Advertisment

জন ও স্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এগোবো কোন পথে?

ভারত সরকার তো খ্যাতনামা গবেষণা কেন্দ্রগুলিকেও নিজেদের গবেষণার অর্থনৈতিক দিক বা বিক্রয়যোগ্যতা প্রমাণ করতে বলছেন, নাহলে অনুদান বন্ধ করে দেবার খাঁড়া মাথার ওপর ঝুলবে। অনেকটা আর্থিক লাভের অভাবে ক্যানিং লোকাল বন্ধ করে দেবার প্রস্তাবের মতো ব্যাপার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Medical

প্রতীকী ছবি

আগের দুই পর্বে আমরা স্বাস্থ্যের অধিকার এবং রোগ প্রতিরোধের গুরুত্ব সম্বন্ধে কথা বলেছি। এরপর স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্ন ওঠা উচিত, তা হল স্বাস্থ্য পরিষেবার পদ্ধতি বা মডেল কী হবে? কোন পথে এগোলে সকলের জন্য স্বাস্থ্য একটি স্বপ্নের বদলে বাস্তব সম্ভাবনা হয়ে উঠতে পারে? এই সমগ্র প্রচেষ্টায় সরকারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? বেসরকারি পরিষেবা প্রদানকারীর ভূমিকাই বা কী? বাস্তবে প্রশ্নগুলো সহজ হলেও উত্তর ততটা নিশ্চিতভাবে জানা নয়। স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত বাস্তবতা, মানবাধিকার, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের বহু প্রশ্নের উত্তর জানতে পারলে তবেই এই সহজ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব।

Advertisment

আপাতত আমরা সেই জ্ঞান এবং পরিস্থিতি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। স্বাস্থ্য বলতে ঠিক কী বুঝব, তা নিয়েই এখনও অনেক ধোঁয়াশা আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান তাত্ত্বিকভাবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করেছে সবে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমরা সকলের কাছে সবরকম রোগের সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা বা প্রতিষেধক পৌঁছে দেবার জন্য প্রস্তুত নই। সমাজতত্ত্বে মতৈক্যের চেয়ে বিতর্কই বেশি। মানবাধিকার বলে কিছু একটা ব্যাপার আছে বা থাকা উচিত, এই অব্দি মেনে নিতে বেশিরভাগ মানুষ রাজি, এটুকুই জোর দিয়ে বলা যায়। মানবাধিকারের তালিকায় কী কী পড়ে এবং কতটা, কেমনভাবে সেসব অধিকার নিশ্চিত করা উচিত, তা নিয়ে ঐকমত্যের দিকে এগোতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানবসেবায় কিছুটা হলেও প্রস্তুত, সেখানে সব মানুষের কাছে এদের পৌঁছে দেবার পথে প্রধান অন্তরায় অর্থনৈতিক কিছু নীতি বা নীতিহীনতা, কিছু ব্যবস্থা ও অব্যস্থা। রাজনীতি সন্দেহাতীতভাবে একটি অভূতপূর্ব বিশ্বজনীন সংকটকালে। রাজনৈতিক অসততা ও অবক্ষয়ের কথা যদি বাদও দিই, কোন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মডেল সত্যিই মানুষের জন্য সবচেয়ে উপকারী, কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য আছে দার্শনিক জগতেও। সুতরাং গোড়ার প্রশ্নগুলোর নির্দিষ্ট সঠিক উত্তর দেবার যোগ্যতা আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। তবু প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন, উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। সেখান থেকে শুরু হয় এগোনো। আজ আমরা প্রথম ধাপটুকুতে পা রাখার চেষ্টা করব।

আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: সুস্থতার দিকে… রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতা

আজ বরং উত্তর দেবার চেষ্টা না করে আপাতদৃষ্টিতে সরল  প্রশ্নগুলোকে আরও জটিল করে তোলা যাক। আসলে সমস্যাটিকে তার পূর্ণ জটিলতায় আরও স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টা। তার জন্য প্রথমেই আরও কিছু প্রশ্ন তুলতে হবে এবং কিছু সীমাবদ্ধতার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। প্রথমদিন শুধুমাত্র চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখি।

মানবশরীর অতি জটিল। বিজ্ঞান তার সামান্য অংশ জানে। প্রতিদিন অজস্র গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। বইয়ের আকার-আয়তন দেখলে জ্ঞানের পরিমাণের প্রতি সমীহ জাগে। তাহলে কেন বলছি বিজ্ঞান সামান্যই জেনেছে? চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেককিছু বুঝতে না পারা এবং প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তব না মেলা আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা। তাছাড়া একটি নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হবার পর বোঝা যায় আগের জানা তথ্য ও তত্ত্ব কতটা অসম্পূর্ণ (এবং কিছু ক্ষেত্রে ভুল) ছিল! এই অপূর্ণ জ্ঞানের ভিত্তিতে চিকিৎসা করার সমস্যা নিয়ে আজ আলোচনা করব না। আজকে বলতে চাইছি প্রচুর গবেষণার প্রয়োজনের কথা। স্বাস্থ্য ও অসুস্থতার কারণ সম্বন্ধে আরও বেশি জ্ঞান অর্জন এবং রোগ নির্ণয়, ওষুধ, শল্যচিকিৎসা, প্রতিষেধক ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতি উন্নততর স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্যতম শর্ত।

