জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত আলোচনার সময় মনে রাখা প্রয়োজন, জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। মহিলাদের স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে আমরা ধাপে ধাপে পৌঁছতে চাইছিলাম, কিন্তু একটু আগেই সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে হল, কারণ "স্ত্রীরোগ" সহসা সন্দেহজনক হয়ে পড়েছে (সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী)। একজন মন্ত্রীর পক্ষে সরকারি শিক্ষকদের সভায় স্ত্রীরোগ নিয়ে ঠাট্টা করা কতটা অনভিপ্রেত, তাঁর মন্তব্য শুনে হেসে ওঠা বা হাততালি দেওয়া কতটা অশিক্ষকসুলভ, এমন মানুষদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত রাখা (এমনকি দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীপদে আসীন রাখা) ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার পক্ষে কতটা ক্ষতিকর, সেসব বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছি।
বস্তুত, এই পিতৃতান্ত্রিক অসংবেদনশীলতার জন্য শিক্ষামন্ত্রী একা দায়ী নন, সমাজের অধিকাংশ মানুষের মতো তিনিও ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা এবং সমাজের মজ্জাগত নারীবিরোধী অপসংস্কৃতির শিকার। এই বিষয়ে আলোচনা করার যোগ্যতর ব্যক্তি সমাজতাত্ত্বিকেরা। চিকিৎসক হিসেবে আমার সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজপতি পর্যন্ত প্রায় সকলের এই বিকৃত ভাবনার ফলে নারীর স্বাস্থ্যোদ্ধার দুষ্কর, এবং তার ফলে জনস্বাস্থ্য সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
'স্ত্রীরোগ' মানে কী? স্ত্রীরোগ বলতে সাধারণত স্ত্রী জননাঙ্গসমূহের রোগ বোঝায়। স্তনের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন। এর বাইরে মহিলাদের কিছু স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া (যেমন ঋতুস্রাব, গর্ভধারণ, প্রসব, স্তন্যদান ইত্যাদি) যথেষ্ট ক্লেশদায়ক এবং সমস্যাজনক হতে পারে অনেকের ক্ষেত্রে। যদিও 'পুংরোগ' শব্দটি শোনা যায় না, তবু পুরুষেরও স্বতন্ত্র জননতন্ত্র থাকে এবং তারও রোগ হওয়া সম্ভব। যেমন হাইড্রোসিল, শুক্রাশয় বা শিশ্নের ক্যানসার, লিঙ্গের আকার ও গঠনগত ত্রুটি, লিঙ্গের অনুত্থানজনিত সমস্যা বা শীঘ্র স্খলন, শুক্রাণুর ঘাটতিতে সন্তান উৎপাদনে অক্ষমতা ইত্যাদি। জেনারেল সার্জন, মেডিসিন, নিউরোলজি, সাইকায়াট্রি বা যৌনরোগের চিকিৎসকেরাই পুরুষদের এইসব রোগের চিকিৎসা করেন। আলাদাভাবে 'পুংরোগ' হিসেবে এগুলিকে চিহ্নিত করে কোনো বিভাগ খোলা হয়নি। কেন হয়নি?
আরও পড়ুন, অন্য পক্ষ: স্নাতকস্তরের প্রবেশিকায় স্বচ্ছতা কতটা?
