Advertisment

এই সময়, আমরা এবং রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’

রবি ঠাকুরের জন্মদিনে মুক্তধারা মনে পড়ে মুর্শিদাবাদবাসী নীহারুলের। কারণ তাঁর দৈনন্দিনতায় তিনি প্রত্যক্ষ করেন, তাঁর পাশের গ্রামগুলি ভেঙে পড়ে, পড়তেই থাকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
niharul rabindranath100-003

ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

নীহারুল ইসলাম

Advertisment

আমার বসবাস এমন এক ভৌগোলিক অবস্থানে যেখানে আমি বাম পাশ ফিরে শুলে ‘ভাগীরথী’ আর ডান পাশ ফিরে শুলে ‘পদ্মা’-কে হাতে পাই। স্বভাবতই নদী যদি সভ্যতার ধারক-বাহক হয় তাহলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলতেই পারি। দীর্ঘ সাড়ে চার দশকের কিছু বেশি আমার এই জীবন ওই দুই নদীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মনে পড়ে প্রথম নদী দেখার অভিজ্ঞতার কথা। ভাগীরথীর পুবপারে রাঢ় বাংলায় আমার মাতুলালয়। সেখানেই আমার জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা। আর, পশ্চিমপাড়ে পৈতৃক ভিটে। স্বভাবতই ভাগীরথী পারাপারটা ছিল আমার কাছে খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। যদিও প্রথম নদী দেখা নিয়ে যে ঘটনাটা আমার মনে পড়ে সেটা হল, নানী ও খালার সঙ্গে গরুরগাড়ি চড়ে একবার পৈতৃক ভিটেতে এসেছি। ভাগীরথী তখন জলহীন। ধূ ধূ সাদা বালির নদী একটা। গরুরগাড়ির টাপরের ভেতর বসে কিংবা নানী-খালার কোলে শুয়ে কখন সেই নদী পেরিয়েছি, টের পাই নি। কিন্তু দুই-তিন দিন পর, ফেরার সময়! বাবুলাল না তোতামামা কে যেন গাড়োয়ান ছিল! হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আল্লারে আল্লা! কত পানি! কী জোরে ছুটি যেছে!

টাপরের ভেতর আমি তখন কী করছিলাম কে জানে! ওই চিৎকার শুনে চমকে উঠেছিলাম। টাপরের ভেতর থেকে মাথা বের করে তাকিয়েছিলাম। আর দেখেছিলাম, জায়গাটা বালিয়ার ঘাট। আমাদের গরুরগাড়িটা ঠিক ঘাটের ওপর একটা বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। জোয়ালে বাঁধা গরুজোড়া অবাক বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে দেখছে সামনে পানির অবিরাম ছুটে চলা স্রোতকে। আমিও দেখছি। তবে জলের স্রোত নয়, আমার চোখে তখন সেটা একটা ঢেউ-খেলানো সাদা চাদর! আমার চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

সেদিন জানতাম না। কিন্তু আজ জানি, ফরাক্কা ব্যারেজের ইতিহাস। কলকাতা বন্দরকে বাঁচাতে যে ব্যারেজ নির্মাণ হয়েছিল। পদ্মার মূল স্রোতকে আটকে স্লুইস গেট-এর মাধ্যমে আশ্চর্য কৌশলে ভাগীরথীতে সেই মূল স্রোতকে প্রবাহিত করায় ছিল যার প্রধান উদ্দেশ্য! অবাক হয়েছিলাম।

আরও পড়ুন, রবীন্দ্রনাথের ‘বক-কবিতা’

তারপর আজ পর্যন্ত ভাগীরথী দিয়ে যেমন যেমন স্রোত বয়ে গেছে তেমন তেমন আমার বয়সও বেড়েছে। আমি তেমন তেমন বুঝতে শিখেছি এবং দেখেছি, আজও দেখি- যে নদী থেকে বেরিয়ে ভাগীরথী হুগলী বন্দরের দিকে ছুটে চলেছে তার মূল স্রোত পদ্মা আমার পৈতৃক ভিটের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সারা বছর সে শরমে মুখ লুকিয়ে থাকে। যেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া মেয়ের মা! অথচ বর্ষা এলেই সে বেহায়া হয়ে যায়। ঘর ছাড়া মেয়ের মায়ের চেয়েও বেহায়া। কিংবা পাগলি। সন্তান হারা মায়ের মতো অবস্থা তার। ভয়ঙ্করী! বিধ্বংসী! এই এটা ভাঙছে তো এই সেটা। নিজেই নিজের পরনের কাপড় ছিঁড়ে কুটি কুটি করছে।

নদীর ভাঙ্গনে অন্ত্যজ জনপদ হারিয়ে গেলে আমরা খেয়াল করি না। কেউ আমাদের খেয়াল করায় না। নদী (ভাগীরথী, পদ্মা কিংবা পৃথিবীর যে কোনো নদী ...) ! কিন্তু যে জনপদে পেপসি, কোকাকোলা বিক্রি হয়! সেই জনপদ নদীর ভাঙ্গনে বিলুপ্ত হলে নদী একটু-আধটু বদনাম হয়। পদ্মা সেই কারণেই ‘মুন্নি’র মতো বদনাম হয়েছে। সদ্য পেপসি-কোকাকোলা বিক্রি হওয়া তেমন দু’টি জনপদ আমি নিজের চোখের সামনে বিলুপ্ত হতে দেখেছি। আখেরীগঞ্জ এবং জলঙ্গী। আমার লালগোলা এখনো বিলুপ্ত হয়নি। তবে যা পরিস্থিতি, হতে বেশি দেরি নেই। কিন্তু সেই সব জনপদ যেগুলির কথা কেউ জানে না। ভুল বললাম। আমার বন্ধুরা, যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁদের অন্যতম দ্রষ্টব্য থাকে লালগোলা সংলগ্ন পদ্মা। বন্ধু যারাই এসেছেন তাঁদের নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি পদ্মার পাড়ে। যে জায়গায় একবার দাঁড়াই, পরের বার সেটা থাকে না, বিলীন হয়ে যায় পদ্মার গর্ভে।

