scorecardresearch

প্রতিরোধের নতুন ভাষ্য

এই বীভৎস অন্যায়ের পরদিন সকালে দেশ দেখল আশ্চর্য একটি মুখ- মাথা ফেটে কপাল ঢেকে ঝরে পড়ছে রক্ত, মেয়েটির মুখে অমল এক হাসি।

jnu aishi
রক্তাক্ত হাসিমুখ হয়ে উঠল একটি অভয় আন্দোলনের প্রতীক

‘রক্তমাখা দুর্বার সেই শার্ট

ছিঁড়ে টুকরো হয়ে দেশে দেশে জীবনের নিশান হয়ে গেল…’

-মে দিনের কবিতা

শপথ গ্রহণ করে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাঁদের দুর্নীতির দরুণ দেশের মানুষের দুর্দশা চূড়ান্ত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। যে সাধারণ মানুষরা নিজেদের বুদ্ধি আর শ্রম দিয়ে দেশের সম্পদ ও সংস্কৃতি তৈরি করে এসেছেন, তাঁদের হাত থেকে পরিশ্রমের অধিকার আর বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্ত কেড়ে নিয়ে এই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী চক্ষুলজ্জাবিহীন ভাবে নিজেদের  সংকীর্ণ স্বার্থপূরণ করে চলেছেন। এই কাজে তারা প্রধান উপায় ঠাউরেছেন বেপরোয়া স্বজন-পোষণ, অন্যদিকে বেকারির সুযোগে সাময়িক অর্থলোভ দেখিয়ে কিছু যুবককে দুর্বৃত্ত হিসেবে ব্যবহার করাকে।

আদানি, মালিয়ার মত কিছু অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তকে অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা নিয়ে, দেশের অর্থনীতিকে চোট খাইয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে দেওয়া, এই প্রাকৃতিক সম্পদে ধনী দেশের সব সম্পদ প্রকাণ্ড সব বহুজাতিকের হাতে তুলে দেবার ‘কাজে’ সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো, এসবের পর সব দুর্দশা ও দুর্নীতির ফল দেউলিয়া অর্থনীতির বোঝা এরা তুলে দিতে চায় সাধারণ মানুষদের কাঁধে। কখনো নোট বানচাল করা, কখনও ধর্মস্থান নিয়ে, কখনও জাতিপরিচয়, কখনও নাগরিকত্বের অধিকার-এরকম হাজারো বানিয়ে তোলা সংকটে দেশের মানুষদের স্বাভাবিক জীবনকে এরা এমন পর্যুদস্ত করে দিয়েছে যাতে কেউ আর এসব দিকে মন দিতে না পারে।

এজন্য এই শাসকেরা নিজেদের শপথগ্রহণের প্রথম যে শর্ত, দেশের সেই গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংবিধানকেও লঙ্ঘন করতে তৈরি। মানুষের দীর্ঘকালের অ-প্রতিরোধে অভ্যস্ত হয়ে এদের সাহস এতখানিই বেড়েছিল যে এই শাসকবর্গ ভাবে ওরা যা-খুশি-তাই করতে পারে কারণ যে মানুষ ওদের বিপরীতে কথা বলবে তাদের ওরা ঘাতক পাঠিয়ে হত্যা করবে। করেছে। কালবুর্গি, গোবিন্দ পানসারে, গৌরী লঙ্কেশের মত মানুষদের। ‘নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারলে কী হবে! যদি এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়, কোথায় যাব’ আতঙ্কে আত্মহত্যাকারী আরও অন্তত পঞ্চাশজন নিরীহ, নিরপরাধ নারীপুরুষকে।

অন্যান্য রাজনৈতিক দল কথা বলেছে কিন্তু জোরের সঙ্গে নয়, বোঝাপড়ার সুরে। অল্পস্বল্প মানুষের প্রতিবাদেও এই শাসকেরা নিশ্চিন্ত ছিল। ভেবেছিল ভয় দেখিয়ে, ভুল বুঝিয়ে, অনর্গল মিথ্যে কথা বলে সকলকে চুপ করিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু  বাধা এল, দুর্বৃত্তায়নের সমস্ত সাহসকে তীব্র আঘাত করে।