এই 'কেন'র উত্তর খুঁজতে গেলে মাননীয় মন্ত্রীমশাইদের ভুল খানিক ভাঙতে পারে। প্রথমত, পৌরুষের সামাজিক নির্মাণ শক্তির পরাকাষ্ঠা হিসেবে। হিন্দু শাস্ত্র-পুরাণে যতই নারীকে শক্তি বলা হোক না কেন, সেই সম্মান দেবীর জন্য বরাদ্দ, মানবীর জন্য নয়। বাস্তবে পুরুষই শক্তিমানের মর্যাদা পেয়ে থাকে এবং সেই মর্যাদা তার সামাজিক ক্ষমতার অন্যতম ভিত্তি। শক্তিমান তো ধারণাগতভাবে নিরোগ। বিশেষভাবে তারই জন্য কিছু রোগ চিহ্নিত হয়ে থাকলে পুরুষের আধিপত্যকে স্বাভাবিক মনে করার বৌদ্ধিক স্তম্ভগুলোর একটা ভেঙে পড়বে। ভাবুন, কোনো মন্ত্রী সহাস্যে বলছেন, "পুরুষ শিক্ষকেরা কেন এত পুংরোগে ভুগছেন!" সেই ঠাট্টায় আমোদ পেয়ে শিক্ষিকারা হাসছেন আর পুরুষ শিক্ষকেরা অধোবদনে বসে আছেন! এমনটা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই 'পুংরোগ' নেই।
দ্বিতীয়ত, চিকিৎসার এই বিভাজন বা স্পেশালাইজেশন ইউরোপীয় ধারা থেকে এসেছে। মূলধারার পাশ্চাত্য সামাজিক চিন্তা কাঠামোয় মানুষ বলতে 'ম্যান' বোঝায়। পুরুষ হল স্বাভাবিক কেন্দ্রীয় চরিত্র। নারী 'অপর', আদমের পাঁজর, পুরুষের বিপরীত। সুতরাং পুরুষের যা কিছু রোগ, তাই তো আসলে মানুষের রোগ। তাকে আবার আলাদাভাবে পুংরোগ বলে চিহ্নিত করার প্রয়োজন কী? বরং শরীরের অঙ্গ অনুসারে তার মধ্যে স্পেশালাইজেশন হতে পারে। নারীর যেসব রোগের লক্ষ্মণ পুরুষের সঙ্গে মিলে যায়, তাদের চিকিৎসা পুরুষের চিকিৎসার পদ্ধতিতেই চলবে। যেসব রোগ তেমন মিলে যায় না, সেগুলো তুচ্ছ, হাস্যকর বা রহস্যময়।
তুচ্ছ করার এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী। যেমন ঋতুকালীন সমস্যা বা সমস্যাহীন ঋতু হল 'মেয়েলি ব্যাপার'। ওগুলো এমনকি আমাশার মতোও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। মনে করা যাক 'হিস্টিরিয়া' শব্দটির সঙ্গে জড়িত নিদারুণ তাচ্ছিল্যের ইতিহাস। শব্দটি এসেছে ইউটেরাস বা জরায়ুর ল্যাটিন নাম থেকে। নারীর শরীরে তো ওই একটিই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থাকে আর নারীর বুদ্ধি থাকে, হাঁটুতে নয়, নির্ঘাত জরায়ুতে। মনে করা হতো, জরায়ু তার রহস্যময় ব্যাপারস্যাপার সমেত মেয়েদের শরীরে ঘুরে বেড়ায়। যেদিন শরীরের যে অঙ্গে গিয়ে উপদ্রব করে, সেটা তখনকার মতো বিকল হয়ে যায়। মানসিক চাপের কারণে সাময়িকভাবে খিঁচুনি থেকে শুরু করে প্যারালিসিস জাতীয় বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়, এমন একধরণের রোগকে প্রাথমিকভাবে এই অপমানজনক নামটি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল মহিলাদের অনেক শারীরিক সমস্যাকেই 'হিস্টিরিয়া' বলে অভিহিত করে চিকিৎসা না করে ফেলা রাখা হতো।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এগোবো কোন পথে?
