Advertisment

পুজোর কেনাকাটার এখন তখন

যে শাড়ি আগে সাধারণ দোকান থেকে হয়ত হাজার -বারোশ’ টাকায় কিনে বাইরে এসে দোকানীর মুণ্ডপাত করেছি পঞ্চাশ টাকা দাম কমায়নি বলে, আজকাল সেই একই শাড়ি যখন বুটিকে দেখি পাঁচ হাজারে বিকোচ্ছে, নির্বিকার থাকি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

বছর চারেক বয়সে প্রথম শাড়ি হয়েছিল আমার। পুজোর সময়ে। সেটাকে অবশ্য ঠিক শাড়িও বলা চলে না। ছিট কাপড়ের থান থেকে হাত চারেক কেটে নিয়ে ধার দুটো মুড়িয়ে রান সেলাই করা। খুব বায়না করেছিলাম তো, তাই! ঘন ম্যাজেন্টা রঙের জমিতে সাদা কালো খুদে খুদে পাখির আদল। এখনও মনে পড়ে, সে বছর পুজোর বাজার করতে যাওয়া হয়েছিল ওই পুজোর ঠিক মুখেমুখেই। আমর জন্য ফ্রকের কাপড় কেনা হবে, তারপর তা দরজিকে দেওয়া হবে, প্রতিবারের মতোই। কিন্তু সব হিসেব উলটে দিয়ে আমি নিজের জন্য শাড়ি চেয়ে বসলাম। অগত্যা শাড়ি। তার মানে সেবার নিশ্চিত গুনতিতে একটা ফ্রক কম হয়েছিল। বাবা আর দাদু বলত, “পুজো কি আর ছেলেদের? পুজো তো শুধু মেয়েদের আর বাচ্চাদের!”

Advertisment

মা ঠাম্মার সঙ্গে পুজোর মাসখানেক আগে নাচতে নাচতে পুজোর বাজার করতে যেতাম আমি। প্রথমেই কেনা হত ঠাকুরের শাড়ি। মা আর ঠাম্মা দুটো শাড়ি কিনত দুর্গা ঠাকুরের জন্য। এবং, আমাদের অবস্থা অনুযায়ী তো বলব, ভালো শাড়িই কেনা হত। ঠাকুরকে নিবেদন করা ফলমূল, লুচি, পায়েস তো আমরাই খাই, শাড়ি-ধুতি-গামছা কিছু পুরুতমশাইরা নেন, কিছু জোটে ঢাকিদের কপালে আর বাকিগুলো তো পুরুতমশাইদের হাতফেরতা হয়ে আবার সেই ছোটখাটো দোকানেই চলে যায় । সবই জানা কথা, তবু যখন ঠাকুরকে দিচ্ছি, তখন কিন্তু তাঁকে দেওয়া ভেবেই দেওয়া । তাই খেলো জিনিস কেনার প্রশ্নই উঠত না ! ঠাম্মা আর মা যখন ফর্দ বানাত, ঠাকুরের শাড়ির পরেই নাম থাকত সরলাদিদি আর বঙ্কিমদাদার। আমাদের বাড়িতে ‘কাজের লোক’ হিসেবে ঢুকে কখন যে ‘বাড়ির লোক’ হয়ে গিয়েছিল ওরা, কে জানে! এরপরে থাকত কিছু এদিক-ওদিক নাম, যেমন আমার দাদামশাই, দিদা, কর্তা মা মানে ঠাম্মার মা, পিসিমণি, টুলটুল মানে আমার পিসতুতো বোন ... এরা। আমি খুঁজতাম আমার নাম। দুটো জামা হত আমার। রেডিমেড নয়, কাপড় কিনে বানানো। তাছাড়া একটা দিত পিসিমণি, একটা আসত মামারবাড়ি থেকে আর একটা দিত আমার এক মাসি, সোনামাসি। বাড়ির দুটো আর মামারবাড়িরটা নিয়ে আমার তেমন কোনও চিত্তচাঞ্চল্য ঘটত না, যতটা হত বাকি দুটো নিয়ে। কারণও ছিল তার। পিসিমণি থাকত কলকাতার বাইরে, ফলে প্রবাসী-ফ্যাশন ছুঁয়ে থাকত সেই পোশাক আর সোনামাসি ছিল নিউ মার্কেট চষে বেরানো মহিলা। তাই ভারী বাহারের রেডিমেড ফ্রক পেতাম আমি। কখনও নেট বসানো, কখনও লেসের কারিকুরি বা সিল্কের সুতোর এমব্রয়ডারি, আবার কখনও বা মুক্তোর মতো পুঁতির ঝিলিক। মনে পড়ে, একবার তো কুইন এলিজাবেথ ফ্রকের সঙ্গে মাথার মুকুটও ছিল! সব বিয়েবাড়িতেই আমি সোনামাসির দেওয়া পুজোর ফ্রক পরে যাওয়ার বায়না করতাম।

