Advertisment

জন ও স্বাস্থ্য: সুস্থতার দিকে… রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতা

কোনো রোগের পিছনে অজানা কিছু ঝুঁকি থাকার মানে এই নয় যে চিহ্নিত ঝুঁকিগুলো মূল্যহীন। ঝুঁকিগুলো কমালে আপনি চিরায়ু হবেন না, শুধু নির্দিষ্ট কিছু রোগ হবার সম্ভাবনা খানিকটা কমবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Health

প্রতীকী ছবি

সুস্বাস্থ্যের প্রথম বা প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত রোগ-ব্যধি থেকে মুক্ত থাকা। গুরুতর রোগের চিকিৎসা কীভাবে হবে, তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানই বা হবে কোথা থেকে, এসব দুশ্চিন্তায় আমরা দিন কাটাই। সেই অর্থ জোগাড় করার চেষ্টায় কালাতিপাত করি। ভেবে দেখুন, ততটা গুরুত্ব দিয়ে আমরা অনেকেই রোগমুক্ত জীবন লাভ করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা বা চেষ্টা করি না, যদিও চিকিৎসার খরচ থেকে মুক্তি পাবার একটা নির্ভরযোগ্য উপায় হল রোগাক্রান্ত হবার সম্ভাবনাকে যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলা। তাতে শুধু চিকিৎসার খরচ বাঁচে, তাই নয়, এড়ানো যায় আরও অনেক ক্ষতি, যেমন অসুস্থতাজনিত বিভিন্ন কষ্ট, পড়াশোনা বা কাজের সময় নষ্ট (বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতদের জন্য পদোন্নতি না হওয়া, এমনকি চাকরি হারানোর ভয়) এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা (নিজের পরিচিত মণ্ডল থেকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া থেকে শুরু করে কিছু ক্ষেত্রে মূলত কুসংস্কারের কারণে একঘরে হয়ে যাবার ভয়) ইত্যাদি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, নিরোগ স্বাস্থ্য নিয়ে আপনি যেমন জীবন কাটাতে পারবেন, বারবার রোগে ভুগে অতি উন্নত চিকিৎসায় সুস্থ হয়েও ততটা ভালো জীবন পাবেন না। সুতরাং সুস্থতার তথা রোগ প্রতিরোধের বিকল্প নেই।

Advertisment

মানুষের অসুখ হবার বহু রকম কারণ থাকে। কয়েকটি রোগ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে একটি রোগের জন্য মাত্র একটিই কারণকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। যেমন জলাতঙ্ক রোগের জন্য আমরা নির্দিষ্টভাবে র‍্যাবিস ভাইরাসকে দায়ী করতে পারি এবং তার বাহক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি কুকুর, বেড়াল, শেয়াল, মেঠো ইঁদুর জাতীয় বেশ কিছু প্রাণীকে। অপরপক্ষে অমুকের হৃদরোগ কেন হল প্রশ্ন করলে উত্তরটা সব রোগীর ক্ষেত্রে এক হবে না। সম্ভবত কারো ক্ষেত্রেই স্থির প্রত্যয়ে বলা যাবে না যে শুধুমাত্র রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা অথবা ডায়াবেটিস অথবা সিগারেট খাওয়ার কারণে এটা হল। হয়ত সবকটিরই কিছু কিছু ভূমিকা আছে। এসব ক্ষেত্রে আলোচনা হতে পারে ক্ষতিকর উপাদান বা ঝুঁকি (risk factors) নিয়ে। বিভিন্ন রোগ সংক্রান্ত গবেষণায় ক্রমশ এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি চিহ্নিত হতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের জানা রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর সাহায্যে একটি রোগ হওয়া বা না হওয়া সম্বন্ধে একশ' ভাগ নিশ্চিত করে ভবিষ্যদ্বাণী করা না যাচ্ছে, ততক্ষণ মেনে নিতে হবে যে রোগটির কারণ সম্বন্ধে আমরা যা জানি, তা অসম্পূর্ণ। এর বাইরেও কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর নিশ্চয় আছে, যার কথা আমরা ভবিষ্যতে জানতে পারব।