বাধা এল যেখান থেকে এমন জোর ধাক্কা ওরা আশা করতে পারে নি। যুবছাত্রের দল ওদের ভেদবুদ্ধিকে, পীড়নের ভয়কে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিল। জামিয়া মিলিয়া, আলিগড়, শাহীনবাগ, উত্তরপ্রদেশ, যাদবপুর, কেরালা অন্ধ্রপ্রদেশ…উজ্জ্বল বনাগ্নির মত দ্রুত শহর থেকে শহরে, দেশময় ছড়াল এই প্রতিবাদ নয় শুধু, প্রতিরোধের আগুন। আন্দোলন এক আপাদমস্তক নতুন মোড় নিল।

রামমন্দির, এন আর সি, সিএএ, প্রত্যেকটি শিক্ষাসংস্কৃতিক্ষেত্রের মাথায় নিজেদের ধামাধরা লোক বসানো, অস্বাভাবিক ফী বৃদ্ধি- টুকরো টুকরো অন্যায় আর নীচতার জবাবে ঝলসে উঠল অন্যকোনো দাবিবিহীন এক নৈতিকতার লড়াই। দুর্নীতির কাদায় আপাদমস্তক মোড়া কুৎসিত চেহারাগুলো আরো খোলাখুলি দেখা গেল এই মূল্যবোধের লড়াইয়ের সামনে। এতদিন যা কিছু ঢাকা দেবার ভান ছিল খুলে ফেলতে হল সে সব- উর্দিপরা পুলিশকে দেখা গেল বাসে আগুন লাগিয়ে কাঁদানে গ্যাস আর বন্দুক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকতে। সযত্নচর্চিত বিভেদবুদ্ধি ফল দিল না।

ষাট দশকের কলকাতায় যেমন কলেজ স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে ওপরদিকে ছোঁড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল পাটকাঠি দিয়ে নিচদিকে ঘুরিয়ে দেবার কুশলতা আয়ত্ত করেছিল কলেজের ছাদে দাঁড়ানো ছাত্রদল, সেই একই উদ্ভাবনীবুদ্ধিতে হিজাব আর নামাজের টুপি পরে ‘পোষাক দেখে অপরাধী বোঝা’র জঘন্য দাবীকে ঠাট্টায় রূপান্তরিত করল আজকের নবীনেরা। বুঝিয়ে দিল ভালোবাসার চেয়ে, সমবেদনার চেয়ে শক্তিশালী হয়নি কোনো ভেদবুদ্ধির ফন্দি।

নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রী-অধ্যাপকদের আক্রমণ করতে ঢুকল অস্ত্রহাতে গুন্ডাদল। পুলিশ দাঁড়িয়ে রইল। কিশোর তরুণদের রক্ত ঝরল রাষ্ট্রের গুন্ডাবাহিনীর আঘাতে। দেশের একদল যুবকের হাতে স্বদেশের অন্যদের রক্তপাত ঘটল রাষ্ট্রনায়কদের ইশারায়। এই বীভৎস অন্যায়ের পরদিন সকালে দেশ দেখল আশ্চর্য একটি মুখ- মাথা ফেটে কপাল ঢেকে ঝরে পড়ছে রক্ত, মেয়েটির মুখে অমল এক হাসি। এই সরল সাহস আসেনা নিজের আদর্শের প্রতি, নিজের সাথীদের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রবল ভালোবাসা ছাড়া।

অকারণ ঘৃণা আর বিভেদের রাজনীতির সামনে জেগে উঠল ওই ছবি। মেয়েটির নামও করছিনে আমি। নাম তো কেবল একজন ব্যক্তির চিহ্ন, কিন্তু ঐ রক্তাক্ত হাসিমুখ হয়ে উঠল একটি অভয় আন্দোলনের প্রতীক। পাঁচবছর পরে ঐ ব্যক্তি মেয়ে চলে যাবে নিজের জীবনপথে। মাথা ফেটে যায় কত তুচ্ছ কারণেও, কিন্তু ওই মুখখানা আগামী অনেকবছর এক নিঃস্বার্থ নৈতিক আন্দোলনের নিশান হয়ে রইল। যে কোনোরকম সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধিতে এই আন্দোলনকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করলে ওই নিশানের সামনে মাথানিচু করতে হবে।