আরও পড়ুন, একি দুগ্‌গি দেখায় চাচা

ঠাম্মা আর মা নিজেদের জন্য কিছু কিনত কি? কখনও খেয়াল করে দেখিইনি! মধ্যবিত্ত সংসারে সকলকে দিয়েথুয়ে বাড়ির গিন্নিদের কপালে আদৌ কিছু পছন্দসই জুটত কি না কে জানে! তবে মনে হয় একটা করে মিহি জমিনের নকশাপাড় টাঙ্গাইল শাড়ি কিনত দুজনেই, অষ্টমীর অঞ্জলি দেবে বলে। দাদু আর বাবা অবশ্য কেচে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা পুরোনো আদ্দির পাঞ্জাবি আর ইঞ্চিপেড়ে ধুতি পরেই পুজো কাটিয়ে দিত। নতুন জুতো প্রতি বছর হত না আমার। জুতো আস্ত থাকলে কেনার দরকারটাই বা কী! তবে যে বছর বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ত, সে বছর আমি নতুন জুতোর বাক্স মাথার কাছে বালিশের পাশে রেখে তবেই রাতে ঘুমোতে যেতাম।
প্রথম প্রথম পাড়ার দরজির দোকানে ফ্রক বানাতে দেওয়া হত। সেই এক থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় ডিজাইন। ঘটি হাতা, পাফ হাতা, টিউনিক, আম্ব্রেলা কাট, কোটফ্রক, একটু লেস, সামান্য ফ্রিল, চারটে ম্যাচিং বোতাম ...ব্যস, গল্প শেষ! সত্যি বলতে কী, একগোছা বিলিতি ফ্রকের ডিজাইনের বই সামনে দরজিটি ফেলে দিত বটে, কিন্তু যেটাই আমি পছন্দ করতাম, ঠিক ধানাইপানাই করে কাটিয়ে দিত। মাকে সাপ-ব্যাং যা হোক বুঝিয়ে দিত, আর মা আমাকে দাবড়ানি দিত “অত বায়না করে লাভ নেই” এই বলে।

