Advertisment

Rajiv Gandhi Assassination: ৯ ভোল্টের ব্যাটারি কিনে ২৭ বছর জেলে

তাঁর অনুপ্রেরণাতেই এক জেল খাটা আসামি কাঞ্চিপুরমে তাঁর নামে শুরু করেছেন ‘পেরারিভালান এডুকেশনাল ট্রাস্ট’, যেখানে পড়াশুনো করে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের ছেলেমেয়েরা। তামিলনাড়ুর বহু ছেলেমেয়ের নামকরণ করা হয়েছে পেরারিভালানের নামে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
a-g-perarivalan

২৭ বছর জেলে কাটল পেরারিভালানের (ফাইল ফোটো- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)

পুনকুজালি

Advertisment

আজ, ১১ জুন, ২০১৮। পেরারিভালানের জেলবাসের ২৭ বছর পূর্ণ হল। ১১ জুন, ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় পেরারিভালানকে। পেরারিভালানের ডাকনাম আরিভু। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯। সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ করে কালই ছেড়ে দেওয়া হবে জেনে পেরারিভালানের বাবা-মা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁদের আরিভু-কে। সাতাশ বছর পরেও সেই 'কাল'-এর অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।

ছাড়া হয়নি তো বটেই, পরের ৫৯ দিন ধরে আরিভুর কোনও খোঁজই মেলেনি। তাঁর বাবা-মা হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন ফাইল করার ব্যাপারে দোনোমোনা করছিলেন, কারণ তাহলে আরিভু যে হাজতে রয়েছেন সে কথা সবাই জেনে যাবে। তাঁরা ভাবছিলেন আরিভু ছাড়া পেয়ে যাবেন, কারণ তিনি কোনও অপরাধ করেননি। তাঁদের ভারতের বিচারব্যবস্থার ওপরেও ভরসা ছিল। আশা ছিল, নিরপরাধী কখনও সাজা পেতে পারে না। গত ২৭ বছর ধরে আইনি লড়াই লড়তে লড়তেও সে আশাটুকু তাঁরা জিইয়ে রেখেছেন। আরিভু যে নিরপরাধ সে কথা প্রমাণ করতে কারও দরজায় কড়া নাড়তে বাকি রাখেননি তাঁরা। সে কড়া নাড়া আজও চলছে।

আরও পড়ুন: Gauri Lankesh: প্রসঙ্গ গৌরী লঙ্কেশ, একটি খোলা চিঠি

তাঁদের আশা বারবার ভেঙেচুরে গেছে, বারবার তাঁরা লড়াইয়ের শক্তি অর্জন করেছেন, বারবার গোড়া থেকে শুরু করেছেন। সত্যই তাঁদের শক্তি হয়ে থেকেছে। সত্য এই, রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডে আরিভু যুক্ত ছিলেন না।

আরিভুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার জন্য যে বোমা ব্যবহৃত হয়েছিল তা বিস্ফোরণ করার জন্য একটি ৯ ভোল্টের ব্যাটারি সরবরাহ করেছিলেন তিনি। এই ধরনের ব্যাটারি সর্বত্র পাওয়া যায়, যে কোনও দোকানে। আরিভুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণ ছিল এক দোকানির সাক্ষ্য, যিনি জানিয়েছিলেন তাঁর দোকান থেকে ব্যাটারি কিনেছিলেন আরিভু। একটি খুচরো দোকানের মালিকের পক্ষে ঘটনার বেশ কয়েক মাস পরেও কে তার দোকান থেকে কী কিনেছিলেন সেটা মনে রাখা খুবই আশ্চর্যের। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, আরিভুর পকেট থেকে ঘটনার বেশ কয়েকমাস পরে ওই ব্যাটারি কেনার রসিদও পায় সিবিআই। আর বাকি প্রমাণ বলতে আরিভুর নথিভুক্ত স্বীকারোক্তি।