এমন নয় যে আন্দোলন এই একই চেহারায় জ্বলতে থাকবে ছ’মাস কি এক-দু বছর। একটি স্ফূরণ স্তিমিত হবে আবার পরের স্ফূরণের আগ পর্যন্ত। আগুন যখন মশালের মত, দাবানলের মত জ্বলে, তাকে অনেক বেশি করে দেখা যায়। কিন্তু আমরা জানি, এর পেছনে থাকে বহুদিন ধরে জমা হওয়া ক্রোধের বিস্ফার। দুর্বলের ওপর অন্যায় হতে দেখলে, অকারণে অসহায় মানুষকে লাঞ্ছিত হতে দেখলে বিপুল সমবেদনা আর ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া ক্রোধ একদিনে হঠাৎ তৈরি হয় না, হঠাৎ নিভেও যায় না তা। কোনো ছল বা কৌশলের সামনে সে একটুক্ষণ বিভ্রান্ত হতে পারে হয়ত, অথবা কিছু প্রচ্ছন্ন হতে পারে ক্ষমতাশালীর অত্যাচারের নিষ্ঠুরতায়।

কিন্তু দেশের এক অংশের বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে এই দেশজোড়া দেশপ্রেমের সৈনিকরা। তাই আগুন থাকবে, যতক্ষণ তার কারণ অপসারিত না হবে, তা থাকবে। সেইখানেই গভীরতার কাজ। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন যেন তার আশ্রয় পায়, সেই ভূমিকা নেওয়া খুব জরুরি। কেবল আবেগ নয়, জরুরি আবেগের পাশাপাশি সমস্তক্ষণ নিজেদের আরও যত্নে তৈরি করতে থাকা।

অন্যের ওপর অন্যায় করা মানেই হিংসা। এবারে দেশব্যাপী আন্দোলনের একটা বড় বৈশিষ্ট্য- আন্দোলনকারীরা হিংসার পথে যায় নি, যদিও শাসকের দিক থেকে উসকানির কোনো অভাব নেই। রাষ্ট্র চায় লড়াই হোক অস্ত্র নিয়ে। তাহলে তারা পশুশক্তিতে আন্দোলনকারীদের ধ্বংস করে দেবার সুযোগ পাবে। মিছিল জমায়েতে মিশে অন্যের পোষাক পরে উসকানি দিয়ে লোককে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয় নি এমন মোটেও নয়। কিন্তু সে সব পুরোন অস্ত্রে মরচে পড়ে গেছে। উসকানি কাজে লাগল না।

পীড়ন বেড়েছে, যাতে ‘লাঠির জবাব সংবিধান’ বলার মত স্থিরতা ভেঙে পড়ে, কেউ না কেউ হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। কিন্তু নিজেদের শক্তির ওপর এই আশ্চর্য বিশ্বাস আর স্থৈর্য গত দশ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নাগরিক আন্দোলনের এক বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখা দিয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ ইউরোপের নানা দেশের সঙ্গে অধিকার আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মানচিত্রে যুক্ত হল আমারও দেশের নতুন ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’।

এই আন্দোলনের পৃষ্ঠভূমিকে রক্ষা করা, এর শক্তির যোগান বাড়ানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। সর্বতোভাবে দুর্নীতির বিরোধিতা করা, বড় জনসভায় দাঁড়িয়ে ফাঁকাকথা বলার চেয়ে প্রত্যেকে নিজের পরিচিত মানুষদের সংগে ক্রমাগত ধৈর্য ধরে কথা বলে চলা প্রচারিত মিথ্যার বিপক্ষে, নিজেকে মুক্ত করা সংকীর্ণতার থেকে- এর প্রতিটাই আগামী দিনে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখা ও বাড়িয়ে তোলার প্রধান অস্ত্র। এর মধ্যে ঔজ্জ্বল্য অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু কঠিন কাজ করার আনন্দ অনেক, বিশেষত সে কাজ যখন অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জরুরি।

প্রিয়জনদের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে মানবশৃঙ্খল গড়ে রাখার মতই জরুরি। আমরা নিজেরাই তো হয়ে উঠব সেই মানবশৃঙ্খল।

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Opinion news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Resistance of students india waking up new way