আরও পড়ুন, দুর্গা পুজো, বাংলাদেশের হৃদয় হতে

একটু বড় হওয়ার পরে অবশ্য দরজি বাতিল করে সেলাই মেশিন নিয়ে বসত মা। এবং ওই নিতান্ত সাধারণ কাপড়ে ফ্রক সেলাইয়ের সময়ে যখন সামান্য কারিকুরি করে ভোল পালটে দিত, সত্যিই অবাক হয়ে যেতাম! কিছুই নয়, হয়ত ফ্রকের গলায়, হাতে আর ঘেরে রকমারি রঙিন সুতোয় সূক্ষ্ম সূচের কাজ, অথবা প্লাস্টিকের ডেকরেটিভ বোতাম না কিনে অন্য বোতামে রঙিন ম্যাচিং কাপড় মুড়িয়ে বোতাম তৈরি করে নেওয়া, স্টাইলিশ একটা বেল্ট জুড়ে দিল কোমরে, রঙিন কন্ট্রাস্ট পাইপিং ...এইরকম সব। আমার খুব গর্ব হত অমন নতুন, একেবারে অন্যরকম ফ্রক পরে মণ্ডপে যাওয়ার সময়ে। তখন আর মনেও পড়ত না যে ঠাম্মার পাশে শুয়ে শুয়ে শুনেছি কত কত নিশুতি রাত পর্যন্ত মায়ের হাত মেশিন চালানোর শব্দ। মায়েরও হয়ত নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল আমাকে নিজের হাতে সেলাই করে ফ্রক বানিয়ে পরানো। তাই দরজির কাছে জামা বানানো বাতিল করার পর থেকে আমার জন্য গোটা চারেক ফ্রক প্রতি পুজোয় সেলাই করে দিত মা।
তারপর তো শাড়ি পর্ব শুরু হল। সঙ্গে অবশ্য ট্রাউজার্স আর রকমারি টপ কেনা হয়েছে কয়েক বছর, তবে সেগুলো ফ্যাশন করার জন্য ততটা নয়, যতটা কলেজে যাতায়াতের বা প্র্যাকটিকাল ক্লাস করতে সুবিধা হবে ভেবে কেনা। শাড়ি কিনতে কখনও নিজে গেছি বলে মনে পড়ে না। হয় মা আর ঠাম্মা, তারপর ঠাম্মা যখন আর শয্যাশায়ী দাদুকে ছেড়ে দোকানপাট করতে চাইত না, তখন একাই মা । দুটো শাড়ি হত বাড়ি থেকে। একটা টাঙ্গাইল, অন্যটা প্রিন্টেড সিল্ক বা শিফন জর্জেট গোছের। অবরেসবরে বাড়তি একটা বা দুটো ছাপা শাড়ি ... তাও খুব চোখে লেগে গেলে তখনই।
এই যে পুজোর বাজার, এই গোনাগুনতি কেনাকাটার মধ্যে বড় হওয়া, এর ফলে যেটা হল, আমার যখন স্বাধীন জীবন, কিঞ্চিৎ স্বাধীন উপার্জন এবং স্বাধীনভাবে কেনাকাটার সুযোগ এল, দেখলাম দিন কেমন বদলে গেছে! আর বাজেট করে ফর্দ করে পুজোর বাজার করার দিন নেই। এখন বহুতল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকানে গিয়ে কফি বা পেপসি দিয়ে আপ্যায়িত হতে হতে সকলের সারা বছর ধরে পুজোর শপিং করার চল। নগদের কারবার নেই, ব্যাগ ওলটালে বেইজ্জত হতে হবে, কারণ সব কিছুই প্রায় চলছে ধারে, অর্থাৎ ক্রেডিট কার্ডে। তবু এই শপিং করার নামেই কে যেন আমার আঁচল টেনে ধরে। একটু বেশি দামী শাড়ি জামা কেনার সামর্থ্য হয়েছে, কিন্তু মধ্যবিত্ত মানসিকতা যায়নি। পছন্দ হয়েছে খুব, তবু সন্তর্পণে দোকানীকে আড়াল করে দামের ট্যাগ দেখি। এখন ডিজাইনার জামা, জুতো। ব্র্যান্ডেড সব কিছু। যে শাড়ি আগে সাধারণ দোকান থেকে হয়ত হাজার -বারোশ’ টাকায় কিনে বাইরে এসে দোকানীর মুণ্ডপাত করেছি পঞ্চাশ টাকা দাম কমায়নি বলে, আজকাল সেই একই শাড়ি যখন বুটিকে দেখি পাঁচ হাজারে বিকোচ্ছে, নির্বিকার থাকি। আমার মুখের একটি রেখাও কাঁপে না।
এখন পুজোর সময়ে ঝুরো সোনার চুড়ি, বিছে হার, ফুলঝুমকো আর লাল কুমকুম নেই। সিঁদুর খেলার সময়ে অবশ্য মহিলাদের মধ্যে সিঁদুর পরার প্রবণতা দেখি, তবে সেটা কতটা খেলার ঝোঁকে আর কতটা সোশাল মিডিয়ায় ছবি তুলে পোস্ট করার উৎসাহে ...সন্দেহ আছে আমার। এখন তো সব ঝুটো পুঁতি আর রঙিন সুতোর গয়না, পাখির রং করা পালক, ঝিনুকের দিন। শাড়ি জামা শপিং-এর সঙ্গে সঙ্গে ম্যাচিং নকল গয়নাও তো চাই! এখন আর সরলাদিদি, বঙ্কিমদাদারা পুজোর দিনে সকালবেলা স্নান করে নতুন শাড়ি -জামা পরে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ায় না। তাদের এক মাসের মাইনে বোনাস দিতে হয়। তারাও তো যাবে শপিং করতে!
শুধু এই কেনাকাটা আর শপিং ... এ দুইয়ের মাঝে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে আছেন জগজ্জননী দুর্গা, কারণ ...
তাঁর বরাদ্দ শাড়ি আর সাজ অর্থাৎ শাঁখা-সিঁদুর-আলতা-নোয়া-দর্পণ ...এ সবের ঠিকানা ওই পুরোনো আমলের শাড়ির দোকানে আর দশকর্ম ভাণ্ডারেই আটকে আছে।
কারণ...সে সব কিছুই এখনও চলটা ওঠা সিমেন্টের চৌকাঠ পেরিয়ে ঝাঁ চকচকে আয়না-মোড়া ম্যানিকিন-শোভিত বিপণিতে প্রবেশের অধিকার অর্জন করে উঠতে পারেনি।
এই লেখা লিখতে লিখতে মনে পড়ে গেল, আমাদের সময়ে পুজোর কেনাকাটা হত যখন, আরও একটা দুটো জিনিস তালিকাভুক্ত হত। প্রথমটা ছিল বিভিন্ন পত্রিকার শারদ সংখ্যা।

