চল্লিশ দিন টানা চলার পর শেষ হয়েছে অযোধ্যার বিতর্কিত জমি মামলার শুনানি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বেরোতে পারে রায়। অযোধ্যার মন্দির হবে, না মসজিদ হবে, নাকি পৃথক পৃথক জমিতে কাছাকাছি দুটিই সম্ভব? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য গোটা দেশ এখন তাকিয়ে আছে। আবার লখনউয়ের আদালতেও চলছে আর এক মামলা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসে অভিযুক্তদের শাস্তির মামলা।
এসবের মধ্যেই দেখছি গোটা দেশজুড়ে, বিশেষত উত্তর প্রদেশের সাধু-সন্ত তথা সংঘ পরিবার, বিজেপি সমর্থক, হিন্দুত্ববাদী রামভক্ত জনসমাজ, এই আশায় বসে আছে যে সুপ্রিম কোর্ট রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষেই রায় দিতে চলেছে। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের জন্য রাজস্থান ও গুজরাট থেকে পাথর আনা শুরু হয়ে গেছে। করসেবকপুরমে এক মডেল রাম মন্দির নির্মাণ হয়ে গেছে। অযোধ্যার কাছেই এই এলাকায় কাতারে কাতারে মানুষ আসছেন এই মন্দির দেখার জন্য।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: অযোধ্যা মামলায় মোড়- কাকে বলে ওয়াকফ?
সরযূ নদীর তীরে এই অযোধ্যার নাম একদা ছিল কোশল দেশ। হিন্দুদের বিশ্বাস, এখানেই রামচন্দ্রের জন্মভূমি। রামচরিত মানসে তুলসীদাস সেকথা লিখে গেছেন। কিন্তু সে কলিযুগের কথা নয়, ত্রেতা যুগের কথা। আরও বলা হয়েছে, ১৫২৮ সালে এই স্থানে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। এই বিতর্ক নিয়ে মামলা বহু প্রাচীন। ১৮৮৫ সালে এই মামলা আদালতে যায়। ২০০৯ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে এই এলাকাকে তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ হিন্দুদের, অন্যভাগ মুসলিমদের দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ হলে শীর্ষ আদালত এলাহাবাদের রায় খারিজ করে দেয় ২০১১ সালে।
বাবরি মসজিদ ভাঙার পর নরসিংহ রাও সরকার ফের এই বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। সে সময়ে বলা হয়েছিল, বিজেপি এবং কংগ্রেসের বিতর্ক এড়ানোর জন্য নরসিংহ রাও সুপ্রিম কোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে সময় অতিবাহিত করে রাজনৈতিক উত্তাপ কমাতে চেয়েছিলেন। তবে রাও এই সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ছিলেন না।
এত বছর পর নরেন্দ্র মোদী জমানায় তফাৎ একটাই। সুপ্রিম কোর্টের উপর চাপ দিয়ে সরকার পক্ষ বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চাইছে। কংগ্রেস নেতা ভি এন গাডগিল আমাকে একবার বলেছিলেন, কংগ্রেসের সাবেকি রণকৌশল হলো, "ঠান্ডা করকে খাও"। একটা মজার উদাহরণ দিয়েছিলেন গাডগিল। তিনি বলেছিলেন, "আমরা মারাঠিরা কীভাবে গরম চা খাই, দেখেছ? খুব গরম চা সরাসরি খেতে গেলে জিভ পুড়ে যায়। তাই চা-টা প্লেটে ঢেলে ধীরে ধীরে সুপ-সুপ শব্দ করে খাই।" অযোধ্যা ইস্যুতেও কংগ্রেস এই কৌশল নেয়।
আরও পড়ুন, বাবরি থেকে এনআরসি, মানুষের ভালো থাকার রাজনীতি কি হেরে যাবে?