তুচ্ছ করার, অপমান করার সেই প্রবণতা এখনও আছে, যা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ভাষণে স্পষ্ট। মহিলাদের নিজস্ব যেসব রোগকে নেহাৎ অবজ্ঞা করা সম্ভব হয়নি, তাদের স্ত্রীরোগ হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে খানিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত হয়েছে। আজকের দিনে গাইনিকোলজি ও অবস্টেট্রিক্স একটি উন্নত স্পেশালিটি, যাতে আলাদাভাবে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে হয় চিকিৎসকদের, কিন্তু এর শুরুটা এত গৌরবময় ছিল না।
মহিলাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমাজে সন্তানের জন্ম দেওয়া। এই কাজটি সুসম্পন্ন করতেন ধাত্রীরা, ইংরেজিতে যাঁদের বলা হতো 'মিডওয়াইফ'। যেহেতু বংশের প্রদীপ পুরুষ সন্তানের জন্মও একইভাবে হয়, পুরুষ শিশুও জন্মলগ্নে মরে যেতে পারে, হয়ত অনেকটা সেইজন্যই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক চর্চা শুরু হয়। কিছু মানুষ অবশ্যই জন্মদাত্রীকেও বাঁচাতে চেয়েছিলেন। ক্রমশ তাই এই বিষয়টি চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত 'মিডওয়াইফারি' হিসেবে। মেডিসিন বা সার্জারির সমান মর্যাদা পাওয়ার দিন তখনও আসেনি। তাছাড়াও নাম থেকেই এটা স্পষ্ট যে, চর্চার সূচনা প্রসূতি ও প্রসব সংক্রান্ত বিষয়টুকু নিয়ে। মহিলাদের জীবনের বাকি সমস্ত বিশিষ্ট শারীরিক সমস্যা (যা পুরুষের হয় না), তাদের কল্কে পেতে আরও সময় লেগেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এখানে নারীকে 'অপর' বলা হল, তৃতীয় লিঙ্গ তাহলে কী? তৃতীয় লিঙ্গকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করাই ছিল সাবেকী পিতৃতন্ত্রের রাজনীতি। তাই তাঁদের জন্য কোনো আলাদা বিভাগ নেই, নেই এমনকি আলাদা ওয়ার্ড বা বাথরুম। তাঁদের নারীবিভাগেই ঠাঁই দেওয়া হয় সচরাচর। যা কিছু পুরুষ নয়, তাই নারী। শুধুমাত্র পুরুষকে বুঝলেই চলে, তারপর অন্যরকম সবাইকে নারী বলে দিলেই হল। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বহুদিন এভাবেই ভেবে এসেছে।
চিকিৎসা এবং নারীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভাবনা প্রকৃত অর্থে আধুনিক হয়ে ওঠার পরেও আমরা আলাদা স্ত্রীরোগ বিভাগ এবং বিশেষজ্ঞ রাখাকে সমর্থন করি তৃতীয় এক কারণে। স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে মহিলাদের প্রজননতন্ত্র সংক্রান্ত কারণে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পেতে হয়। এর বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য এই বিষয়ে ওষুধ এবং শল্যচিকিৎসায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক প্রয়োজন।
গর্ভধারণ এবং প্রসবের সংখ্যা বিপুল এবং জটিলতাও প্রচুর। সুতরাং গর্ভবতী এবং প্রসূতির সুচিকিৎসার জন্য দক্ষ এবং দায়বদ্ধ চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীর ফৌজ প্রয়োজন, উপযুক্ত পরিকাঠামোও প্রয়োজন। 'ফৌজ' বললাম এই কারণে যে বিষয়টি যুদ্ধের চেয়ে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দলবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই। শিশু ও মায়ের মৃত্যু রুখতে সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করা কতটা জরুরি, তা বোঝাতে একটা পরিসংখ্যান দিই।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: সুস্থতার দিকে… রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতা
