পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্যে পাঁচটি আসন ফাঁকা হয়েছে। এর মধ্যে চারটিতে জিতবে তৃণমূল। বাকি আসনটি নিয়েই যত গোলমাল। বামফ্রন্ট (আসলে সিপিএম) আর কংগ্রেস একজোট হলেই তাদের প্রার্থী এই আসনে জিতবে। আর আগের দু-একবারের মত কংগ্রেস যদি তলায় তলায় তৃণমূলের সঙ্গে কথা বলে সিপিএমকে ফাঁকি মেরে দেয়, তাহলে চিত্রনাট্য লেখা হবে অন্যভাবে। সিপিএম বা বামপন্থী মানেই যে সব ভালো এমন নয়। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করলে এই মুহূর্তে দক্ষিণপন্থীদের যে দাপট, তাকে কিছুটা রোখার জন্যে বামপন্থীদের প্রভাব বাড়া জরুরি।
ঠিক কিভাবে বামপন্থীরা দেশের রাজনীতিতে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলেছেন সেই ইতিহাস আবার লিখে শব্দ নষ্ট না করাই ভালো। পশ্চিমবঙ্গে নব্বুইয়ের দশক থেকে তৈরি হওয়া বামেদের মাঝের সারির বেকার নেতারাই আজকে তৃণমূল কিংবা বিজেপির সম্পদ। রাজনীতির যে সুবিধাভোগী শ্রেণী সিপিএম এই সহস্রাব্দের প্রথম দশক (২০০০-২০১০) এবং গত সহস্রাব্দের শেষ দশকে (১৯৯০-২০০০) সৃষ্টি এবং পুষ্ট করে ফেলেছে, তারাই তৃণমূলের ছাতার তলায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি গত দশ বছর (২০১০-২০২০) চালিয়েছে। সামনের দশ বছরেও এর খুব পরিবর্তনের আশা নেই। কেন্দ্রেও বিজেপির সবে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু। পরিবর্তনের কথা ভাবা এখন তাই দেশদ্রোহী হওয়ার মতই পাপ।
আরও পড়ুন: মোদীর বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর’ পোস্ট করে ধৃত শিক্ষক
এটাও বুঝতে হবে যে দেশের রাজনীতিতে বিজেপি খুব বেশি দুর্নীতির পাঁকে ডুবে নেই। মুশকিল হলো, তাদের আগ্রাসী ক্ষমতা দখলের যে রাস্তা, সেখানে পুরোটাই বিভাজনের অঙ্ক। সময়মত পড়শি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ কিংবা নিজের দেশের মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের হানাহানি, এই ধরনের পরিকল্পনার সফল রূপায়ণে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তাদের আছে। চার বছর পরে লোকসভা ভোটের আগে তারা সেই ব্যাপারটা ঠিক বুঝে নেবে।
অর্থাৎ সোজা অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সামনের কয়েকবছর তৃণমূল আর বিজেপি ছাড়া অন্য কোনও দলকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কেন্দ্রে বিশুদ্ধ বিজেপি। দরকারমতো আপের সাহায্যও তারা পাবে। দিল্লিতে এত বীভৎস হানাহানির সময় আপ সরকারের আসল কাজে লবডঙ্কা, এদিকে সামান্য একটা ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে কানহাইয়া কুমারের বিরুদ্ধে পুরনো কেস ধুলো ঝেড়ে বের করার সময় আছে।
এই পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিক নিয়মেই বামপন্থীরা সংসদে লুপ্তপ্রায়। কিন্তু সঙ্গে এটাও সকলেই মানেন যে লোকসভা বা রাজ্যসভায় এক আধজন শিক্ষিত, বামপন্থী সাংসদ থাকলে অতি দক্ষিণপন্থীদের চাপিয়ে দেওয়া তীব্র বিভাজনের নীতির বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিবাদ হয়। সেই জায়গাতেই আগামী ২৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে সীতারাম ইয়েচুরি নির্বাচিত হবেন কিনা, সেই আলোচনা চলছে।
আরও পড়ুন: দিল্লি দাঙ্গার নৈতিক দায়িত্ব কেউ নিচ্ছেন না কেন?
সীতারামবাবুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবেন না। বক্তা হিসেবে অসাধারণ, এবং তাঁর দখল আছে বেশ কয়েকটি ভাষায়। ১৯৭০ সালে সিবিএসই বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় সারা ভারতে প্রথম হন তিনি। কংগ্রেসের ওপরের সারির নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কথা দিল্লির রাজনীতিবিদ মাত্রেই জানেন। তৃণমূল কংগ্রেসও তীব্র বিজেপি-বিরোধিতার যে রাস্তায় হাঁটছে, তাতে সীতারাম ইয়েচুরি পশ্চিমবঙ্গ থেকে জিতলে তাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। সেই হিসেবে ইয়েচুরি সাহেবের এবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু চায়ের কাপ আর ঠোঁটের মধ্যে 'স্লাইড ক্যালিপার্স' দিয়ে দূরত্ব মাপতে হয়। তাই অঙ্ক এখানে কয়েকটি থাকছে। রাজনীতি থেকে নীতি বাদ দিয়ে কংগ্রেসের কোনও নেতা রাজ্যসভায় যাওয়ার আশায় তৃণমূলের অতিরিক্ত ভোট এবং বিজেপির আটটা জোগাড় করে ফেলতেই পারেন। কয়েকদিন এই নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি হবে, কিন্তু তারপর আবার সব ঠাণ্ডা।
এ তো গেল এক, তারপর দুইও আছে। কারণ ডালের ওপর বসে থাকা কালিদাস সিপিএম-কেও খুব বিশ্বাস নেই। রাজ্যসভার প্রার্থী ঠিক করতে গিয়ে তাদের সংবিধানের কোন ধারা থেকে যে কী নিয়ম বেরিয়ে আসবে কে জানে। এমনিতেই পরপর তিনবার তাদের দলের কোনও নেতা রাজ্যসভার প্রার্থী হতে পারেন না। দুবারের পর তাই মাঠের ধারে বসতে হয়েছে সীতারামকে। মনে রাখতে হবে, সিপিএম-এর জন্মলগ্ন ১৯৬৪ সাল থেকে এই প্রথম (২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পর) দেশের লোকসভা বা রাজ্যসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত দলের কোন সাংসদ নেই। যে অতিশিক্ষিত বাম তাত্ত্বিক নেতারা দলটাকে এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন (সেই নেতারা অবশ্য প্রথাগত শিক্ষায় সীতারামের মত এত ভালো নন), তাঁরা কিছু একটা যুক্তি খুঁজে সীতারামকে ল্যাং মারতেই পারেন।
আরও পড়ুন: দিল্লির অন্ধকার: আমাদের শাসকরা নির্মমতা, বিভাজন, ভয় আর হিংসা ভরা রাষ্ট্র চান
২০১৭-তেও রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস উৎসাহী ছিল সীতারামকে আবার রাজ্যসভায় পাঠাতে। কিন্তু ঐ যে, পরপর তিনবার যাওয়া যাবে না। সম্ভবত মার্কিন দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে নিয়মটি টুকেছে সিপিএম-এর পলিটব্যুরো, যেখানে পরপর দু'বারের বেশি চেয়ার দখল করে রাখা বারণ। তবে সেক্ষেত্রে জ্যোতি বসু ঠিক কত বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, সে প্রশ্নও উঠবে। আসলে নিয়ম কখনও লোকসভা, বিধানসভা, বিজেপির চিন্তনদল বা সিপিএমের পলিটব্যুরো বানায় না। পুরোটাই ঠিক করেন কিছু মানুষ। নিয়ম আসলে নিয়ম নয়, কিছু ক্ষমতাশালী নেতানেত্রীর চোঁয়াঢেকুর মাত্র। আশা করা যাক, সিপিএম এবার আর ২০১৭-র পর রাজ্যসভার পুরো সময় ছয় বছর পেরোয় নি বলে নিজের নাক কেটে ইয়েচুরির যাত্রাভঙ্গ করবে না।