মোদী জমানায় প্রশাসনিক কর্মদক্ষতা কয়েকশো গুণ বেশি এই জন্য, যে বিজেপির যে দর্শন, বিজেপির যে কর্মসূচি, তা কার্যকর করতে মোদী-অমিত শাহ দুজনেই বদ্ধপরিকর। দেখুন, ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত আপনার পছন্দ নাও হতে পারে। মনে হতে পারে, এ সিদ্ধান্ত ভুল। মনে হতে পারে, মোদী-অমিত শাহ এর ফলে বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। মনে হতে পারে, এর ফলে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও তীব্র হয়ে উঠবে। কিন্তু একথাও সত্য, এই যে ৩৭০ ধারার বিলোপ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, এবং রাম মন্দির নির্মাণ, এগুলি মোদী-অমিত শাহর সৃষ্ট কোনও আকস্মিক ইস্যু নয়। এ তো আরএসএস-জনসংঘের আমল থেকে দলের প্রধান তিনটি কোর মতাদর্শগত ইস্যু।
তাহলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি যখন দু-দুবার ভোট জিতল, তারপর দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারের কর্মসূচির বাস্তবায়ন, এ তো মোদী-অমিত শাহর প্রতিশ্রুতি পূরণ। অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এনডিএ সরকার এবং শরিক দলগুলির মতাদর্শগত অবস্থানও আলাদা ছিল। তাই পদে পদে শরিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হতো বাজপেয়ীকে। তার মানে এটা ভাবার কারণ নেই যে বাজপেয়ীর মতাদর্শ অন্য কোনও মতাদর্শ ছিল।
অনেকে বলেন, গোধরা কাণ্ডের পর মোদীর উপর বেদম ক্ষুব্ধ হন বাজপেয়ী। তিনি চেয়েছিলেন, মোদী মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিন। আডবাণীর তীব্র আপত্তিতে মোদীকে সরাতে বাজপেয়ী সক্ষম হননি। ওই সময়ে কী হয়েছিল, আমি তার সাক্ষী। বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠক। বৈঠকে মোদীর ইস্তফা চেয়ে একটা অংশ সক্রিয়। এই গোষ্ঠীতে যশোবন্ত সিংহ এবং বাজপেয়ী-ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু নেতা ছিলেন। বৈঠক শুরুর দিন সকালবেলা সব টিভি চ্যানেলে খবর চলছিল, চন্দ্রবাবু নাইডুর দাবি, গোধরা কাণ্ডের জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ইস্তফা দিন। সেই জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকটি হচ্ছিল ব্যাঙ্গালোরে।
হোটেলের ঘরে সবে ঘুম থেকে উঠে টিভি দেখছি। চন্দ্রবাবুর দাবি, এদিকে বিজেপির মোদী-বিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয়। ফোন করলাম আডবাণীকে। সাত সকালে। তখন মোবাইল ছিল না। হোটেলের ল্যান্ডলাইন থেকে আডবাণীর হোটেলের ঘরের ল্যান্ডলাইনে। আডবাণী শুধু দুটি কথা আগাম বলেছিলেন। প্রথমত, মোদীর ইস্তফার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। দ্বিতীয়ত, দলের অবস্থান এটাই। কোনও পার্থক্য নেই। বিকেল তিনটের সময় জেনা কৃষ্ণমূর্তি সাংবাদিক বৈঠক করে একথা তোমাদের জানিয়ে দেবেন। সেদিন আমার রুমমেট ছিল সতীর্থ সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী। ও পাশের খাটে ঘুমোচ্ছিল। এই কথোপকথনে ওর ঘুম ভেঙে গেল। বলল, আরে এর মানে তো মোদী থাকছেন। আমরা খবরের কাগজে কাজ করতাম দুজনে। তাই তখনই খবরটা ধরানোর কোনও প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া আডবাণী বললেও আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বিকেল তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর দেখলাম, জেনা কৃষ্ণমূর্তি সত্যি সত্যি ঘোষণা করলেন যে মোদীর ইস্তফা দেওয়ার সংবাদ অসত্য। অমূলক।
তাহলে সেদিন বৈঠকে বাজপেয়ী নীরব ছিলেন কেন? রাম জন্মভূমি আন্দোলন নিয়ে হিমাচল প্রদেশে দলের কর্মসমিতির বৈঠকে বাজপেয়ী প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু দল রাম মন্দির আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই আন্দোলনই বিজেপিকে ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে আসে, এবং জোট সরকারের সর্বসম্মত চরিত্র বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হন।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: আরএসএস এবং শিখ: ধর্ম, পরিচয় ও রাজনীতি
আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। গোধরার পর বাজপেয়ী মোদীকে ডেকে পাঠান। দীর্ঘ বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রীর নিবাসে। তারপর সেদিনই মোদী বৈঠক করে আমেদাবাদ চলে যান। বৈঠকের পরেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রে চ্যানেলে-চ্যানেলে খবর হয়, বাজপেয়ী ক্ষুব্ধ। মোদীকে তিনি ইস্তফা দিতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন দফতরের কেউ আমাদের এ খবর জানান যে বাজপেয়ী ক্ষুব্ধ। আমরা বলতাম, বাজপেয়ী 'স্পিন ডক্টর'। সেদিন সন্ধ্যায় মোদীকে ফোন করলাম আহমেদাবাদে। তিনি অবাক হয়ে যান এ খবর শুনে, কারণ বাজপেয়ী কখনোই তাঁর কাছে এ ধরনের কোনও ক্ষোভ প্রকাশ করেন নি।
সময়টা বদলে গেছে। এখন মোদী ও বিজেপির প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। শুধু তাই নয়, এই গুরু-শিষ্যের মধ্যে কিন্তু একটা ‘কারেজ অফ কনভিকশন’ আছে। মোদী যা মনে করেন, তাই করেন। একটা মত আছে, এভাবে স্টিমরোলার দিয়ে মতামত চাপানোর চেষ্টা গোটা দেশের ওপর, এটা গণতন্ত্রের নৈরাজ্য। মোদী দেশের আর্থিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার না দিয়ে কাশ্মীর বা অযোধ্যা, হিন্দুত্ব বা পাক সন্ত্রাসের বিষয় নিয়েই ব্যস্ত। এর ফলে কী হচ্ছে? এর ফলে দেশের অগ্রগতি হচ্ছে না। দেশের মানুষকে হিন্দুত্বর অ্যাড্রিনালিন দেওয়া হচ্ছে। চিরকাল এভাবে চলতে পারে না। অদূর ভবিষ্যতে একদিন না একদিন এই কৃত্রিম কর্তৃত্বের সৌধ তাসের ঘরের মতোই ভেঙ্গে লুটিয়ে পড়বে।
গণতন্ত্রে ভিন্ন মতের পরিসর আছে। কিন্তু এখানে আমার প্রশ্ন হলো, রাজনীতিতে বিরোধী পরিসর থাকলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। সেই বিরোধী পরিসর কোথায়? রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস প্রধান প্রতিপক্ষ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মহারাষ্ট্র–হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচনেও তো কংগ্রেসের মতো বিরোধী শক্তিকে খুঁজেই পাচ্ছি না। উলটে যদি সত্যি-সত্যিই সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতায় মোদী জমানায় অযোধ্যার মতো বিতর্কের অবসান হয়, তার জন্য মোদীকেই তো অভিবাদন দিতে হবে।
অনেকে বলতে চাইছেন, এ এক নতুন মিডিয়া যুগ। নতুন মিডিয়া-সংস্কৃতি, সিটিজেন সাংবাদিকতা হচ্ছে। মোবাইলে ছবি উঠছে। টুইট। হোয়াটসঅ্যাপ। সোশ্যাল মিডিয়ার আধিপত্য। বিরোধীরা বলছেন, মোদী এই পরিকাঠামোকে কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু এ তো গোটা দুনিয়ারই এক নতুন প্রক্রিয়া। এর সুযোগ তো রাহুল গান্ধী, কেজরিওয়াল সহ সকল বিরোধী নেতাদেরও পাওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ফৈজাবাদে গিয়েছিলেন মোদী। সে জেলার নাম তখনও অযোধ্যা হয়নি। তবে সে দফায় রামলালা দর্শন করেন নি মোদী। এবার ভোটের আগেও অযোধ্যার বিতর্কিত স্থলের ধারেকাছে ঘেঁষেন নি তিনি। ত্রিশ কিলোমিটার দূরে জনসভা করে ফিরে এসেছেন। দুবার 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি তুলেছেন, কিন্তু মন্দির নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেন নি। বিজেপি ও স্থানীয় সাধু-সন্তদের প্রত্যাশা, রাম মন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কাজ করবেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
সব মিলিয়ে মোদী-অমিত শাহর রাজনীতির কলাকৈবল্যটা বুঝতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপে একটা সূত্র আছে মোদী জমানায়। সেটা না বুঝলে প্রতিপক্ষের পক্ষেও এই কর্তৃত্বের মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।