/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/06/prosenjit-1-1.jpg)
এ বছরের মার্চ মাসে আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার ছবি কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তনের শুটিং করছিলাম। প্রায় ৩৫-৪০ জনের বড় ইউনিট ছিল। ১৫ মার্চ নাগাদ করোনাভাইরাসের খবর এলে আমার টিম হতচকিত হয়ে পড়ে। পরের ৪৮ ঘণ্টায় পৃথিবী বদলে গেল- প্লেন বন্ধ হয়ে গেল, লক ডাউন শুরু হল, সব মিলিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তা তখন। আমরা কোনওমতে ১৯ মার্চ দেশে ফেরার টিকিট জোগাড় করলাম, গোটা ক্রু টিম ১৪ দিনের হোম কোয়ারান্টিনে গেল।
আমি আমার কলকাতার বাড়ির চার তলায় চলে গেলাম, কারও সঙ্গে দেখা করতাম না। আমার খাবার পাঠানো হত লিফটে করে। আমি বাসন ধোয়া থেকে সব কাজ নিজে করতাম। আমি সাধারণত ফোনে অনেক সময় কাটাই না, কিন্তু তাও চেষ্টা করলাম। পরিবারের সঙ্গে, বিদেশ থেকে বাড়ি ফেরা ছেলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতাম। কখনও কখনও খুব একা লাগত, আপসেট লাগত, আমার কাছে ফোন ছাড়া কিছু ছিল না।
১৪ দিন পর, আমি যখন চারতলা থেকে নিচে নামলাম, মনে হল যেন নির্বাসন থেকে ফিরেছি। ততদিনে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছেন এবং তখন থেকে আর ছুটির ব্যাপার নেই, বিশেষ করে সারা দুনিয়ায় যে ভাবে সংকট ঘনীভূত হতে থেকেছে।
আমি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা শুরু করেছি। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা এবং বাড়ি থাকার ফলে দিনগুলো খুব বড় হয়ে যাচ্ছিল। ঘুমোনোর সময় বদলানোর জন্য কাজ শেষ করার পর আমি ভোর ৪ টে ৫ টা পর্যন্ত নেটফ্লিক্সের শো দেখি। দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে সন্ধে তাড়াতাড়ি হয়। মনে হয় দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার টিমের অনেকেই এইরকম মনে করছেন। তাঁরাও চাইছেন দিনটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাক।
কোভিড-১৯ সংকটের সময়ে আমার রাজ্য আমফান ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠছে। আমরা সবাই মিলে লড়ছি বটে, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাস্থ্যকর নয়। এমনকী আমাদের মানসিক স্থিতিও স্বাস্থ্যকর নয়। সবাই অন্যদের পাশে দাঁড়ানোর সবরকম চেষ্টা করছে, কিন্তু তার সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। আমার ছবির শুটিং শেষ হলে শিবপ্রসাদ মুখার্জি ও নন্দিতা রায়ের সঙ্গে ফিল্ম শুরু করার কথা আমার।
এর পর এপ্রিল মাস থেকে একটা হিন্দি সিরিজে কাজ করার কথা ছিল বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানের (স্যাক্রেড গেমস, উড়ানের পরিচালক) সঙ্গে। এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রজেক্ট, কিন্তু আমরা এখন শুট করতে পারছি না। তবে আমরা চেষ্টা করছি চাকাটাকে ঘোরাবার। বাড়িতে থাকার এই সময়টায় আমি বুঝতে পেরেছি কোনটা গুরুত্বপূর্ণ। নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে শুরু করেছি, দীর্ঘদিনের পড়ে থকাা স্ক্রিপ্ট পড়ছি, বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে টিমের সঙ্গে আলোচনা করছি।
একদিন অমিতাভ বচ্চনের কাছ থেকে একটা ফোন পাই, মেড-অ্যাট-হোম শর্টফিল্মে অংশ নেবার জন্য, যে ছবিতে করোনাভাইরাস অতিমারীর সময়ে বাড়িতে থাকার গুরুত্বে কথা প্রচারিত হয়েছে। মোহনলাল, রজনীকান্তের মত অভিনেতারা এই ছবিতে ছিলেন। আমি রাজি হই।
সে সময়ে আমি বুঝতে পারি আমাদের মত সেলিব্রিটিদের কাছ থেকে এরকম সময়ে মানুষ কী প্রত্যাশা করেন। বাড়িতে ভিডিও শুটিংয়ের সময়ে আমরা সবাই বলছিলাম অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া কত বড় ব্যাপার, মোবাইল ক্যামেরার সামনে হলেও শুটিংয়ে সুযোগ পাওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ। পরে এই আইডিয়া গ্রহণ করেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমি আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জুনিয়র টেকনিশিয়নদের জন্য অর্থসংগ্রহ প্রকল্পে সাহায্যের উদ্দেশ্যে একটা গান রেকর্ড করি।
সারা পৃথিবীতেই বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ফিল্ম বানানো হয় বড় সংখ্যক ক্রু দিয়ে এবং হলে গিয়ে বিশাল সংখ্যক দর্শকরা সে ফিল্ম দেখলে তাকে সফল বলে ধরা হয়। মিরাকেল ছাড়া কেউ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারবেন না তেমনটা কখন ঘটবে। কিন্তু হ্যাঁ, আমাদের লড়তে হবে। বাংলায় টেলি শোয়ের শুটিং শুরু হয়েছে, সেটা একটা রুপোলি রেখার সন্ধান দিচ্ছে। তবে ফিল্মের শুটিংয়ে সময় লাগবে কেননা আমরা সরাসরি সিনেমা হলের সঙ্গে যুক্ত - মল খুললেও হল খোলেনি। আর সিনেমা হল যদি খোলেও তাহলে বিশাল সংখ্যক মানুষ কি আবার টিকিট কাটবেন?
লকডাউনের সময়ে অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ও ওয়েব সিরিজ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এবং প্রচুর আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম খুলতে ভারতে আসছে। অনেক প্রতিভাবান অভিনেতা ও টেকনিশিয়ানদের জন্য এগুলি মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও সিনেমা থাকবে। সিনেমার নিজস্ব জাদু রয়েছে যা পড় পর্দাতেই দেখা যায়। এর সঙ্গে একা বসে কিছু দেখার কোনও তুলনা হয় না।
বাংলায় টেলিভিশনের শুটিং শুরু হয়েছে, দেশে এই প্রথম অভিনেতা-অভিনেত্রী ও টেকনিশিয়ানদের জন্য বিমার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সিনেমাতেও বিমা নিয়ে কথা বার্তা চলছে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে আমরা যে কোনও সময়ে শুটিং শুরু করতে পারি এবং আমার ফেরার তর সইছে না। সেট, ক্যামেরা, সহ অভিনেতা-অভিনেত্রী, টেকনিশিয়ান, আমার মেক আপ ভ্যান, এসবের গন্ধ বড় মিস করছি। গত ৩৮ বছর ধরে এই মানুষগুলোর সঙ্গে, এই পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে দিন কাটিয়েছি। আমায় এসবের কাছে ফিরতে হবে, দর্শকদের কাছে ফিরতে হবে।