আরও পড়ুন, স্বাস্থ্য ভিক্ষা নয়, অধিকার

ধরা যাক 'ক'-বাবুর মধ্যে হৃদরোগের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে পাওয়া গেল তাঁর ষাট বছর বয়স, পুং-লিঙ্গ (অন্য কিছু রোগের ক্ষেত্রে স্ত্রীলিঙ্গ একটি ঝুঁকির কারণ), পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস, মধুমেহ (ডায়াবেটিস), উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল, ধূমপান, সারাদিন বসে কাজ করা, শারীরিক ব্যায়ামের অভাব ইত্যাদি। এতকিছু জেনে ভয় পেয়ে যাওয়া ছাড়া 'ক'বাবুর আর কী উপকার হবে? উপকারের কথা ভাবতে গেলে খুঁজতে হবে এই ঝুঁকিগুলোর মধ্যে পরিবর্তনযোগ্য কারা? বয়স, লিঙ্গ বা বংশের ইতিহাস (অর্থাৎ জিনগত ঝুঁকি) বদলে ফেলা বর্তমানে সম্ভব নয়। উল্টোদিকে ধূমপান ছেড়ে দেওয়া বা জীবনশৈলী বদলে ফেলা, ব্যায়াম শুরু করা ইত্যাদি অনেকটাই নিজের হাতে। এই ঝুঁকিগুলো কমিয়ে ফেলা যায়। উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ আর কোলেস্টেরল হল মাঝামাঝি জায়গায়। এসব রোগ থাকলে তাদের নিয়মিত চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদরোগের সম্ভাবনা কমানো সম্ভব। এই রোগগুলিকেও আটকে দেওয়া যায় কিনা, তা জানতে গেলে আমাদের খুব ভালো করে বুঝতে হবে এই রোগগুলি হবার কারণ কী বা কী কী? তারপর যে পদ্ধতিতে আমরা হৃদরোগের সম্ভাবনা কমানোর কথা ভেবেছি পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকিগুলোকে দূর করে বা কমিয়ে, তেমনিভাবে এই রোগগুলোকেও কিছু ক্ষেত্রে বা কিছুদিন অন্তত রুখে দেওয়া সম্ভব। এদের আটকে দিলে আবার হৃদরোগের সম্ভাবনাও কমবে।

এবার মনে করুন তেত্রিশ বছর বয়সী শ্রীমতী 'খ' হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। দেখা গেল তাঁর মধ্যে পরিচিত রিস্ক ফ্যাক্টরগুলির একটিও নেই। তাহলে? এতে বোঝা যায় যে আমাদের জ্ঞানের পরিধির বাইরে থাকা কোনো কারণে তাঁর হৃদরোগ হয়েছে। এবার শ্রীমতী 'খ'-এর অসুখের কথা শুনে 'ক'বাবু বলতে পারেন, এত নিয়মানুবর্তী জীবন যাপন করেও এত অল্প বয়সে ওঁর যখন হৃদরোগ হল আর প্রচুর ধূমপান আর মদ্যপান করা সত্ত্বেও যখন 'গ' বাবু ৮৫ বছর বাঁচলেন, তখন এসব চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাঁওতা মেনে প্রিয় আলস্য আর সিগারেটের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার কোনো মানেই হয় না। এই যুক্তি বস্তুত প্রায়শই শুনি। যারা ধূমপান করে, তাদের সবার ক্যানসার হয় নাকি? যাদের ক্যানসার হয়, তারা সবাই কি তামাক ব্যবহার করে? এখানে কিছু যুক্তির ফাটল আছে। প্রথমত একশর মধ্যে একশজন ধূমপায়ীর ক্যানসার (বা হৃদরোগ) হলে এবং একমাত্র ধূমপায়ীদের মধ্যেই ক্যানসার (বা হৃদরোগ) লক্ষ্য করা গেলে ধূমপানকে আর এসব রোগের রিস্ক ফ্যাক্টর বলা হত না, সরাসরি একমাত্র কারণ বলেই দাগিয়ে দেওয়া যেত। দ্বিতীয়ত কোনো রোগের পিছনে অজানা কিছু ঝুঁকি থাকার মানে এই নয় যে চিহ্নিত ঝুঁকিগুলো মূল্যহীন। ঝুঁকিগুলো কমালে আপনি চিরায়ু হবেন না, শুধু নির্দিষ্ট কিছু রোগ হবার সম্ভাবনা খানিকটা কমবে। ধূমপান বা কিছুটা অলস জীবন আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ হতেই পারে এবং সচেতনভাবে এগুলো বেছে নেবার অধিকার আপনার আছে, কিন্তু তার সমর্থনে যুক্তি সাজাতে বিজ্ঞানের বিকৃতি না ঘটানোই ভালো।

আরও পড়ুন, অর্থনীতির স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্যের অর্থনীতি

"Prevention is better than cure" তত্ত্বটা মেনে নিলে জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার সুযোগ আসে রোগ প্রতিরোধ করার। রোগের ঝুঁকিগুলিরও উৎপত্তির আগে থেকে এক সুস্থতর জীবনশৈলী অবলম্বন করে Primordial prevention-এর গুরুত্বের কথা এখন অনেকেই বলেন। মূলত সামাজিক স্তরে পরিবর্তন এনে এই কাজ করা সম্ভব। এর বাইরে রোগ প্রতিষেধের তিনটি স্বীকৃত স্তর আছে।