আরও পড়ুন, দুর্গাপুজো: বারোয়ারির একাল সেকাল

আসলে পুজো মানেই তো শিশিরে নিকানো শিউলিফুলের আলপনা আঁকা মাটির গন্ধ, নৈবেদ্যর ফলপাকুড়ের মিঠে সুবাস, নতুন কাপড়ের খসখসানি, ধূপ-দীপ, ঢাকের বাদ্যি, শাঁখের ফুঁ, প্রতিমার মুখে চিকচিকে গর্জনতেল আর একটা একটা করে পুজোসংখ্যা শেষ করা। দুপুরে আবছা আলোমাখা ঘরে ভরপেট স্পেশাল মেনুর পরে মুখশুদ্ধি ওই পুজোসংখ্যা। খুব ছটফট করতাম। ওই শারদ পত্রিকার জন্য বড় লোভ ছিল আমার। আনন্দমেলা, কিশোরভারতী, আনন্দ আর দেবসাহিত্য কুটীরের পুজোর বই এক আশ্চর্য কুবেরের ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হত। এগুলোর মধ্যে দেবসাহিত্য কুটীরের বই ছিল আবার একেবারে আলাদা! বাঁধানো, ঝকঝকে মোটা কাগজে একেবারে লা-জবাব! আমার এক জেঠু প্রতি বছর পুজোয় আমাকে ‘আনন্দ’ পুজোবার্ষিকী কিনে দিতেন। মনে পড়ে, জন্ম-হ্যাংলা আমি উচাটন হয়ে থাকতাম কখন তিনি দরজায় এসে কড়া নাড়বেন, সেই অপেক্ষায়। তারপর অবশ্য আমার পড়ার পরিধি বাড়ল। বড়দের পুজোপত্রিকা তালিকায় যোগ হল। তখন তো বইয়ের যুগ ছিল, ইন্টারনেট-মোবাইল ফোন জানতামও না কাকে বলে! এমনকি আমাদের বাড়িতে তো ওই ঢাউস পেটমোটা কালো ভুশুণ্ডিকাকের মতো ল্যান্ডফোনও ছিল না! আমি শুধু গুনতাম। ক’টা জামা আর ক’টা পুজোপত্রিকা। মহালয়ার আশেপাশে শুরু হয়ে যেত তাদের আসা। তা এখন তো দেখি বর্ষা আসার আগেই সোরগোল তুলে পুজোসংখ্যা চলে আসে। গতিক যা দেখছি, এরপর হয়ত দেখব পরের বছরের পুজোসংখ্যা এ বছরেই বেরোতে চলেছে ...এমনটা দাঁড়াবে। প্রিমি বেবি যেন! মাতৃগর্ভ থেকে হুটোপুটি করে বেরিয়ে এল! ফলে পুজোর দুপুরে হাতে পেন্সিল! আগে আগে পুজোপত্রিকাগুলোতে ‘খারাপ’ লেখা হাতে গোনা ছিল। অন্তত নামী হাউসের ক্ষেত্রে। এখন ‘ভালো’ লেখা হাতে গুনতে গেলে হতাশা আসে। অবশ্য খরচ কমেছে কিছু আমার। আগে পনেরোটা পত্রিকা কিনতাম। এখন সংখ্যাটা কমছে। আগে পুজোসংখ্যার উপন্যাসের অনেকগুলিই বই হিসেবে বেরোলে হামলে পড়ে কিনতাম, এখন কিনি না। কিনব কী! আজ পড়লে পরশু মনে থাকে না কী পড়েছি! স্মৃতিভ্রংশ নয় কিন্তু, ডাক্তার অভয় দিয়েছেন। গতবার মাত্র দুটি উপন্যাস কিনেছি বইয়ের আকারে! আমাদের