শিশুর বদলে একটু মায়ের দিকে নজর দিই। ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাপী সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল্ প্রতি এক লক্ষ প্রসবে ৩৮৫ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়। সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ এবং দরিদ্র মানুষের মধ্যে এই মৃত্যুর হার সর্বাধিক, যেমন সাহারার দক্ষিণবর্তী আফ্রিকার দেশগুলিতে এই সংখ্যা ছিল ৯৮৭ জন। ক্রমাগত প্রচেষ্টায় ২০১৫ সাল নাগাদ পৃথিবীতে প্রসূতি মৃত্যুর গড় চুয়াল্লিশ শতাংশ কমে প্রতি লক্ষে ২১৬ তে দাঁড়িয়েছে। ভারতেও উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। ইউনিসেফের ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতে প্রসূতি মৃত্যুর গড় কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি লক্ষে ১৬৭ জনে। রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার স্যাম্পেল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম জানিয়েছিল যে ২০১৪-২০১৬ সালের মধ্যে আরও ২২ শতাংশ কমে প্রসূতি মৃত্যুর ভারতীয় গড় হয়েছে লক্ষ প্রতি ১৩০ জন।
প্রসূতি মৃত্যুর সংখ্যা নারীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির একটি সূচক। এই উন্নতিতে সরকারি প্রকল্পগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। আরও বেশি সুস্থতার জন্য প্রয়োজন সংবেদনশীল সমাজ ও সরকার। সন্দিগ্ধ ও পরিহাসপ্রিয় স্ত্রীরোগবিদ শিক্ষামন্ত্রীরা আমাদের মনোবল কমিয়ে দেন। জরায়ুর ক্যান্সার থেকে শুরু করে রাপচারড একটোপিক প্রেগন্যান্সির মতো প্রাণঘাতী স্ত্রীরোগগুলির কথা হয়ত তাঁরা জানেন না, কিন্তু প্রাত্যহিক ছোটোখাটো সমস্যাগুলোর কথা নিশ্চয় নিজেদের পরিবারেও শুনে থাকবেন। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের শারীরিক অসুবিধার কথা শুনলেই যাঁরা বিরক্ত হন, তাঁদের বলি, একটু মানবিকভাবে ভাবুন। রক্তক্ষরণ হতে থাকা অবস্থায় যিনি একইরকম পরিশ্রম করে চলেছেন, তিনি আসলে আরও বেশি কষ্ট করছেন, যদিও আমরা তা খেয়াল করছি না। সেই সময়ে অন্তত একটু পরিচ্ছন্ন শৌচাগার তাঁদের প্রাপ্য।
মহিলাদের মূত্রনালীর দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার থেকে সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা তাঁদের ক্ষেত্রে বেশি। কোনো মহিলা পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের দাবি তুললে, তাঁর সঙ্গে তর্ক করবেন না, বরং চেষ্টা করুন দাবিটা মেটাতে। অনেক মহিলারই ঋতুর সময় দারুণ পেটে ব্যথা (ডিসমেরিয়া) হয়। মনে করুন, প্রতি মাসে তিনদিন আপনার অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা ওঠে। সেই অবস্থায় কাজ করবেন? সুতরাং রোগটি 'কমন' অর্থে সাধারণ হলেও যন্ত্রণাটি পরিহাসযোগ্য নয়। এমনকি মাইগ্রেনের মাথাব্যথাও বহু ক্ষেত্রে ঋতুর সময় বেড়ে যায়।
ঋতুচক্রের শেষ কয়েকদিন শারীরবৃত্তীয় কারণেই মন-মেজাজ অত্যন্ত খারাপ থাকে। এগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, এবং এগুলো প্রমাণিতভাবেই 'ন্যাকামি' নয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার আগে গর্ভবতী মহিলাকে বেশ কয়েক মাস চাকরি করতে হয়। সেই অবস্থায় কল্যাণী থেকে কাকদ্বীপ নিয়মিত যাতায়াত করা শুধু কঠিন নয়, অমানবিক। তাঁরা যদি কাছাকাছি বদলির দাবি করেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে সেই দাবি মেটানো সম্ভব নাই হতে পারে, কিন্তু অপারগতার কথা জানিয়ে দুঃখপ্রকাশ করা উচিত, মশকরা নয়।