প্রশ্ন হল, এই গবেষণা কেমন হবে, কী পদ্ধতিতে হবে, কার দ্বারা হবে? বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে আলাদা করে নিলে প্রশ্নগুলো আরও ভালো করে বোঝা যাবে। আজকাল বৈজ্ঞানিক গবেষণা এত জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে গেছে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য বড় পুঁজির প্রয়োজন। সেই পুঁজি কে বিনিয়োগ করবে? সরকার নাকি ব্যবসায়ীরা? প্রযুক্তির গবেষণার ক্ষেত্রে (ওষুধ আবিষ্কার ও উন্নয়ন, নতুন ধরণের ল্যাবরেটরির যন্ত্র বা রাসায়নিক তৈরি করা ইত্যাদিতে) অবশ্যই বড় মাপের ব্যবসায়ীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু কেন করেন? অবশ্যই গবেষণালব্ধ পণ্যটি বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করবেন এবং বাজার দখলে অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে থাকবেন বলে। স্বভাবতই তাঁরা এমন পণ্যের পিছনে বিনিয়োগ করবেন, যা বিক্রি করে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব। ওষুধের ক্ষেত্রেই ধরা যাক। গবেষণালব্ধ একটি নতুন ওষুধকে আগের ওষুধগুলির চেয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে বেশি কার্যকর বা কম ক্ষতিকর প্রমাণ করার জন্য বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, এই উদ্দেশ্যে কার্যকরিতার নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করা হয়, যা নিয়ে আগে পরীক্ষা হয়নি।

এর অনেক উদাহরণ দেওয়া যেত, কিন্তু সেগুলো খুব কঠিন হয়ে যাবে। পুরনো বহুল ব্যবহৃত ওষুধের সামান্য উন্নয়ন করে নতুন যৌগ বাজারে অনুমোদন পায় এবং বিপুল দামে বিক্রি হয়। তারা বেশি উন্নত ওষুধ তা প্রমাণ করার জন্য অতি জটিল হিসেব-নিকেশ হাজির করা হয়, যার বিরুদ্ধে তর্ক করা দূরে থাক, সম্পূর্ণ মর্মোদ্ধার করাই দুষ্কর। অর্থাৎ বাজারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গবেষণা বিভিন্ন নতুন ও পুরনো ওষুধ সম্পর্কে আমাদের যা জানাচ্ছে, তার "অশ্বত্থামা হত ইতি" অংশটি চিৎকৃত এবং সেটুকুই আমরা শুনছি। মৃত অশ্বত্থামা মানুষ না হাতি, তা সঠিকভাবে জানা যাচ্ছে না। এদিকে নিত্যনতুন গবেষণাপত্র এবং জনপ্রিয় পত্রিকার লেখায় এমনভাবে নতুন ওষুধ বা প্রযুক্তির জয়গান গাওয়া হয় যা চিকিৎসকদের ওপর রীতিমতো মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। নিজের রোগীদের নতুনতম ওষুধ বা পরীক্ষানিরীক্ষার 'সুবিধা'  না দিতে পারলে মনে হয় পিছিয়ে আছি এবং অপচিকিৎসা করছি। এই গ্লানিবোধ থেকে বাঁচার চেষ্টায় অগত্যা নতুন পথে পা বাড়াতেই হয় এবং চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

আরও পড়ুন, স্বাস্থ্য ভিক্ষা নয়, অধিকার

অবশ্য নতুন সবকিছুই এরকম নয়। কিছু নতুন পরীক্ষা ও ওষুধ সত্যিই যুগান্তকারী এবং জীবনদায়ী। এই ধরণের নতুন ওষুধ বা প্রযুক্তি যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা এর বাজারদর জানেন। পেটেন্টের সুরক্ষাকবচ থাকাকালে অত্যুচ্চ মূল্যে সেসব ওষুধ বিক্রি করে গবেষণায় নিয়োজিত অর্থ সুদে-আসলে আদায় করে নেয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সেই সময়ের মধ্যে নতুন নতুন প্রয়োগক্ষেত্রে ওষুধটির কার্যকরিতা আবিষ্কার করে বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা চলে। পেটেন্টের সময় পেরিয়ে গেলেও তা চলতে থাকে, যদি ব্যবসায় লাভ বজায় থাকে। যদি প্রতিযোগিতার চাপে ব্যবসায় ভাঁটা পড়ে, তাহলে হঠাতই সেই ওষুধ সংক্রান্ত গবেষণায় ছেদ পড়ে।

