Advertisment

তিন দশকের ব্যবধান পেরিয়ে শুনছি পিকে'র কণ্ঠস্বর, 'ফাইট বেঙ্গল, ফাইট!'

১৯৮৯-৯০ সালে বাংলার রঞ্জিজয়ী দলের সদস্য ছিলেন শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়। সেমিফাইনালে তাঁর হ্যাট-ট্রিক সমেত পাঁচ উইকেটই ফাইনালে তোলে বাংলাকে। রঞ্জি ফাইনালের প্রাক্কালে তিন দশক আগের সেই ম্যাচে ফিরে গেলেন তিনি

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
ranji trophy bengal team 1990

১৯৯০ সালের রঞ্জি ট্রফি জয়ী বাংলা দলের কিছু সদস্য - (ওপরের বাঁদিক থেকে) অরুণ লাল, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল চট্টোপাধ্যায়, শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়

হাসপাতালে ভর্তি হতে যাওয়ার আগে সাংঘাতিক অসুস্থ প্রদীপ কুমার ব্যানার্জি (পিকে) তাঁর কন্যার দিকে তাকিয়ে হাতটা দিয়ে বলে গেলেন, "লেট মি ফাইট ইট আউট"। লড়াই পিকে ব্যানার্জির রক্তে। সম্ভবত ক্লাব ও দেশের ফুটবল কোচিংয়ে 'ম্যান ম্যানেজমেন্টের' কাণ্ডারি ও প্রবক্তা তাঁকে বলাই যেতে পারে। তাঁর বিখ্যাত 'ভোকাল টনিক' যে কী, তার একটা আস্বাদ পেয়েছিলাম ১৯৮৯-৯০ সালে, যখন ইডেন গার্ডেনসে দিল্লির বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলা।

Advertisment

প্র্যাকটিসের শেষে সিএবি-র তরফ থেকে পিকে ব্যানার্জিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় তাঁর উপস্থিতির জন্য, এবং আমাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। পিকে সেদিন আমাদের সঙ্গে একঘণ্টা কথা বলেন, বিভিন্ন দৃষ্টান্ত দিয়ে আমাদের চাঙ্গা করে যান। পিকে-র রোমহর্ষক বক্তৃতা, তাঁর নিজস্ব কণ্ঠস্বরে, আমাদের তৈরি করে দিয়েছিল যে কোনও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।

তাছাড়া সেমিফাইনালে শক্তিশালী হায়দরাবাদকে তাদের মাঠে হারানোর পর থেকেই এক অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল আমাদের নিজেদের মধ্যে। ঘূর্ণি উইকেটে শিবলাল যাদব, আরশাদ আয়ুব, কনওয়ালজিত সিংয়ের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে কী ব্যাটিংই না করলেন অশোক মালহোত্রা! দ্বিশত রানের (২৫৮) এক অনবদ্য, 'চান্সলেস' ইনিংস খেললেন ঘরোয়া ক্রিকেটে স্পিন আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যাটিংয়ের রাজা 'শোকি প্রাজি'। তাঁর সঙ্গে ৯৩ রানের ইনিংস খেলে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন অরুণ লাল। উৎপল চ্যাটার্জি নেন চার উইকেট, হায়দরাবাদকে হারিয়ে বাংলা পৌঁছে যায় ফাইনালে।

ranji trophy final 2020 রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল, ১৯৯০, দিল্লি প্রথম ইনিংস

ranji trophy final 2020 রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল, ১৯৯০, বাংলা প্রথম ইনিংস

অপরদিকে ফাইনালে ওঠে দোর্দণ্ডপ্রতাপ দিল্লি দল। মুম্বই ৪০ বারের ওপর রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও দিল্লি ও উত্তরাঞ্চল ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী দল। মনু নায়ার, ভাস্কর পিল্লাই, বান্টু সিং, মোহন চতুর্বেদী ছাড়া দিল্লি দলে ছিলেন সাতজন টেস্ট প্লেয়ার। অধিনায়ক ছিলেন ১৯৮৩-র বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য কীর্তি আজাদ। আয়ার, পিল্লাই, বান্টু সিং ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে অত্যন্ত ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান। মনোজ প্রভাকর, সঞ্জীব শর্মা, অতুল ওয়াসন ছিলেন পেস বোলিংয়ের দায়িত্বে। তখনকার শ্রেষ্ঠ বাঁহাতি স্পিনার মনিন্দর সিং ও কীর্তি আজাদ শানাতেন স্পিন আক্রমণ।

টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় দিল্লি। রাজীব শেঠ ও দত্তাত্রেয় মুখার্জির আগুন ঝরানো বোলিংয়ে, এবং বাংলা দলের চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় ফিল্ডিংয়ের সামনে ২৭৮ রানে অল আউট হয় যায় তারা। একমাত্র কীর্তি আজাদ দুর্দান্ত কাউন্টার অ্যাটাকের জোরে করেন ৯৩ রান। প্রত্যুত্তরে বাংলা যোগ্য জবাব দেয় চার উইকেট খুইয়ে ২১৬ রান তুলে। অরুণ লাল এবং রাজা বেঙ্কট অপরাজিত থাকেন যথাক্রমে ৫২ এবং ৩৯ রানে।

