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলতেও শুরু করেন কখনও কখনও। যাঁরা নির্ভীক সততাকে ভয় পান, এবং যাঁরা ভীতি উদ্রেককারী ক্ষমতাবানদের দ্বারা সন্ত্রস্ত, এই দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এ এক পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়ন।

এটা ভেবে নেওয়াটা অবশ্য অতিসরলীকৃত বাড়াবাড়িই যে যাঁরা সৎ মানুষদের পাশে দাঁড়ান না, তাঁরা অসৎ। সাধারণভাবে দেখলে বেশিরভাগ মানুষই ভালো, কিন্তু একই সঙ্গে ভীতুও। ভয়ের সঙ্গে সবসময় অশুভ অনুষঙ্গ জুড়ে দেওয়া অনুচিত; ঠিক যেমন এটাও ভেবে নেওয়া অসঙ্গত যে নির্ভীকতা মানেই তা শুভ এবং ইতিবাচক। সাহস মানে ভয়ের অভাব। এবং সাহস ছাড়া সততা একেবারেই মূল্যহীন।

সৎ মানুষরা হয়তো শারীরিক ভাবে শক্তিশালী না-ও হতে পারেন, ক্ষমতাবান না-ও হতে পারেন। কিন্তু সৎ যাঁরা, তাঁদের সাহস থাকে। আর সেটাই তাঁদের জোরের জায়গা। সৎ মানুষদের দুঃসময়ে, একা হয়ে পড়ার সময়ে যাঁরা তাঁদের পাশে থাকেন না, তাঁদের সাহসের অভাব থাকে। তাঁদের ভূমিকা সেই দর্শকদের মতো, যাঁরা নাটকটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দেন। তাঁদের যদি সংশ্লিষ্ট সৎ মানুষটির প্রতি সহানুভূতিও থাকে, নাটকে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন না তাঁরা।

তাঁরা হয়তো সৎ মানুষটিকে কষ্ট পেতে দেখেন, তাঁর দুঃখে দু-ফোঁটা চোখের জলও ফেলেন, নিঃশব্দে হয়তো প্রার্থনাও করেন তাঁর জন্য, এবং নাটকের চূড়ান্ত পরিণতির পর তাঁর প্রশংসাও করেন। ইতিবাচক পরিণতিতে তাঁরা খুশি হন, বিয়োগান্ত পরিণতিতে হতাশা ব্যক্ত করেন। নীরব দর্শক না থাকলে আর নাটক কেন? এই দর্শকরা 'to be or not to be’-র দোদুল্যমানতায় আক্রান্ত। আর নাটকের কুশীলব যিনি? সে তিনি ক্ষমতাবানই হন বা নেহাত ছাপোষা, নিজের বিশ্বাসে শেষ পর্যন্ত অনড়ই থাকেন যে, সততাই শ্রেষ্ঠ নীতি।

(অশোক লাভাসা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সদস্য)

Advertisment