সারাদিন চিন্তায় থাকি। বুঝতে পারি না আমি বিজেপির দিকে, না বিরুদ্ধে, নাকি ঠিক মাঝামাঝি। মাঝের আবার টাল থাকে। মানে একদিকে হেলে থাকা, এই যেমন ধরুন একশোর মধ্যে সাতাত্তর বিজেপি আর তেইশ নকশাল। পরমবীর চক্র পাওয়া বীর সেনানীর কার্গিল অভিযানের গল্প শুনে রক্ত গরম হয়ে ওঠে। মনে হয় এক্ষুনি সীমানা পেরিয়ে পড়শি দেশের কয়েকটা সৈন্যকে টপকে দিয়ে আসি। আবার তার পরেই বাম নেতা এসে যদি মনে করিয়ে দেন যে আধার কার্ড বানাতে সতেরো বার আঙুলের ছাপ আর চোখের মণির ছবি দিতে হয়েছিল, তখন রক্তটা সরীসৃপের লোহিতকণিকার মত পরম শূন্যতে পৌঁছে যায়। কোন দিকে যে যাব,, এটা বুঝতেই সকাল থেকে বিকেল গড়ায়।
মনে পড়ে ছোটবেলার কথা, সত্তরের দশক। কৃষ্ণনগরের উপকণ্ঠে বর্ধিষ্ণু ঘূর্ণী গ্রাম। সেখানে আদিত্যপাড়া থেকে বেলতলা বাজারে যাওয়ার রাস্তায় সেবাপিসির বাড়ি। পিসেমশাই সরকারি অফিসের কেরানি। পেটের সমস্যায় নিয়মিত দই-চিঁড়ে খান। তখনও বিজেপির কৈলাস বিজয় হয়নি। পোহা তখনও চিঁড়েই ছিল, মিষ্টি কথায় ভিজত। পিসে সকালবেলা চান-খাওয়া সেরে পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে অফিসের দিকে রওনা দিচ্ছেন। অফিস যাওয়া খুবই জরুরি, কারণ ক্যাজুয়াল লিভ শেষ, মেডিকেল লিভ কোঁকাচ্ছে। ঠিক সেই সময় পাড়ার চ্যাংড়া ছোঁড়া এসে বলে গেল "কাকু, সামনের রাস্তায় ব্যাপক গোলমাল। গাড়িঘোড়া বন্ধ। মনে হয় একটা লাশ পড়েছে।"
আরও পড়ুন: ‘দিল্লি পুলিশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই
এই পরিস্থিতিতে মাইনে কাটা যায় যাক, মুণ্ডুটাকে তো রাখতে হবে। সামনের বাগানটুকু পেরিয়ে বেড়ার দরজাটা সবে খুলেছিলেন পিসেমশাই। চটজলদি নারকোল দড়ি পেঁচিয়ে বেড়ার গায়ে কষে গিঁট দিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলেন। পোশাক বদলাল, ধুতি ছেড়ে ঘরে পরার লুঙ্গি - সময়ের ঘড়ি পিছিয়ে মোদী সাহেব সে পোশাক দেখলেই ব্রাহ্মণ পুত্রকে কাফের ঠাওরাতেন। সেদিনের মত অফিস যাওয়া বন্ধ। আর একটা ছুটি কাটার যাতনায় বিড়বিড় করতে লাগলেন সেবাপিসির বর, "সব বেটাকে চিনি, সিপিএম বা কংগ্রেস বলে কিছু হয় না। আসলে সব নকশাল। রাস্তায় বেরোলেই গলা কেটে নেবে। ভাগ্যিস পাড়ার ছেলেটা গোলমালের খবর সময়মত জানিয়ে দিয়ে গেল।"
পরিণত হয়েছে প্রজাতন্ত্র, আর তাই তো এই কথামালার প্রায় অর্ধশতক পেরিয়েছে। সৌভাগ্যের বিষয়, সেই সত্তরের দশকে বিজেপি বা তৃণমূল ছিল না। থাকলে তারাও সব নকশাল হয়ে যেত।