তারপরেই বাধ সাধে তুমুল বৃষ্টি। আর এক বলও খেলা সম্ভব হয় নি। অনেকবার মাঠ পরিদর্শন করার পর কোশেন্টে বাংলা এগিয়ে থাকার দরুন স্বাধীনতার ৫২ বছর পর প্রথমবার তাদের রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। বাঁধভাঙ্গা আনন্দে মেতে ওঠেন বাংলা তথা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলার সমস্ত ক্রীড়াপ্রেমী। ঐতিহাসিক দিনই বটে।

তারপর এক আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস চলে আসে বাংলা তথা পূর্বাঞ্চল দলে। তারা একে একে জিততে শুরু করে দলীপ ট্রফি, দেওধর ট্রফির মতো শীর্ষস্থানীয় টুর্নামেন্ট। ১৯৯৩ ফাইনাল খেলার পর ২০০৫-০৬ এবং ২০০৬-০৭ বাংলা ফাইনাল খেলে। তবে ১৯৮৯-৯০ মরশুমে খুবই ব্যালান্সড দল ছিল বাংলা। ফাইনালে অধিনায়ক সম্বরণ ব্যানার্জি ও নির্বাচকদের এক অত্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। স্নেহাশিস গাঙ্গুলির জায়গায় অভিষেক ঘটে তাঁরই ছোট ভাই সৌরভের। করেছিলেন ২২ রান, কিন্তু জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন।

এবারের বাংলা দল অভিমন্যু ঈশ্বরনের অধিনায়কত্বে ছ'টি ম্যাচ সরাসরি জিতে রাজকোটে ফাইনাল খেলবে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বাংলা যেমন শক্তিশালী কর্ণাটককে হারায় সেমিফাইনালে, সৌরাষ্ট্রও তেমনি গুজরাটের মতো দলকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। ভুলে গেলে চলবে না, তারা কিন্তু খেলবে ঘরের মাঠে, পাবে তাদের সমর্থকদের সাহায্য। দলে ফিরে এসেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্দান্ত খেলোয়াড়, 'রান মেশিন' চেতেশ্বর পূজারা। জীবনের সেরা ফর্মে আছেন জয়দেব উনাদকাট। এখন অবধি ভারতের মাটিতে ৩৫টি উইকেট নিয়েছেন এই বাঁহাতি পেস বলার। আর মাত্র চারটি উইকেট নিলেই রঞ্জি ট্রফির এক মরশুমে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করবেন তিনি। চাট্টিখানি কথা নয়, একজন জোরে বোলারের পক্ষে।

রান চাই বাংলার প্রথম সারির ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে। একটা ভালো ওপেনিং পার্টনারশিপ ম্যাচের অর্ধেক কাজ করে দেয়। সুদীপ চ্যাটার্জি ফর্মে ফেরার কিছু আভাস দিয়েছেন, আগের ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ করে। মনোজ তিওয়ারি বাংলার ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড। তাঁকে তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা বড় ইনিংস খেলতে হবে। বাংলার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান মনোজ, জ্বলে ওঠার জন্য নিশ্চয়ই রঞ্জি ফাইনালের চেয়ে বড় মঞ্চ আর হতে পারে না।

অভিজ্ঞ ঋদ্ধিমান সাহার দলে আসা এক বিরাট প্রাপ্তি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উইকেটকিপার, তার ওপর তাঁর দুর্দান্ত ব্যাটিং পাবে বাংলা দল। কোয়ার্টার-ফাইনালে শতরান, এবং সেমিফাইনালেও লড়াকু শতরান করে অনুষ্টুপ মজুমদার জাত চিনিয়ে দিয়েছেন ৩৬ বছর বয়সে, এবং ফাইনালে একটা বড় ইনিংস আশা করছি তাঁর কাছ থেকে। ফর্মের নিরিখে হয়তো অভিষেক রমণের জায়গায় শ্রীবৎস গোস্বামীকে ওপেন করতে হতে পারে ঈশ্বরনের সঙ্গে। বাংলা যদি তিন জোরে বোলার ও শাহবাজকে নিয়ে খেলে, তবে সুদীপ ঘরামি দলে আসতে পারেন, অর্ণব নন্দীর পরিবর্তে। ফাইনালে খুব বেশি অদলবদল করবে না বলেই মনে হয় বাংলা দল।

লড়াকু অরুণ লাল খেলোয়াড় হিসেবে রঞ্জি জেতেন আজ থেকে তিন দশক আগে। এবার মেন্টর-কোচ হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ট্রফি জেতার হাতছানি। জীবনজুদ্ধেই হোক বা খেলার মাঠে, লড়াই বইছে তাঁর শিরায়-ধমনীতে। সেই মানসিকতার সংক্রমণ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন এই বাংলা দলের মধ্যে। বাংলা আজ অপ্রতিরোধ্য, শেষ শক্তি দিয়ে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাজকোটে ঝাঁপাবে নিশ্চিত।

কোথা থেকে যেন ভেন্টিলেটরে শুয়ে থাকা পিকে ব্যানার্জির ক্ষীণ অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, "ফাইট বেঙ্গল, ফাইট। বয়েজ, ইট ইজ নাও অর নেভার।"

শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের নিয়মিত কলাম পড়ুন এখানে

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন https://t.me/iebangla

Ranji Trophy Cricket Kahon
Advertisment