ছোটবেলায় সাধ ছিল প্রচুর, সাধ্য ছিল মুঠির মাপে। এখন যা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, সাধ্য অনেকটাই, সাধও কিছু কম নেই, কিন্তু তার রকমফের ঘটে গেছে। পুজোবার্ষিকীর বিক্রি, আমার ধারণা আগের মতো অতটা নেইও হয়ত! কারণ বই পড়ার সময় কমে যাচ্ছে বেশিরভাগ মানুষের। এখন শুধু ইঁদুর দৌড় আর ইঁদুর দৌড়! পিছিয়ে পড়লে চলবে না!
আরও একটা জিনিস ছিল পুজোর সময়ের। পুজোর গান। নতুন নতুন গানবাজনার রেকর্ড বেরোত এবং সেইসব গানের বাণী আর গায়ক-গায়িকার ছবি দিয়ে বই প্রকাশ করত এইচ এম ভি, মেগাফোন, হিন্দুস্তান রেকর্ডস কোম্পানি। আমাদের বাড়িতে প্রথমে বই আসত, তারপর পুজোর গান বাজত রেডিওতে, অনুরোধের আসরে আর তারপরেই মধ্যবিত্ত সংসারের ব্যাঙের আধুলি জমিয়ে কিনে ফেলা হত একটা দুটো পছন্দের রেকর্ড।
এখনও নিশ্চয়ই পুজোর গান হয় কিছু কিছু। তবে রেকর্ডে নয় আর, সি ডি তে। এইচ এম ভি-র গানের বই ‘শারদ অর্ঘ্য’ এখন ধূলিমলিন স্মৃতিমাত্র। ইউ টিউবের দাক্ষিণ্যেই মূলত এখন আমার গান শোনার দিনরাত্রি আবর্তিত হয়।
বদলে গিয়েছে সব কিছু। আমার চারপাশটা যেমন বদলেছে, বদলেছি আমিও। তাই আলাদা করে পুজোর বাজেট করি না, ফর্দ করার পাট নেই, নতুন সুতো-নতুন জুতো-নতুন বই-নতুন গানের চৌহদ্দিতে আর অলিগলিতে বছরভর আমার কমবেশি ঘোরাফেরা। প্রয়োজনমাফিক অথবা ক্ষেত্রবিশেষে শখ মেটাতে।
এখন প্রতিমা, পুজো সব কেমন থিমনির্ভর। অন্তত হেভিওয়েট বারোয়ারি পুজোগুলো তো বটেই! আমাদের জীবনযাপনও এখন যান্ত্রিক অভ্যস্ততায় চলে। আমি নিজেই তো হারিয়ে ফেলেছি কাটা ফলের মিঠে সুবাস, নৈবেদ্যর আতপ চাল ভেজানোর পরে হাতের হিমেল ভাব, ভোগের খিচুড়ির স্বাদ, সন্ধিপুজোর প্রদীপের আলো, আধফোটা কমলকলির সৌন্দর্য, বিসর্জনের বাজনা... সব কিছু। এখন তো আর নীলকণ্ঠ পাখিও ওড়ানো হয় না। সে না কি বেআইনি। তাই পুজোর সময়ে আমি আমার স্মৃতির কবুতরখানা হাট করে খুলে দিই। একশ দু’শ পায়রা উড়ে যায় জ্যামিতিক নকশা এঁকে। ছড়িয়ে পড়ে নীল আকাশের অসীম ছেয়ে।

সাদায়-কালোয় আঁকা সেই নকশা। কারণ আমি এখন শুধু সাদা আর কালোতেই অতীত ছুঁতে পারি।

Durga Puja 2019
Advertisment