আমার পৈতৃক ভিটে, গ্রামের নাম মৃদাদপুর। কেউ কেউ ‘মজ্জাতপুর’ বলে। ছোট একটা গ্রাম। তার মধ্যে আবার একটা পাড়া আছে। নাম ‘খান্দুয়াপাড়া’। এখন পদ্মা যেখান দিয়ে বইছে, তার থেকে পাঁচ-সাত কিমি দূরে ‘খান্দুয়া’ নামে একটা গ্রাম ছিল। সেখানকার জোতদার সুকুমারবাবু, ২২০০ বিঘা সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তাঁর ওই ২২০০ বিঘা সম্পত্তি পদ্মা গোগ্রাসে গিলে খেয়েছিল। কথিত আছে- শুধুমাত্র সুকুমারবাবুর বাড়িটা যখন অবশিষ্ট, কোন জোতিষী নাকি বলেছিল, ... দুধপূজা দিলে পদ্মার আক্রোশ কমবে! সুকুমারবাবু তার এলাকার যত গোরুমোষের দুধ সব খরিদ করে দিনের পর দিন পদ্মায় বইয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত বাড়ি রক্ষে করতে পারেন নি।

আরও পড়ুন, পাগলের পাগলামি কিংবা একটি নিখাদ প্রেমের গল্প

আর, তার প্রজারা? কাদের কী হয়েছিল জানি না, তবে আমাদের খান্দুয়াপাড়ায় যাদের বাস- সবাই নিম্নবিত্ত মুসলমান, তাদের পূর্ব পুরুষেরা পদ্মার আক্রোশ থেকে বাঁচতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের গ্রামে। সেই কারণেই ওই পাড়াটার নাম হয়েছিল খান্দুয়াপাড়া। তাদের মুখেই প্রথম শুনি পদ্মা নদীর কথা। আর একদিন সাইকেল নিয়ে বাঁধপুল ধরে ছুটে যায় সেই পদ্মার পাড়ে। মনে আছে, সময়টা বর্ষাকাল। আমার চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শৈশবে দেখা সেই ঢেউ-খেলানো সাদা চাদরটা। যদিও এখানে তার বিস্তৃতি বেড়েছে অনেকটাই। সেই সঙ্গে সৌন্দর্য! আমি হাঁ করে গিলছি। সঙ্গে ছিল আমার মুন্তাচাচা। সে বলেছিল, বাপ্‌- এই বর্ষাকালেই লদিতে যা পানি! অন্য সুমায় লদি এক্কেবারে শুখা মেরে পড়ে থাকে। বিশ্বাস হয়নি তার কথা। তারপর অন্য সময় একা গিয়ে দেখেছি। সত্যি সত্যি পদ্মা শুকিয়ে কাঠ মেরে পড়ে থাকে নিজের পেটের ভেতর।

আজও ওই একই অবস্থা! শুধুমাত্র বর্ষাকালে বিহার-উত্তরপ্রদেশকে প্লাবন থেকে বাঁচাতে ফরাক্কা ব্যারেজের অনেকগুলি গেট খুলে দেওয়া হয়। তখন পদ্মা কিছুদিনের জন্য তার সৌন্দর্য ফিরে পায়। কিন্তু সেই সৌন্দর্য যে কত সর্বনাশা পদ্মাপাড়ে বাস করে আমরা তা প্রতি পদে টের পাই। তাই পদ্মার সৌন্দর্য এখন আর মনে আনন্দ জাগায় না। বদলে আতঙ্ক জাগায়। যে কোনও বর্ষায় আমরা ভিটে হারা হতে পারি। মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী ভূখণ্ডের প্রাণবন্ত যে আবাদ, নিমেষেই তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে! তখন হয়ত আমরা অন্য কোনও ভূখণ্ডে গিয়ে ‘খান্দুয়া পাড়া’র মতো ‘লালগোলা’ কিংবা ‘মুর্শিদাবাদ’ নাম নিয়ে নতুন বসত স্থাপন করবো-উদ্বাস্তু হয়ে বেঁচে থাকবো ...

যে কোনও মুক্তধারাকে যদি এভাবে রুদ্ধ করা হয় তাহলে এরকমই ঘটে, ঘটে চলে। রবীন্দ্রনাথ এটা সেই কতদিন আগে, যখন আমাদের দেশে কেন, পৃথিবীতেই নদী-বাঁধের প্রচলন হয়নি, ব্যাপারটা তিনি অনুধাবন করেছিলেন। এবং লিখেছিলেন, নাটক ‘মুক্তধারা’। দুর্ভাগ্য আমাদের! তখনও আমরা সেটা বুঝতে পারিনি। এখনও বুঝতে পারি না। কিংবা বুঝেও বুঝতে চাই না। কারণ, আমরা ‘উন্নয়ন’-এর পক্ষে ...

Rabindranath Tagore
Advertisment