অল্প কয়েকটা উদাহরণ দিলাম। নারীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা বিপুল, যা নিয়ে পরে আরও আলোচনা করতে হবে। আপাতত একটি অনুরোধ জানিয়ে শেষ করি। যেসব 'মেয়েলি' ব্যাপার সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না, সেগুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে বরং একটু জানার চেষ্টা করি। কথা হোক আরও বেশি করে এবং প্রকাশ্যে। তাতে মহিলা এবং পুরুষ উভয়েরই উপকার হবে। উন্নতি হবে শিক্ষা এবং কর্মসংস্কৃতিরও।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)
জন ও স্বাস্থ্য: স্ত্রীরোগ এবং আমাদের সমাজ
অনেক মহিলারই ঋতুর সময় দারুণ পেটে ব্যথা হয়। মনে করুন, প্রতি মাসে তিনদিন আপনার অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা ওঠে। সেই অবস্থায় কাজ করবেন? সুতরাং রোগটি 'কমন' অর্থে সাধারণ হলেও যন্ত্রণাটি পরিহাসযোগ্য নয়।
Follow Us
জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত আলোচনার সময় মনে রাখা প্রয়োজন, জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। মহিলাদের স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে আমরা ধাপে ধাপে পৌঁছতে চাইছিলাম, কিন্তু একটু আগেই সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে হল, কারণ "স্ত্রীরোগ" সহসা সন্দেহজনক হয়ে পড়েছে (সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী)। একজন মন্ত্রীর পক্ষে সরকারি শিক্ষকদের সভায় স্ত্রীরোগ নিয়ে ঠাট্টা করা কতটা অনভিপ্রেত, তাঁর মন্তব্য শুনে হেসে ওঠা বা হাততালি দেওয়া কতটা অশিক্ষকসুলভ, এমন মানুষদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত রাখা (এমনকি দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীপদে আসীন রাখা) ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার পক্ষে কতটা ক্ষতিকর, সেসব বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছি।
বস্তুত, এই পিতৃতান্ত্রিক অসংবেদনশীলতার জন্য শিক্ষামন্ত্রী একা দায়ী নন, সমাজের অধিকাংশ মানুষের মতো তিনিও ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা এবং সমাজের মজ্জাগত নারীবিরোধী অপসংস্কৃতির শিকার। এই বিষয়ে আলোচনা করার যোগ্যতর ব্যক্তি সমাজতাত্ত্বিকেরা। চিকিৎসক হিসেবে আমার সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজপতি পর্যন্ত প্রায় সকলের এই বিকৃত ভাবনার ফলে নারীর স্বাস্থ্যোদ্ধার দুষ্কর, এবং তার ফলে জনস্বাস্থ্য সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
'স্ত্রীরোগ' মানে কী? স্ত্রীরোগ বলতে সাধারণত স্ত্রী জননাঙ্গসমূহের রোগ বোঝায়। স্তনের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন। এর বাইরে মহিলাদের কিছু স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া (যেমন ঋতুস্রাব, গর্ভধারণ, প্রসব, স্তন্যদান ইত্যাদি) যথেষ্ট ক্লেশদায়ক এবং সমস্যাজনক হতে পারে অনেকের ক্ষেত্রে। যদিও 'পুংরোগ' শব্দটি শোনা যায় না, তবু পুরুষেরও স্বতন্ত্র জননতন্ত্র থাকে এবং তারও রোগ হওয়া সম্ভব। যেমন হাইড্রোসিল, শুক্রাশয় বা শিশ্নের ক্যানসার, লিঙ্গের আকার ও গঠনগত ত্রুটি, লিঙ্গের অনুত্থানজনিত সমস্যা বা শীঘ্র স্খলন, শুক্রাণুর ঘাটতিতে সন্তান উৎপাদনে অক্ষমতা ইত্যাদি। জেনারেল সার্জন, মেডিসিন, নিউরোলজি, সাইকায়াট্রি বা যৌনরোগের চিকিৎসকেরাই পুরুষদের এইসব রোগের চিকিৎসা করেন। আলাদাভাবে 'পুংরোগ' হিসেবে এগুলিকে চিহ্নিত করে কোনো বিভাগ খোলা হয়নি। কেন হয়নি?
আরও পড়ুন, অন্য পক্ষ: স্নাতকস্তরের প্রবেশিকায় স্বচ্ছতা কতটা?