মামলা দায়ের করা হয়েছিল টাডা আইনে। এই আইনানুসারে একজন পুলিশ অফিসার স্বীকারোক্তিমূলক বয়ান নথিবদ্ধ করেন। কিন্তু আমরা জানি পুলিশ হেফাজতে বয়ান নেওয়ার জন্য পুলিশ কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। পেরারিভালানের ওপরেও থার্ড ডিগ্রি শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার চালিয়ে তাঁকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয়। রেকর্ড অনুযায়ী, স্বীকারোক্তিমূলক বয়ানে লেখা আছে, পেরারিভালান ব্যাটারি কিনে রাজীব হত্যার মূল চক্রী শিভরাসানকে সেই ব্যাটারি দেয়। এই স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে পেরারিভালানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু ঘটনার ২৬ বছর পর, ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর, প্রাক্তন সিবিআই অফিসার ভি তিয়াগারাজন (তৎকালীন এসপি, অতিরিক্তি ডিজিপি হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) সুপ্রিম কোর্টে একটি হলফনামা দাখিল করেন। সে হলফনামায় তিনি জানান, পেরারিভালানের স্বীকারোক্তি যিনি নথিভুক্ত করছিলেন, তিনি একটি অংশ বাদ দিয়েছিলেন। কী ছিল সে অংশে? "যে ব্যাটারি ও কিনেছিল, তা কী কাজে ব্যবহার করা হবে সে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না।" যদি এ অংশটা নথিভুক্ত হত, তাহলে কী হত? তিয়াগারাজন জানাচ্ছেন, তাহলে কেবলমাত্র ৯ ভোল্টের ব্যাটারি সরবরাহের দায়ে পেরারিভালান রাজীব হত্যার ষড়যন্ত্রী হিসেবে গণ্য হত না।

তিয়াগারাজন আরও জানিয়েছেন, "সিবিআই পেরারিভালানের ভূমিকা নিয়ে নিশ্চিত ছিল না, কিন্তু তদন্ত যত অগ্রসর হয়েছে, ততই এ ষড়যন্ত্রে তার অজ্ঞতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।" এ প্রসঙ্গে ১৯৯১-এর ৭ মে রাজীব হত্যার মূল চক্রী শিভারাসানের এলটিটিই-র উচ্চপর্যায়ের নেতা পোট্টু আম্মান-কে পাঠানো ওয়্যারলেস মেসেজের উল্লেখ করেছেন তিয়াগারাজন। ওই মেসেজে শিভারাসান জানিয়েছিল, "আমাদের উদ্দেশ্য তিনজন ছাড়া কেউ জানে না।" এই তিনজন হল শিভারাসান নিজে, শুভা, এবং আত্মঘাতী বোমারু ধানু। এই ওয়্যারলেস মেসেজ থেকেই স্পষ্ট যে পেরারিভালানকে তারা নিজেদের লোক বলে গণ্য করেনি।

আরও পড়ুন: এবার মায়ের নামেই পরিচিত হোক সন্তানেরা

কেবলমাত্র স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করেই পেরারিভালানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এবং ২৭ বছর ধরে জেলেই রয়েছেন তিনি। আজ ২৬ বছর পর যে স্বীকারোক্তিমূলক বয়ানের বিশ্বাসযোগ্যতা ভেঙে পড়েছে।

পেরারিভালানের বয়স এখন ৪৬। ২৭ বছর তিনি জেলে কাটিয়েছেন। তার মধ্যে ২৩ বছর কেটেছে সলিটারি কনফাইনমেন্টে। তাঁর মৃত্যুর দিন ধার্য হয়েছে একধিকবার। জেলে বহু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু এর কোনও কিছুই তাঁর মুখের হাসিটুকু কেড়ে নিতে পারেনি।

২৭ বছর একজন মানুষের জীবনে বড় কম সময় নয়। পেরারিভালানের হাজতবাসের এক বছর পর তাঁর বোনের বিয়ে হয়। সেই বোনের সন্তানেরা আজ সফটওয়্যার প্রফেশনাল। আরিভুর হারানো সময়ের সাক্ষী তারা। এত বছরের কারাবাস একজন মানুষের সমস্ত বোধ কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু আরিভুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। আরিভু দাঁড়িয়ে আছেন শক্ত হয়ে।

জোলারপেটের এক স্কুল শিক্ষকের সন্তান, সাধারণ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা আরিভুর গ্রেফতারি তাঁর পরিবারের ক্ষেত্রেও ভয়ংকর ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আরিভুর নিজের ক্ষেত্রে তো বটেই। তবু না আরিভু ভেঙে পড়েছেন, না তাঁর পরিবার। আইনজীবীদের সঙ্গে বসে নিজের মামলার নথিপত্রের খসড়া নিজেই ঠিক করেন তিনি। যারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, আরিভু তাঁদের কাছ থেকে জেনে নেন বাইরের পৃথিবীতে কী কী ঘটছে, সে বিজ্ঞান হোক, কী রাজনীতি, খেলাধুলো কিংবা চিকিৎসা।

ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষায় ৯১.৩৩ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন আরিভু। আজ পর্যন্ত জেল থেকে যতজন পরীক্ষা দিয়েছে তাদের মধ্যে তাঁর স্থানই সর্বপ্রথম। তামিলনাড়ু ওপেন ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় গোল্ড মেডেল পাওয়ার পর কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের মাস্টার ডিগ্রিও করা হয়ে গেছে তাঁর।

publive-image ২৭ বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে ছেলের সঙ্গে জেলে দেখা করতে যান অর্পুতম (ছবি: অরুণ জনার্দন)

জেল থেকে যারা পরীক্ষা দেয়, তাদের পড়ান আরিভু। সহ বন্দিদের সঙ্গে একটা মিউজিক ব্যান্ড চালান। তাঁর সারল্যভরা হাসি আর শিষ্টাচার সকলকেই মুগ্ধ করে, সে উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মচারী থেকে অন ডিউটি কনস্টেবল, যাবজ্জীবন দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামি থেকে খুচরো অপরাধী, যেই হোক না কেন। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই এক জেল খাটা আসামি কাঞ্চিপুরমে তাঁর নামে গঠন করেছেন 'পেরারিভালান এডুকেশনাল ট্রাস্ট', যেখানে পড়াশুনো করে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের ছেলেমেয়েরা। তামিলনাড়ুর বহু ছেলেমেয়ের নামকরণ করা হয়েছে পেরারিভালানের নামে।

আজ পেরারিভালানের মুক্তির দাবিতে গণ আন্দোলন হচ্ছে। রাজীব গান্ধী হত্যা মামলার এক অপরাধী থেকে রাজ্যের ঘরে ঘরে সমাদৃত এক নাম হয়ে ওঠা রাতারাতি ঘটেনি। এসবের পিছনে যিনি রয়েছেন, তাঁকে সবাই ভালোবেসে আরিভাম্মা বলে ডাকে। আরিভাম্মা, মানে আরিভুর মা।

আরিভাম্মার আসল নাম অর্পুতম। ২৭ বছর ধরে ছেলের মুক্তির জন্য লড়াই চালাচ্ছেন, তাঁর বয়স এখন ৭১। ছেলের গ্রেফতারির আগে পর্যন্ত তিনি শুধু পরিবারের একজন ছিলেন। কিন্তু আরিভুর গ্রেফতারের পর উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ২৭ বছরে এমন একটি সপ্তাহ যায়নি, যে সপ্তাহে তিনি ছেলেকে দেখতে যাননি। ঝড়বৃষ্টির দিনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আরিভু আর সংবাদমাধ্যম, দু পক্ষের কাছেই তিনি জানালা। তাঁর মাধ্যমেই সংবাদমাধ্যম জানতে পারে আরিভুর কথা। তাঁর মাধ্যমেই আরিভু জানতে পারেন সংবাদমাধ্যমের কথা।

পেরারিভালানের মুখ যারা মনে করতে পারেন না, তাঁরাও অর্পুতমকে চেনে। জেল, আদালত আর আইনজীবীর দফতরে চরকি পাক খান তিনি। তামিল ছাড়া অন্য কোনও ভাষা না জানা সত্ত্বেও তিনি সারা দেশের মানবাধিকারকর্মীদের কাছে গিয়ে জানান তাঁর ছেলে নিরপরাধ।

অর্পুতমের দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর ছেলে মুক্তি পাবেই। কারণ সে নিরপরাধ। তাঁর এই বিশ্বাস তাদের সকলের কাছেই পরীক্ষার সমতুল্য, যাঁরা গণতন্ত্র ও ন্যায়সমাজে বিশ্বাস রাখেন। তাঁর বিশ্বাস ভারতীয় বিচারব্যবস্থার কাছেও পরীক্ষার সমতুল্য। ন্যায়বিচারে ইতিমধ্যেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে।

(পুনকুজালি চেন্নাইয়ের লেখক ও সমাজকর্মী)

Rajiv Gandhi Assassination Perarivalan Arputham
Advertisment