সে নকশাল মাথায় 'নগর' জুড়েছে, গত দশকে হারিয়ে যাওয়া বামশক্তির এখন রমরমা। বছর দুই আগে নাসিক থেকে মুম্বই পর্যন্ত যখন কৃষক মিছিল হেঁটেছিল, তখন থেকেই নাকি বামপন্থার পুনর্জাগরণ। বোঝালেন, পায়ে ফোসকা নিয়ে হাঁটা মানুষগুলো পশ্চিমবঙ্গে চৌত্রিশ বছরে শেষ কুড়ির মুনাফা হাতড়ানো বাম নয়, একেবারে সাচ্চা। তবে বিশুদ্ধ বামেদের কাছে সংসদ তো খোঁয়াড় মাত্র। তাই ভোটে জিতছে সেই বিজেপি, কোথাও কোথাও বা নামে বিরোধী, অথচ ঠিক একই নীতিবোধের প্রজাতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, কংগ্রেস আর এনসিপি এক, আর শেষ দুদলের সমর্থনের ফলে ভোটে জেতা বামেদের একমাত্র বিধায়ক ব্রাত্য। বিজেপি সেখানে আর ক্ষমতায় নেই, কিন্তু ভীমা-কোরেগাঁও আন্দোলনে মিথ্যে মামলায় ফেঁসে যাওয়া বুদ্ধিজীবীরা এখনও ভুগছেন।
আরও পড়ুন: বিধানসভায় সিএএ বিরোধিতা: শ্যাম রাখি, না কুল
নগর-নকশালরা যতই চিৎকার করুন না কেন, রাহুল বাবার দলে সেই নিয়ে কুমীর নামক এক সরীসৃপের কান্না ছাড়া আর কোন উদ্যোগ নেই। বরং উদ্বেগ অনেক বেশি ছিল চিদাম্বরমকে নিয়ে। তাই আজকের দিনে নাগরিকত্ব কচলেও বাম ভোটে তার প্রতিফলন হবে কিনা, সেই নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। সমীক্ষা চলছে প্রচুর। কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে পশ্চিমবঙ্গের বাম বারো শতাংশে পৌঁছবে, নাকি সাত শতাংশে নামবে, সেই নিয়ে গভীর আলোচনায় সন্ধের পাট করে চুল আঁচড়ানো রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে ছোটার অবকাশে মুখে পাউডার বোলানোর সময়টুকুও জোটে না।
বিপ্লবের দিনলিপি খোদাই হচ্ছে গ্রাম থেকে শহরে। বক্তারা স্টুডিয়োয়, পথে বাম। “দেখাবো না কাগজ” কলরবে অনুপ্রাণিত হয়ে অঅঅ, অর্থাৎ “অতিবাম অবিরত অভিযান” মোর্চার তরফে চলছে আন্দোলন। এই যে গরীব-গুর্বোদের রক্ত ক্রমাগত শোষণ করছে পুঁজিপতিরা, এবং তাদের পেছনে যে আদানি-আম্বানী-আডবাণী (আআআ), তার বিরুদ্ধে লড়াই করে হক ছিনিয়ে নিতে হবে বামেদের। অমিত-মোদীর নাম এখন করা যাবে না, কারণ সেক্ষেত্রে টিকিধারি হলেও দেশদ্রোহের টিকিট ধরাবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপপ্রচার যতই হোক না কেন, ছবি আঁকতে হবে গানে আর কবিতায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিঁড়িতে ভেসে উঠবে চে গুয়েভারার মুখ। পাশ দিয়ে পা টিপে টিপে ক্লাসে ঢুকতে হবে। তবেই না আমরা অতিবাম, তবেই তো বিপ্লবের দীর্ঘজীবী হওয়া।
কিন্তু মাথাটা গুলিয়ে যায় যখন সেই পথেই বিপ্লব দেবকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে যেন ভোট বাড়ায় বিজেপি। মাঝে মাঝে নিজের আঙুলটাকেই সন্দেহ হয়, কী টিপতে গিয়ে কী টিপি ভোটযন্ত্রের কী-বোর্ডে। আজকের দিনেও দেশজোড়া সমীক্ষাতে মানুষ বলছে অর্থনীতির অবস্থা কেরোসিন, কিন্তু মোদীর জনপ্রিয়তা এতটুকু কমে না। শাহিনবাগ কি তাহলে শব্দ এবং স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়? বড়জোর কংগ্রেস কটা ভোট কেটে নিতে পারে বলে দিল্লির রাজপথে জাতীয়তাবাদী আপের বিলম্বে বোধোদয়? দিল্লির রাতজাগা অতিবামেরা তাহলে করছেনটা কী? শুধুই সেমিনার আর রংবেরঙের মিছিল?