২০০৫ থেকে ২০১৭, এই বারো বছর রাজ্যসভায় সীতারাম ইয়েচুরির অবদান অনস্বীকার্য। হয়ত বিজেপির ওপরের সারির নেতারাও চান, তাঁদের দলের অশ্বমেধ যজ্ঞে মাঝে মাঝে কিছুটা যুক্তিযুক্ত এবং উচ্চমানের রাজনৈতিক বিরোধিতা আসুক। সেই হিসেবেই সিপিএম তাদের গভীর যুক্তিজালে দলের অন্দরে বিষয়টা গুলিয়ে না দিলে সীতারাম এবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় যাচ্ছেন।
তৃণমূল কংগ্রেস কাদের রাজ্যসভায় পাঠাবে, তা অবশ্যই ঠিক করবেন সে দলের সুপ্রিমো। পেশাদার প্রশান্ত কিশোর নিশ্চয় সেই নিয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছেন। ভালো এবং শিক্ষিত মানুষ তাঁদের দলেও আছেন। আছেন ভালো বক্তা, ভালো অর্থনীতিবিদ, নামজাদা অধ্যাপক কিংবা শিক্ষক, যাঁরা পড়তে পারেন, বুঝতে পারেন, বিশ্লেষণ করতে পারেন, এবং দেশটাকে যেভাবে একেবারে দক্ষিণপন্থী এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে গলা চড়াতে পারেন। বাম হওয়ার দায় তাঁদের নেই, তবে নেহরুর ভাবধারায় মধ্যপন্থী একটা জায়গায় দেশটাকে শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড় করিয়ে রাখার মত যুক্তিবোধ তাঁদের আছে। উদাহরণ হিসেবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং টেলিভিশন বিতর্কে অতিপরিচিত রাজনৈতিক মুখ তৃণমূল কংগ্রেসের ওমপ্রকাশ মিশ্রের কথা বলা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্র এবং দেশদ্রোহিতা- জয়প্রকাশ নারায়ণ, ফার্নানডেজ থেকে বিদারের শিশুরা, শরজিল ইমাম
সবশেষে আবার ফিরে আসতে হবে বামপন্থীদের কথায়। রাজ্যসভা থেকে এই এপ্রিল মাসে অবসর নিচ্ছেন ৫৫ জন সাংসদ। সেখানে কি কোনওভাবে সিপিআই-এর কানহাইয়া কুমার কিংবা সিপিআইএমএল-এর দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের কথা বলবেন কেউ? কানহাইয়া কুমারকে অনেকেই চেনেন। দেশের রাজনীতিতে অতিপরিচিত মুখ তিনি, বাম আন্দোলনের একেবারে প্রথম সারিতে। তুলনায় জনগণের কাছে কিছুটা কম পরিচিত ১৯৭৯ সালের উচ্চমাধ্যমিকে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সারা রাজ্যে প্রথম হওয়া দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। আজকে তিনি দেশের একটি অতিবাম সংসদীয় দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। বিজেপির তীব্র দক্ষিণপন্থাকে দাঁড়িপাল্লায় আনুভূমিক করতে এমন নেতার প্রয়োজন বৈকি।
কিন্তু এঁদেরকে রাজ্যসভায় নিয়ে যাবে কে? বিজেপি-বিরোধী দেশের প্রধান দলগুলি তার চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধে খুঁজবে ধনকুবের কোনও ব্যবসায়ীকে উচ্চকক্ষে পাঠিয়ে। আসলে ভাবনায় কার্ফু আমাদের চলছেই। এরপরে আসবে কলকাতা পুরসভা নির্বাচন। সেখানে অনেক বামনেতার কথা আলোচনা হবে। কিন্তু সিপিএম কি চাইবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যার স্বনামধন্য অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাসকে কলকাতার মেয়র হিসেবে ভাবতে? অন্য ধারার রাজনৈতিক ভাবনা আশির দশক থেকে শুরু করেছিল বিজেপি। আধুনিক সংগঠন এবং উচ্চশিক্ষিত মানুষদের নিয়ে দল চালিয়ে আজ তারা অপ্রতিরোধ্য। বিরোধীরাও সেই পথে কিছু ভাববে কি?
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)