এই 'কেন'র উত্তর খুঁজতে গেলে মাননীয় মন্ত্রীমশাইদের ভুল খানিক ভাঙতে পারে। প্রথমত, পৌরুষের সামাজিক নির্মাণ শক্তির পরাকাষ্ঠা হিসেবে। হিন্দু শাস্ত্র-পুরাণে যতই নারীকে শক্তি বলা হোক না কেন, সেই সম্মান দেবীর জন্য বরাদ্দ, মানবীর জন্য নয়। বাস্তবে পুরুষই শক্তিমানের মর্যাদা পেয়ে থাকে এবং সেই মর্যাদা তার সামাজিক ক্ষমতার অন্যতম ভিত্তি। শক্তিমান তো ধারণাগতভাবে নিরোগ। বিশেষভাবে তারই জন্য কিছু রোগ চিহ্নিত হয়ে থাকলে পুরুষের আধিপত্যকে স্বাভাবিক মনে করার বৌদ্ধিক স্তম্ভগুলোর একটা ভেঙে পড়বে। ভাবুন, কোনো মন্ত্রী সহাস্যে বলছেন, "পুরুষ শিক্ষকেরা কেন এত পুংরোগে ভুগছেন!" সেই ঠাট্টায় আমোদ পেয়ে শিক্ষিকারা হাসছেন আর পুরুষ শিক্ষকেরা অধোবদনে বসে আছেন! এমনটা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই 'পুংরোগ' নেই।
দ্বিতীয়ত, চিকিৎসার এই বিভাজন বা স্পেশালাইজেশন ইউরোপীয় ধারা থেকে এসেছে। মূলধারার পাশ্চাত্য সামাজিক চিন্তা কাঠামোয় মানুষ বলতে 'ম্যান' বোঝায়। পুরুষ হল স্বাভাবিক কেন্দ্রীয় চরিত্র। নারী 'অপর', আদমের পাঁজর, পুরুষের বিপরীত। সুতরাং পুরুষের যা কিছু রোগ, তাই তো আসলে মানুষের রোগ। তাকে আবার আলাদাভাবে পুংরোগ বলে চিহ্নিত করার প্রয়োজন কী? বরং শরীরের অঙ্গ অনুসারে তার মধ্যে স্পেশালাইজেশন হতে পারে। নারীর যেসব রোগের লক্ষ্মণ পুরুষের সঙ্গে মিলে যায়, তাদের চিকিৎসা পুরুষের চিকিৎসার পদ্ধতিতেই চলবে। যেসব রোগ তেমন মিলে যায় না, সেগুলো তুচ্ছ, হাস্যকর বা রহস্যময়।
তুচ্ছ করার এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী। যেমন ঋতুকালীন সমস্যা বা সমস্যাহীন ঋতু হল 'মেয়েলি ব্যাপার'। ওগুলো এমনকি আমাশার মতোও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। মনে করা যাক 'হিস্টিরিয়া' শব্দটির সঙ্গে জড়িত নিদারুণ তাচ্ছিল্যের ইতিহাস। শব্দটি এসেছে ইউটেরাস বা জরায়ুর ল্যাটিন নাম থেকে। নারীর শরীরে তো ওই একটিই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থাকে আর নারীর বুদ্ধি থাকে, হাঁটুতে নয়, নির্ঘাত জরায়ুতে। মনে করা হতো, জরায়ু তার রহস্যময় ব্যাপারস্যাপার সমেত মেয়েদের শরীরে ঘুরে বেড়ায়। যেদিন শরীরের যে অঙ্গে গিয়ে উপদ্রব করে, সেটা তখনকার মতো বিকল হয়ে যায়। মানসিক চাপের কারণে সাময়িকভাবে খিঁচুনি থেকে শুরু করে প্যারালিসিস জাতীয় বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়, এমন একধরণের রোগকে প্রাথমিকভাবে এই অপমানজনক নামটি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল মহিলাদের অনেক শারীরিক সমস্যাকেই 'হিস্টিরিয়া' বলে অভিহিত করে চিকিৎসা না করে ফেলা রাখা হতো।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এগোবো কোন পথে?
