উষসী একজন ৫ বছরের কন্যা সন্তানের মা, গৃহবধূ স্বামী সন্তান নিয়ে তিন জনের সংসার। মেয়ে তিন্নি কলকাতার একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ে, নাচ গান সবই তাকে শেখানো হয়। আগামী মাসে তিন্নির নাচের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান আছে, অনুষ্ঠানে একটা স্লট বাচ্চাদের বাবা-মায়েদের জন্য রাখা হয়েছে যেখানে তারাও কিছু নাচ বা গান নিবেদন করবে। নাচের স্কুলে গিয়ে উষসী জানতে পারে তিন্নিকে একটা গানের সঙ্গে নাচতে হবে। কিন্তু স্কুলে গিয়ে তার অস্বস্তি চরমে ওঠে যখন সে শোনে তাকে তার মেয়ের মতো একই রকম পোশাক পরে, কোনও একটা নার্সারি রাইমের গানের সঙ্গে নাচ প্রদর্শন করতে হবে। তার শুরুতেই মনে হয় কী করে একজন ৩২ বছরের মহিলা তার ৫ বছরের সন্তানসুলভ ব্যবহার করতে পারে বা তার মতন অভিব্যক্তি তুলে ধরতে পারে? তিন্নি বিষয়টা নিয়ে বেশ উত্তেজিত, মা তার মতন করে কিছু একটা করতে চলেছে। উষসী কিছুতেই বিষয়টা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে পারে না। এই অস্বাভাবিক গল্পটা আরো অনেক দূর যেতে পারে। কিন্তু এটাই যদি আমরা ঠিক উল্টো ভাবে দেখি, যেখানে তিন্নি কে একটা অনুষ্ঠানে একটা বড়োদের গানের সঙ্গে বড়োদের মতো পোশাক পরে তাকে নাচতে বলা হতো! তাহলেই কিন্তু বিষয়টা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত হয়ে উঠত। সৌজন্য়- টেলিভিশনের রিয়ালিটি শো। সেখানে আবার শুধু নাচই নয়, তার সঙ্গে তাকে পরানো হয় মানানসই প্রাপ্তবয়স্ক পোশাকও। এই ছবি আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। আজকাল টেলিভিশন খুললে রিয়ালিটি শো মানেই তো তাই।
মঙ্গলবার ১৮ জুন, কেন্দ্রীয় তথ্য় ও সম্প্রচার মন্ত্রকের পক্ষ থেকে একটি অ্য়াডভাইসরি পাঠানো হয় দেশের বেসরকারি চ্য়ানেলগুলিকে। ওই পরামর্শ-বার্তায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে সাম্প্রতিক রিয়ালিটি শোগুলিতে শিশুদের অনুপযুক্ত ব্য়বহার, বিশেষ করে নাচের সময় প্রাপ্তবয়স্কদের অনুকরণ নিয়ে, যা অনেকক্ষেত্রেই অশালীন।
সাইকোলজিতে একটা বিশেষ মডেল আছে যাকে বলে বায়ো সাইকো সোশাল মডেল। জীববিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিত থেকে যদি দেখা হয়, তাহলে একজন শিশু তার বয়স অনুযায়ী, তার যে শারীরিক সাধ্য় তাকে অতিক্রম করে এমন একটি নাচ পারফর্ম করছে যা তার শরীরের উপর চাপ সৃষ্টি করে। শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় বয়সের সঙ্গে সমানুপাতে। এখানে সেই অনুপাত রক্ষিত না হওয়ায় দ্রুত ক্লান্তির শিকার হয়ে পড়ছে শিশুটি।
আরও পড়ুন, ‘রিয়্য়ালিটি শো-তে অশালীন হতে দেবেন না শিশুদের’, উপদেশ কেন্দ্রের
আবার, সামাজিক দিক থেকে দেখলে যেভাবে একজন শিশুকে এসব ক্ষেত্রে পণ্য়ায়িত করা হয়, সে দিকটিও ভয়ংকর। বিশেষ করে একজন বাচ্চা মেয়েকে যেভাবে দেখানো হয় তা অত্য়ন্ত কুরুচিকর ও দৃষ্টিকটু। দর্শকদের মধ্য়ে এ ধরনের পারফরম্য়ান্স বিকৃতমনস্কতার জন্য় দায়ী হয়ে উঠতে পারে। আবার অপরিণত মনে যা ছাপ ফেলে যাচ্ছে- তা হল, খোলামেলা পোশাক ও তৎসঙ্গে ইরোটিক ভঙ্গি যেন অতীব স্বাভাবিক এক বিষয়। এর সঙ্গেই যুক্ত থাকে জেন্ডার স্পেসিফিকেশনের প্রসঙ্গটি। শিশু মন জানছে একটি বিশেষ ধরনের পোশাক পরা এক মেয়ে বিশেষ ভঙ্গিমার মাধ্য়মে একটি ছেলেকে সিডিউস করতে সক্ষম। মেয়েরা যে পণ্য় তা শিশু মনে গেঁথে যাচ্ছে।
মনে রাখতে হবে ঠিক ও ভুলের ধারণা অপ্রাপ্তবয়সে ধোঁয়াশার পর্যায়ে থাকে। বয়ঃসন্ধির সময়ে সে ধোঁয়াশা মানসিক গঠনে সমস্য়া সৃষ্টি করে। যা বহু সময়ে ডিপ্রেশনে পরিণত হয়। মাত্রা ছাড়া ডিপ্রেশন আত্মহনন থেকে নানা রকম ক্ষতিকর পথের দরজা খুলে দেয়।
এই গোটা পরিস্থিতির জন্য় অভিভাবকদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা নিজেদের জীবনের অপ্রাপ্তিগুলি সন্তানদের মধ্য়ে দিয়ে পেতে চান। অন্য়দিকে থাকে খ্য়াতির মোহ। এসবের মাঝে পড়ে তলিয়ে ভাবার অবকাশ পান না তাঁরা। চাকচিক্য়ের আকর্ষণে তাঁরা প্রায় পথভোলা হয়ে পড়েন। যার মাশুল দিতে হয় সন্তানদের।
(জয়ী রায় মনস্তত্ত্ববিদ, মতামত ব্য়ক্তিগত)