নিখিল নির্মলের শাস্তি হোক। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, এটা অনুরোধ মনে করলে অনুরোধ, দাবি মনে করলে দাবি। কিন্তু শাস্তি চাই আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসকের। শাস্তি চাই এই ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন আইএএস অফিসারের, যিনি সস্ত্রীক থানায় ঢুকে নির্বিচারে মারধর করেন এক যুবককে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জেলাশাসকের স্ত্রী-কে ওই যুবক কটূক্তি করেছিলেন বলে অভিযোগ. যে কটূক্তির জেরে জেলাশাসকের এই লাগামহীন ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। ভিডিও মারফৎ সারা রাজ্যে যে দৃশ্য এখন 'ট্রেন্ডিং'।
কেন শাস্তি চাই? সংশ্লিষ্ট যুবক তো স্বীকার করেছেন ভিডিওতেই, "অন্যায় হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দিন স্যার। ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম।" দোষ স্বীকার করার পরও, ক্ষমা চাওয়ার পরও ডিএম এবং তাঁর স্ত্ৰী ওই যুবককে মেরেছেন বারবার, সে জন্য শাস্তি চাই? ক্ষমা করে দেওয়া উচিত ছিল, করেন নি। উল্টে মেরেছেন। তাই শাস্তি চাই?
ব্যাপারটা অত সহজ নয় কিন্তু। সংশ্লিষ্ট যুবক এক মহিলাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অশালীন কটূক্তি করেছেন। সেই মহিলা জেলাশাসকের স্ত্রী কিনা সে প্রশ্ন এখানে গৌণ। যুবকটি গর্হিত কাজ করেছেন। অভিযোগ দায়ের হয়েছে। আইন অনুযায়ী শাস্তি হওয়া উচিত ওই যুবকের।
শাস্তি হওয়া উচিত দোর্দণ্ডপ্রতাপ নিখিল নির্মলেরও, যিনি একটি গর্হিত কাজের প্রতিক্রিয়ায় আইন কানুন শিকেয় তুলে আরও বেশি গর্হিত একটি কাজ করে বসেছেন। প্রিয়জনের বিরুদ্ধে কটূক্তি শুনলে সহ্যসীমা ছাড়াতেই পারে মানুষের, প্রতিক্রিয়ায় মেজাজ হারানোও অস্বাভাবিক নয়। আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে হয়, নিখিল নির্মলের ক্ষেত্রেও হয়েছে।
আরও পড়ুন: সত্যিই কি অসভ্য বিরাট কোহলি?
মুশকিল হল, নিখিল সেই অর্থে সাধারণ আমজনতার পংক্তিভুক্ত নন। তিনি একজন উচ্চপদস্থ আমলা, একটি জেলার প্রশাসনিক দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত। সেই দায়িত্বের সূত্রেই প্রভূত সরকারি ক্ষমতার অধিকারী। যে ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয়েছে জেলার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের পরিচালনায় এবং সার্বিক উন্নয়নকল্পে। এবং নিজের সেই ক্ষমতা-প্রভাব-প্রতিপত্তির দম্ভে অন্ধ হয়ে সস্ত্রীক ঢুকে পড়েছেন থানায়, পুলিশের সামনেই বেধড়ক মেরেছেন গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তকে। শাস্তি চাই ক্ষমতার এই অপব্যবহারের। শাস্তি চাই সেই দর্পের, যার জোরে নিখিল থানায় ঘোষণা করেছেন সোচ্চারে, "আমার জেলায় আমার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলবে না!"
"আমার জেলা?" নিখিল নির্মল, কে ভাই আপনি? একজন আইএএস অফিসার, দেশের অন্যতম কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত। এই তো? এর বেশি তো কিছু নয়। তা 'আপনার জেলা' মানে? জেলাটা মানুষের। আপনার আগেও অনেক জেলাশাসক এসেছেন, আপনার পরেও আসবেন। 'আপনার জেলা' আবার কী? যদি কোন জেলাশাসক বলেন, 'আমার জেলায় কোথাও পানীয় জলের অভাব থাকবে না', বা কোনো জেলার পুলিশ সুপার যদি বলেন, 'আমার জেলায় আমি ডাকাতি হতে দেব না', সে বলার মধ্যে একটা ইতিবাচক অনুষঙ্গ থাকে, কাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা থাকে।
কিন্তু নিখিলের 'আমার জেলা'-য় তো জমিদারি প্রভুত্ব ঠিকরে বেরোচ্ছে। ঔদ্ধত্যের একটা সীমা থাকবে তো! নিখিল নির্মলকে বোঝানো দরকার, সাধারণ মানুষের টাকায় তাঁর মাইনে হয়। তিনি জেলার জমিদার নন। তাঁর স্ত্রী-ও জমিদারগিন্নি নন। জেলাটা জেলাবাসীর, এবং জেলাশাসক অন্যায় করলে জেলার প্রতিটি মানুষের অধিকার আছে তাঁর সমালোচনা করার। একশোবার আছে, হাজারবার আছে। এই অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শাস্তি চাই জেলাশাসকের।
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, দশ দিনের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন নিখিল নির্মলকে, যাতে ক্ষমতার নেশায় বুঁদ আর কোন আমলা ভবিষ্যতে থানায় ঢুকে গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তকে সরাসরি খুনের হুমকি না দিতে পারেন, "তোমাকে যদি আধঘন্টায় থানায় ঢুকিয়ে দিতে পারি, তাহলে তোমার বাড়ি গিয়ে তোমাকে মেরেও ফেলতে পারি!"