অপরপক্ষে যে গবেষণা থেকে বিক্রয়যোগ্য কিছু তৈরি হবে না, ব্যবসায়ীদের পক্ষে তেমন গবেষণায় বিনিয়োগ করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। নেহাৎ বাধ্য না করলে বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চায় এঁদের তরফ থেকে বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কম। যদি কেউ ব্যক্তিগত আগ্রহে তা করেন, তাহলে তা কতদিন চালিয়ে যেতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় থাকবে। আরও বড় সমস্যা হল, ব্যবসায়ীরা যদি বাধ্য হয়ে শুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চায় বিনিয়োগ করেনও, তাহলে কোন ধরণের গবেষণায় বিনিয়োগ করবেন? ধরা যাক, কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা পরিচালিত একটি বিজ্ঞানচর্চা সংস্থার কাছ থেকে গবেষণার "গ্রাণ্ট" পাবার জন্য দশজন গবেষক আবেদন করলেন। কাকে সেই অনুদান দেওয়া হবে? স্বজনপোষণ বা দুর্নীতির সম্ভাবনা বাদ দিলে অবশ্যই যাঁর গবেষণার প্রস্তাব বা বিষয় সবচেয়ে পছন্দ হবে, তাঁকেই অনুদান দেওয়া হবে। কোন প্রস্তাব বিচারকমণ্ডলীর মনে ধরবে, তা নির্ভর করে তাঁদের পছন্দ ও দর্শনের ওপর। ব্যক্তিগত রুচি ও দর্শন সমষ্টিগত দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত। বাজার অর্থনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সামাজিক মানসিকতা বর্তমানে ভোগবাদী এবং ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী উৎপাদনের ক্ষমতাকেই উৎপাদনশীলতা মনে করে। স্বভাবত এমন গবেষণার বিষয়ই নির্বাচিত হবে, যা থেকে আজ নাহলে কাল কোনো পণ্য উৎপাদন সম্ভব। স্বাস্থ্যকেই এখন পণ্য হিসেবে ভাবা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা তো বটেই, স্বচ্ছল সাধারণ মানুষ থেকে বিদ্বান বিজ্ঞানী প্রায় সকলেই ভাবেন যে উদভাবন এমন হবে যাতে কিছু একটা কিনে খেয়ে ফেলে টুক করে সুস্থ হয়ে যাওয়া যায়। এমন মৌলিক গবেষণা যা পণ্যমুখী নয় বা যার থেকে লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে, অভোগবাদী পদ্ধতিতে অথবা স্বল্পমূল্যের সামগ্রী ব্যবহার করে সুস্থ থাকা সম্ভব, তাতে এমনিতেই খুব বেশি লোকের উৎসাহ নেই আর থাকলেও সেই গবেষণায় বেসরকারি বিনিয়োগ আসা কঠিন। আপনি যদি এমন এক কোম্পানির মালিক হন যারা ইনসুলিন তৈরি করে, তাহলে আপনি কি এমন গবেষণার পিছনে টাকা ঢালবেন যার ফলে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা এবং ইনসুলিনের বিক্রি কমে যাবে?

সুতরাং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সৎ বিজ্ঞানচর্চায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। অথচ সারা পৃথিবীতেই অর্থনৈতিক সংকট যত ঘনীভূত হচ্ছে, মৌলিক গবেষণায় সরকারি অনুদান তত কমে আসছে। ভারত সরকার তো খ্যাতনামা গবেষণা কেন্দ্রগুলিকেও নিজেদের গবেষণার অর্থনৈতিক দিক বা বিক্রয়যোগ্যতা প্রমাণ করতে বলছেন, নাহলে অনুদান বন্ধ করে দেবার খাঁড়া মাথার ওপর ঝুলবে। অনেকটা আর্থিক লাভের অভাবে ক্যানিং লোকাল বন্ধ করে দেবার প্রস্তাবের মতো ব্যাপার। সরকারও একটি বাজারমুখী লাভজনক সংস্থা হয়ে উঠতে চায়। তাহলে মুনাফার উল্টো পথে হাঁটার বা স্বল্পমূল্যে বহুজন হিতায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উপায় কী হবে? 'সকলের জন্য স্বাস্থ্য' নামক স্বপ্নটি ক্রমশ আরও অলীক হতে থাকবে না কি?

এই শেষ প্রশ্নটির জবাব তাৎক্ষণিকের চাইতেও অনেক বেশি অনুধাবনযোগ্য।

(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)

health Jon O Swasthyo
Advertisment