আরও পড়ুন: প্রজাতন্ত্র-৭০: দলীয় সত্যের সঙ্গে মানবধর্মের মতো চিরসত্যের সংঘাত
সেই মিছিলে এখন লাল পতাকার সঙ্গে তেরঙাও দুলছে। নাগরিকত্বের উষ্ণতায় এবারের চার অক্ষরের (যুক্তাক্ষর চলবে) প্রজাতন্ত্র দিবস অন্য মাত্রায়। গণতন্ত্র সূচকে দশ ধাপ নেমে যাওয়া দেশ জন আন্দোলনে উত্তাল। এই প্রথম নাকি বোঝা গেল যে সংবিধান উচ্চমানের ধর্মগ্রন্থের মত একেবারে পবিত্র। তাকে পুজো করতে হয়, মাথার কাছে নিয়ে ঘুমোতে হয়, গরুমারা চামড়ার খাপে ভরে বুকপকেটে রাখতে হয়। কিন্তু এটা তো সত্যি যে গত ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তার সংশোধন হয়েছে একশো-চার বার। অর্থাৎ প্রাথমিকের একটা নামতার বই যতটা সত্য, তার থেকে সম্ভবত বেশি সত্য নয় একটি দেশের সংবিধান। সেটা বদলায়।
আদতে সংবিধানের বইটি একটি প্রতীক মাত্র। যাকে হাতে নিয়ে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেন ভারতবাসী। তাহলে এই দিনটিতে বিভিন্ন রাজপথে অস্ত্র প্রদর্শন কেন? কেন শক্তির প্রকাশ? গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্যে সেনাবাহিনীই কি একমাত্র ভরসা? ভারতে তো এতদিন ধরে একমাত্র বিজেপি ক্ষমতায় ছিল না, তাহলে সেই সময় শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক ট্যাবলো নিয়ে কেন প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করেন নি বিভিন্ন নির্বাচিত সরকার? এর মূল কারণ হলো, বামই হোন বা ডান, ক্ষমতায় এলে সবাই শাসক। তখন রাস্তায় লড়াই করা দিনগুলোর কথা ভুলে যান দেশের নেতানেত্রী। দেশ চালানোর জন্যে তখন বারবার উচ্চারিত হয় শৃঙ্খলার কথা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ছাপ দেওয়া হয় দেশদ্রোহিতার।
আরও পড়ুন: ২১ শতক এত চরম মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠল কেন?
বিশুদ্ধ নাগরিক গণতন্ত্র রক্ষায় সরকার গড়ে, আর সেই ভোটেই জেতা শাসক ডানদিক থেকে বাঁদিকে খুঁজে বেড়ায় নকল নাগরিকত্ব। রাজধানীর রাজপথে সৈন্যসামন্ত নিয়ে দেশ শাসন করেন রাজা। সে রাজধানী মস্কোই হোক, কিংবা বেজিং, দিল্লি হোক, কিংবা রিও ডি জেনেরো। ভারতবর্ষের প্রজাতন্ত্র দিবসে অতিথি হলেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রনায়ক। দক্ষিণপন্থী দেশনেতা অন্য এক দক্ষিণপন্থীকে আমন্ত্রণ করবেন, তা তো বলাই বাহুল্য। তবে একটু অন্যরকমভাবেও তো ভাবা যেতে পারত। কেমন হতো যদি একাত্তরতম (সত্তরতম বর্ষপূর্তি) প্রজাতন্ত্র দিবসে ব্রাজিলের ফুটবল দল ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় নামত দিল্লির ঘেরামাঠে? দুদেশের বন্ধুত্বের ঘেরাটোপে সত্তর কিংবা একাত্তরটা গোলও হয়ত খেতে হতো না, আর একটু অন্যরূপে দেখতে পাওয়া যেত এ দেশের গণতন্ত্রকে।
একটি দেশের সংস্কৃতি নির্ভর করে সেদেশের মানুষের আত্মা এবং হৃদয়ের যোগফলে। ক্ষমতায় থেকে সেইসব মানুষের কথা শুনতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ সহজ, নেতারা তো শাসক, নাগরিক নন! সেই নেতাদের প্রশ্রয়েই পুলিশের সামনে পিস্তল হাতে ভারতনাট্যমের ছন্দে নেচে নেচে গুলি চালান দেশপ্রেমিক। প্রজাতন্ত্র দিবসে তাই উচ্চকণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত সম্পূর্ণ করে অনেকেই ফিসফিস করে বলেছেন, "মানুষ বড় ভয় পেয়েছে, মানুষ বড় নিঃসহায়"। আগামী বছর সংবিধানের বাহাত্তুরে ধরার আগে দেশের প্রৌঢ় নেতাদের ভীমরতি যাতে আর না বাড়ে, সেই কামনা করেই আপাতত সামনের পথ হাঁটা যাক। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র সেই আশাতেই বাঁচবে, একশো তিরিশ কোটির সবল নাগরিকত্ব সমেত।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)