স্বাস্থ্য মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত, তবু "স্বাস্থ্য" নিয়ে কথা বলা কেন কঠিন? কারণ সম্ভবত দুটো। প্রথমত স্বাস্থ্যকে আমরা খুব সহজলভ্য (taken for granted) মনে করি, ফলে দায়ে না পড়লে সে বিষয়ে ভাবতে চাই না। দ্বিতীয়ত "স্বাস্থ্য" বিষয়টি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট, ফলে আলোচনার ক্ষেত্রটি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত নয়। সাধারণত স্বাস্থ্য বিষয়ক যে বইপত্র বা সাময়িক পত্রগুলো জনপ্রিয় এবং বহুপঠিত, সেগুলোতে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা বিষয়ক রচনা, কিছু ঘরোয়া টোটকা বা বিকল্প ভেষজ চিকিৎসা, কিছু হাসপাতাল ও চিকিৎসকের ফোন নম্বর ইত্যাদি থাকে। এইসব পত্রিকা ও বই স্বাস্থ্য সম্বন্ধে মানুষের একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার প্রতিফলন। আমরা স্বাস্থ্য বলতে বেশিরভাগ সময় রোগের চিকিৎসাটুকুই বুঝি। রোগ সেরে গেলেই স্বাস্থ্য সম্বন্ধে অচেতন হয়ে নিদ্রা যাওয়া আমাদের সংস্কৃতি। স্বভাবতই আমরা সেসব বই বা পত্রিকা পড়তে চাই, যেখানে এরকম বিষয়ে পাঁচ মিনিটে পড়ে ফেলার মতো কিছু তথ্য বা নির্দেশ থাকবে। এরকম রচনার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। গত দুই দশকে এই জাতীয় পত্রিকা নিয়মিত পড়ে সাধারণ মানুষের অনেকেই বিভিন্ন রোগ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে বেশ কিছু কথা জেনেছেন। তাঁরা সেইসব বিষয়ে এখন অনেক তথ্যনির্ভর আলোচনা করতে পারেন, চিকিৎসককে প্রশ্ন করতে পারেন এবং আত্মীয়-বন্ধুদের পরামর্শ দিতে পারেন। এটা উল্লেখযোগ্য উন্নতি নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই পথে আলোচনা করা এই কলামের উদ্দেশ্য নয় (অন্তত প্রধান উদ্দেশ্য নয়)। তার একটা কারণ এই যে বিভিন্ন রোগ সম্বন্ধে বিপুল পরিমাণ তথ্য এখন অন্তর্জালে সহজেই পাওয়া যায়। দ্বিতীয় কারণটি দার্শনিক ও রাজনৈতিক, যা ক্রমশ স্পষ্ট হবে। যে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে মাননীয়া অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ সমগ্র বাজেট বক্তৃতায় স্বাস্থ্য শব্দটি মাত্র বার তিনেক উচ্চারণ করেন, তার থেকে এই কলামের অবস্থান ভিন্ন।
প্রথমে বলে নেওয়া যাক দুটি অবিশ্বাসের কথা।
১) স্বাস্থ্য মানে শুধুমাত্র রোগের চিকিৎসা, এমন ধারণা সমর্থনযোগ্য নয়।
২) স্বাস্থ্যকে একটি ক্রয়যোগ্য পণ্য নয়। যদিও পুঁজিবাদী অর্থনীতির অমোঘ নিয়মে চিকিৎসা পরিষেবা ক্রয়যোগ্য পণ্য এখন, তবু শুধুমাত্র পয়সা ফেলে স্বাস্থ্য কিনে খেয়ে ফেলা যৌক্তিক কারণেই সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন, অর্থনীতির স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্যের অর্থনীতি
এই দুটো অবিশ্বাস (বা বিপরীত দিক থেকে দেখলে একপ্রকার বিশ্বাস) বুঝতে গেলে প্রথমে দেখতে হবে "স্বাস্থ্য" (Health) বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বোঝে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) স্বাস্থ্যকে বলেছে "a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity." স্বাস্থ্য মানে দেহে, মনে এবং সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকার এক অবস্থা, নিছক ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি নয়। স্বভাবতই রোগমুক্তি সুস্বাস্থ্যের এক শর্ত হলেও সেটুকুই স্বাস্থ্যপূর্ণ জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়। এই যুক্তিতে চিকিৎসা পরিষেবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অংশমাত্র। তার বাইরেও থেকে যায় অনেক কিছু। সুতরাং শুধুমাত্র চিকিৎসা পরিষেবা ক্রয় করে স্বাস্থ্য ক্রয় করা সম্ভব নয়। অতএব বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা কেনার জন্য মেডিক্লেম ইনশিওরেন্সও একটি সামগ্রিক সুস্থতার রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ব্যবস্থার বিকল্প নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এও মনে করে যে সুস্বাস্থ্য একবারে চিরকালের জন্য লাভ করা যায় না। তাকে নিয়মিত যত্নে বজায় রাখতে হয়। সবসময় রোগ থেকে আরোগ্য, আরোগ্য থেকে স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য থেকে সুস্বাস্থ্যের দিকে এগোনোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। এই চেষ্টা থামালেই বিপরীতমুখী প্রাকৃতিক বলেরা স্বাস্থ্যকে অন্ধকারের দিকে টেনে নামাবে। অতএব সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় তথা আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা কখনও থামিয়ে দেওয়া যায় না বা তাতে ঢিলে দেওয়া যায় না। এই ঢিলে দেবার প্রবণতা কিন্তু আমাদের মধ্যে প্রবল, ব্যক্তিগত স্তরে তো বটেই, সরকারি স্তরেও।
ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়ে সরকারি স্তরে ঢিলে দেওয়া কি আমরা মেনে নেব? বেতন বা মহার্ঘ্য ভাতার জন্য সরকারি কর্মচারীদের দাবিদাওয়াকে যেমন "ঘেউঘেউ" বলে চিহ্নিত করা হয় আজকাল, তেমনিভাবে কি স্বাস্থ্যের দাবিকেও দাবিয়ে দেওয়া যায় শাসকের তরফে? সরকার বিনা পয়সায় যেটুকু দিচ্ছে, সেটুকু নিয়েই কি আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়? ভিড় বাসে গুঁতো খেয়ে আপত্তি জানানো মহিলাকে যেমন শুনতে হয়, "অত অসুবিধে হলে ট্যাক্সিতে যান," তেমন ভাষায় কি সরকার বলতে পারেন, "আর কিছু লাগলে কিনে নাও বাপু?" আজকের বাস্তবতায় শাসক এরকম কিছু বলে ফেলতেই পারেন এবং আপত্তি করলে আপনি হয়ত দেশদ্রোহী বা মাওবাদী বলে চিহ্নিত হবেন, কিন্তু নীতিগতভাবে সেকথা বলার অধিকার শাসকের নেই।
কটা কথা স্পষ্ট ভাষায় জানানো যাক। স্বাস্থ্য আপনাকে কেউ ভিক্ষা দিচ্ছে না, স্বাস্থ্য আপনার অধিকার। ১৯৭৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে স্বাস্থ্য সব মানুষের অধিকার। দেশ, জাতি, আর্থসামাজিক অবস্থান বা অন্য কোনো কারণে কেউ যেন সাধারণ সুস্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রগুলি নিজেরা এককভাবে এবং পরস্পর মিলে কাজ করবে। পরের বছর সেপ্টেম্বরে কাজাকাস্তানের আলমা আটা নামক স্থানে আয়োজিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এই নীতিটিকে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত পাকা হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। সকলের জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ২০০০ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে কাউকে অসহায়ভাবে স্বাস্থ্য ভিক্ষা চাইতে হবে না। তার মানে এই নয় যে মানুষ অজর অমর হয়ে যাবে, এর মানে এটুকুই যে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবাটুকু সব মানুষ পাবে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় অসাম্য (মূলত অর্থনৈতিক কারণে) বিশেষভাবে আলোচিত হয় এবং এই অসাম্য দূর করার দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্রগুলি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।
বিগত শতাব্দীতে যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, তখন কমিউনিটি মেডিসিন নামক বিষয়টির ক্লাসে এই ঘোষণাপত্রকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন শিক্ষকেরা যে কমা ফুলস্টপ সমেত মুখস্থ করতে বাধ্য করতেন "Health for all by the year 2000 AD" বিষয়ক ছাপা কথাগুলো। দুঃখের বিষয়, আমরা ২০০০ সাল পার করে আরও ১৯ বছর এগিয়ে এসেছি, কিন্তু লক্ষ্যের ধারেকাছে পৌঁছতে পারিনি।
ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের তালিকায় স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত নয়। এ অতি দুর্ভাগ্যের কথা, কিন্তু সরকারের পক্ষে এটা দায় এড়ানোর একটা সুযোগও বটে। সেই কারণেই হয়ত কিছুতেই ভারত সরকার স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করছে না। এতদসত্ত্বেও ভারত বা তার কোনো রাজ্যের সরকার স্বাস্থ্যের অধিকারকে অস্বীকার করতেও পারে না, কারণ ভারত আলমা আটা ঘোষণাপত্রের অন্যতম স্বাক্ষরকারী। সেই সূত্রে ভারত নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করা উচিত এবং তা রাষ্ট্রের কর্তব্য। একই কারণে ভারত আন্তর্জাতিক স্তরে দায়বদ্ধও বটে।
অতএব আপনিও রাষ্ট্রের কাছে স্বাস্থ্য দাবি করতে পারেন মাথা উঁচু করে। দাবি করতে পারেন রাষ্ট্র পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মানবতার কাছেও।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)