তুচ্ছ করার, অপমান করার সেই প্রবণতা এখনও আছে, যা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ভাষণে স্পষ্ট। মহিলাদের নিজস্ব যেসব রোগকে নেহাৎ অবজ্ঞা করা সম্ভব হয়নি, তাদের স্ত্রীরোগ হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে খানিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত হয়েছে। আজকের দিনে গাইনিকোলজি ও অবস্টেট্রিক্স একটি উন্নত স্পেশালিটি, যাতে আলাদাভাবে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে হয় চিকিৎসকদের, কিন্তু এর শুরুটা এত গৌরবময় ছিল না।
মহিলাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমাজে সন্তানের জন্ম দেওয়া। এই কাজটি সুসম্পন্ন করতেন ধাত্রীরা, ইংরেজিতে যাঁদের বলা হতো 'মিডওয়াইফ'। যেহেতু বংশের প্রদীপ পুরুষ সন্তানের জন্মও একইভাবে হয়, পুরুষ শিশুও জন্মলগ্নে মরে যেতে পারে, হয়ত অনেকটা সেইজন্যই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক চর্চা শুরু হয়। কিছু মানুষ অবশ্যই জন্মদাত্রীকেও বাঁচাতে চেয়েছিলেন। ক্রমশ তাই এই বিষয়টি চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত 'মিডওয়াইফারি' হিসেবে। মেডিসিন বা সার্জারির সমান মর্যাদা পাওয়ার দিন তখনও আসেনি। তাছাড়াও নাম থেকেই এটা স্পষ্ট যে, চর্চার সূচনা প্রসূতি ও প্রসব সংক্রান্ত বিষয়টুকু নিয়ে। মহিলাদের জীবনের বাকি সমস্ত বিশিষ্ট শারীরিক সমস্যা (যা পুরুষের হয় না), তাদের কল্কে পেতে আরও সময় লেগেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এখানে নারীকে 'অপর' বলা হল, তৃতীয় লিঙ্গ তাহলে কী? তৃতীয় লিঙ্গকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করাই ছিল সাবেকী পিতৃতন্ত্রের রাজনীতি। তাই তাঁদের জন্য কোনো আলাদা বিভাগ নেই, নেই এমনকি আলাদা ওয়ার্ড বা বাথরুম। তাঁদের নারীবিভাগেই ঠাঁই দেওয়া হয় সচরাচর। যা কিছু পুরুষ নয়, তাই নারী। শুধুমাত্র পুরুষকে বুঝলেই চলে, তারপর অন্যরকম সবাইকে নারী বলে দিলেই হল। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বহুদিন এভাবেই ভেবে এসেছে।
চিকিৎসা এবং নারীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভাবনা প্রকৃত অর্থে আধুনিক হয়ে ওঠার পরেও আমরা আলাদা স্ত্রীরোগ বিভাগ এবং বিশেষজ্ঞ রাখাকে সমর্থন করি তৃতীয় এক কারণে। স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে মহিলাদের প্রজননতন্ত্র সংক্রান্ত কারণে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পেতে হয়। এর বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য এই বিষয়ে ওষুধ এবং শল্যচিকিৎসায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক প্রয়োজন।
গর্ভধারণ এবং প্রসবের সংখ্যা বিপুল এবং জটিলতাও প্রচুর। সুতরাং গর্ভবতী এবং প্রসূতির সুচিকিৎসার জন্য দক্ষ এবং দায়বদ্ধ চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীর ফৌজ প্রয়োজন, উপযুক্ত পরিকাঠামোও প্রয়োজন। 'ফৌজ' বললাম এই কারণে যে বিষয়টি যুদ্ধের চেয়ে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দলবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই। শিশু ও মায়ের মৃত্যু রুখতে সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করা কতটা জরুরি, তা বোঝাতে একটা পরিসংখ্যান দিই।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: সুস্থতার দিকে… রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতা
শিশুর বদলে একটু মায়ের দিকে নজর দিই। ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাপী সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল্ প্রতি এক লক্ষ প্রসবে ৩৮৫ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়। সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ এবং দরিদ্র মানুষের মধ্যে এই মৃত্যুর হার সর্বাধিক, যেমন সাহারার দক্ষিণবর্তী আফ্রিকার দেশগুলিতে এই সংখ্যা ছিল ৯৮৭ জন। ক্রমাগত প্রচেষ্টায় ২০১৫ সাল নাগাদ পৃথিবীতে প্রসূতি মৃত্যুর গড় চুয়াল্লিশ শতাংশ কমে প্রতি লক্ষে ২১৬ তে দাঁড়িয়েছে। ভারতেও উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। ইউনিসেফের ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতে প্রসূতি মৃত্যুর গড় কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি লক্ষে ১৬৭ জনে। রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার স্যাম্পেল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম জানিয়েছিল যে ২০১৪-২০১৬ সালের মধ্যে আরও ২২ শতাংশ কমে প্রসূতি মৃত্যুর ভারতীয় গড় হয়েছে লক্ষ প্রতি ১৩০ জন।
প্রসূতি মৃত্যুর সংখ্যা নারীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির একটি সূচক। এই উন্নতিতে সরকারি প্রকল্পগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। আরও বেশি সুস্থতার জন্য প্রয়োজন সংবেদনশীল সমাজ ও সরকার। সন্দিগ্ধ ও পরিহাসপ্রিয় স্ত্রীরোগবিদ শিক্ষামন্ত্রীরা আমাদের মনোবল কমিয়ে দেন। জরায়ুর ক্যান্সার থেকে শুরু করে রাপচারড একটোপিক প্রেগন্যান্সির মতো প্রাণঘাতী স্ত্রীরোগগুলির কথা হয়ত তাঁরা জানেন না, কিন্তু প্রাত্যহিক ছোটোখাটো সমস্যাগুলোর কথা নিশ্চয় নিজেদের পরিবারেও শুনে থাকবেন। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের শারীরিক অসুবিধার কথা শুনলেই যাঁরা বিরক্ত হন, তাঁদের বলি, একটু মানবিকভাবে ভাবুন। রক্তক্ষরণ হতে থাকা অবস্থায় যিনি একইরকম পরিশ্রম করে চলেছেন, তিনি আসলে আরও বেশি কষ্ট করছেন, যদিও আমরা তা খেয়াল করছি না। সেই সময়ে অন্তত একটু পরিচ্ছন্ন শৌচাগার তাঁদের প্রাপ্য।
মহিলাদের মূত্রনালীর দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার থেকে সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা তাঁদের ক্ষেত্রে বেশি। কোনো মহিলা পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের দাবি তুললে, তাঁর সঙ্গে তর্ক করবেন না, বরং চেষ্টা করুন দাবিটা মেটাতে। অনেক মহিলারই ঋতুর সময় দারুণ পেটে ব্যথা (ডিসমেরিয়া) হয়। মনে করুন, প্রতি মাসে তিনদিন আপনার অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা ওঠে। সেই অবস্থায় কাজ করবেন? সুতরাং রোগটি 'কমন' অর্থে সাধারণ হলেও যন্ত্রণাটি পরিহাসযোগ্য নয়। এমনকি মাইগ্রেনের মাথাব্যথাও বহু ক্ষেত্রে ঋতুর সময় বেড়ে যায়।
ঋতুচক্রের শেষ কয়েকদিন শারীরবৃত্তীয় কারণেই মন-মেজাজ অত্যন্ত খারাপ থাকে। এগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, এবং এগুলো প্রমাণিতভাবেই 'ন্যাকামি' নয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার আগে গর্ভবতী মহিলাকে বেশ কয়েক মাস চাকরি করতে হয়। সেই অবস্থায় কল্যাণী থেকে কাকদ্বীপ নিয়মিত যাতায়াত করা শুধু কঠিন নয়, অমানবিক। তাঁরা যদি কাছাকাছি বদলির দাবি করেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে সেই দাবি মেটানো সম্ভব নাই হতে পারে, কিন্তু অপারগতার কথা জানিয়ে দুঃখপ্রকাশ করা উচিত, মশকরা নয়।
অল্প কয়েকটা উদাহরণ দিলাম। নারীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা বিপুল, যা নিয়ে পরে আরও আলোচনা করতে হবে। আপাতত একটি অনুরোধ জানিয়ে শেষ করি। যেসব 'মেয়েলি' ব্যাপার সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না, সেগুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে বরং একটু জানার চেষ্টা করি। কথা হোক আরও বেশি করে এবং প্রকাশ্যে। তাতে মহিলা এবং পুরুষ উভয়েরই উপকার হবে। উন্নতি হবে শিক্ষা এবং কর্মসংস্কৃতিরও।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)