১) প্রাথমিক প্রতিষেধ (Primary prevention): ঝুঁকিগুলো এড়িয়ে বা তাদের প্রকোপ কমিয়ে রোগ বা আঘাত প্রতিরোধ করা। বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক বা দূষক নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, মশার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে  ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, জাপানি এনকেফালাইটিস জাতীয় বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধ করা (অন্যান্য পতঙ্গবাহিত রোগের ক্ষেত্রেও একই কথা), টিকাকরণের দ্বারা বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা, পথ নিরাপত্তা বাড়িয়ে দুর্ঘটনা এড়ানোর মতো বিবিধ ব্যবস্থা এর অন্তর্ভুক্ত।

২) দ্বিতীয় স্তর (Secondary prevention): রোগ বা আঘাতের সূচনা হবার পর তাদের দ্বারা বেশি ক্ষতি হতে না দেওয়া। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বা প্রয়োজনানুসারে নির্দিষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার দ্বারা অপুষ্টি, বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ, মহিলাদের স্তন বা সার্ভিক্সের ক্যানসার, অ্যাসবেসটস বা বালি খাদানের শ্রমিকদের ফুসফুসের রোগ, আর্সেনিক ঘটিত রোগ, এইচ-আই-ভি ও অন্যান্য যৌন রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চিহ্নিত করে তাদের বাড়তে না দেওয়া, সারিয়ে ফেলার পর একটি রোগের পুনরায় ফিরে আসা রোধ করা (ওষুধ, খাদ্য বা জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে), দ্রুত মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া… এসবই এই স্তরের প্রতিষেধ।

৩) তৃতীয় স্তর (Tertiary prevention): গুরুতর রোগ হয়ে যাবার পর রোগীর ওপর তার শারীরিক এবং আর্থসামাজিক অভিঘাত কমিয়ে আনা। অন্যভাবে বললে আঘাত বা রোগের কারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে না দেওয়া বা সেই প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করা। এই পর্বে ওষুধ-পথ্যের চিকিৎসার পাশাপাশি বিভিন্ন রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম ও সাপোর্ট গ্রুপের ভূমিকা আছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই বিপুল সম্ভাবনাময় কর্মকাণ্ডে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের ভূমিকা সীমিত। দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পথ নিরাপত্তা বা মশার উপদ্রব কমানো… কোনোটাতেই কর্পোরেট হাসপাতাল নাগরিকের জন্য কিছু করতে পারবে না, এমনকি শহরের সবচেয়ে নামী চিকিৎসকও পারবেন না। দ্বিতীয় স্তরে চিকিৎসকের কিছু ভূমিকা থাকলেও নিজের ক্লিনিকের বাইরে গিয়ে জনসাধারণের মধ্যে রোগ চিহ্নিতকরণের স্ক্রিনিং প্রোগ্রামগুলো চালানোর ক্ষমতা বা অধিকার কোনোটাই একজন চিকিৎসকের নেই। একমাত্র সরকারই এগুলো করতে পারে। তৃতীয় স্তরেও চিকিৎসকের পাশাপাশি আরও অনেক পেশাদার ও অপেশাদার মানুষের ভূমিকা। সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির উদ্যোগ ছাড়া এই ব্যবস্থা তৃণমূল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন, এন আর সি ও আসামে ‘বিদেশি পাকড়াও’ করার নানা হাতিয়ার

সুতরাং কেউ যদি স্বাস্থ্যের কারণে খারাপ থাকেন, তবে তার পিছনে সরকারি উদ্যোগের অভাব এক উল্লেখযোগ্য কারণ। সুস্থ ও সুখী থাকতে চাইলে, খুব দামী হেলথ ইনশিওরেন্স কিনলেই চলবে না, স্বাস্থ্যের জন্য যাপন করতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন এবং হতে হবে সচেতন সুনাগরিক। চুপ করে অব্যবস্থা আর অস্বাস্থ্য সহ্য করা সুনাগরিকের কর্তব্য নয়, মাঝেমধ্যে ভুল জায়গায় রাগ দেখানোও নয়, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত প্রচেষ্টায় সমাজ ও শাসককে সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে বাধ্য করাই সুনাগরিকের কাজ। আবার মনে করানোর,  স্বাস্থ্য নাগরিকের অধিকার। সেই অধিকার দাবি করতে হবে। শুধু আরোগ্য নিকেতন বা বেশিসংখ্যক ভেণ্টিলেটর নয়, রোগ ও আঘাত প্রতিরোধে আরও বেশি সরকারি উদ্যোগ দাবি করা প্রয়োজন।

(লেখক আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment