Advertisment

লকডাউনে কেন বাড়িই অনেক মহিলার পক্ষে হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বিপজ্জনক

জাতীয় মহিলা কমিশন জানাচ্ছে, মার্চ মাসের শুরুর সঙ্গে তুলনা করলে লকডাউন চালু হওয়ার পর থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে গার্হস্থ্য হিংসার মাত্রা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
domestic violence coronavirus lockdown

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

'মেয়েরা বাড়িতেই সবচেয়ে নিরাপদ' - এই কথাটা কতটা সত্যি? COVID-19 এর মোকাবিলায় জারি করা লকডাউন নির্দেশিকা বলছে, সকলেই বাড়িতে থাকুন, নিজেরা নিরাপদ থাকুন, অন্যদের নিরাপদ রাখুন। অথচ গার্হস্থ্য হিংসার শিকার যে অসংখ্য মহিলা এবং শিশু, লকডাউনের আবহে তাদের নিরাপত্তা তো নিশ্চিত নয়ই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা।

Advertisment

ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ৪ বলছে, ভারতে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন প্রায় ২৯ শতাংশ বিবাহিত মহিলা এবং মেয়েরা। যেসব মহিলারা লিভ-ইন সম্পর্কে রয়েছেন; বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাসকারী অবিবাহিত, বা আর্থিকভাবে নির্ভরশীল, বা সমকামী, বা মানসিক/শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী, বা সেইসব বিবাহিত মহিলা যাঁদের বাবা-মায়ের বাড়িতে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছে, বা সেইসব বয়স্ক মহিলা যাঁরা সন্তানদের দ্বারা পরিত্যক্ত, তাঁরা কেউই এই পরিসংখ্যানের আওতায় নেই।

২০১৮ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো জানায়, মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনার ৩১.৯ শতাংশের জন্যই দায়ী তাঁদের স্বামী বা স্বামীর আত্মীয়স্বজন, পণের জন্য স্বামী বা স্বামীর আত্মীয়স্বজনদের হাতে নিহত হন ৮,১৯০ জন মহিলা, এবং পণ-সংক্রান্ত সমস্যার জেরে আত্মঘাতী হন ১,৮৫২ জন মহিলা। ভারতে প্রতিদিন গার্হস্থ্য হিংসার কারণে প্রাণ হারান অন্তত ২৮ জন মহিলা, অথচ সমাজ আজও সেই হিংসা উপেক্ষা করে, এবং মহিলাদেরই দোষী ঠাওরায়।

আরও পড়ুন: লকডাউনে গার্হস্থ্য হিংসা! প্রতিবাদে মুখর বলিউড

লকডাউনের পর থেকে দুনিয়া জুড়েই গার্হস্থ্য হিংসার মাত্রা বেড়েছে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ। যেহেতু বাড়িতেই বন্দি নির্যাতনকারী থেকে শুরু করে শিশু সহ পরিবারের সকলেই, সেহেতু বেড়েছে মহিলাদের ওপর গৃহকর্মের তথা সেবাযত্নের বোঝা, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে হিংসার ঝুঁকিও। জাতীয় মহিলা কমিশন জানাচ্ছে, মার্চ মাসের শুরুর সঙ্গে তুলনা করলে লকডাউন চালু হওয়ার পর থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে গার্হস্থ্য হিংসার মাত্রা। এবং এটি হিমশৈলের ডগা মাত্র। তাঁদের নির্যাতনকারী ২৪ ঘণ্টাই বাড়িতে উপস্থিত, এই অবস্থায় সাহায্য চাইতেই পারছেন না অসংখ্য মহিলা। বাস্তব চিত্রটা জানা যাবে লকডাউন ওঠার পরেই।

লকডাউন যখন শুরু হয়, দেশজুড়ে সাহায্য চাওয়ার জন্য হেল্পলাইন নম্বরের খবর জানায় একাধিক মহিলা সংগঠন। প্রথম দু-দিনের মধ্যেই স্বয়মের (নারী-বিরোধী হিংসা প্রতিরোধে কাজ করে কলকাতার এই সংগঠন) কাছে ফোন আসে এক মহিলার। স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়ে প্রাণের আশঙ্কা করছিলেন তিনি। পুলিশ তাঁকে উদ্ধারর করতে সক্ষম হয়। এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয়ও পান তিনি, তবে নিজের পাঁচ বছরের সন্তানকে নিয়ে যেতে পারেন নি।

আরেকজন মহিলা রাতের অন্ধকারে নিজের কন্যাসন্তানকে নিয়ে স্বামীর কাছ থেকে পালাতে বাধ্য হন, এবং যানবাহনের অভাবে পায়ে হেঁটে তাঁর মায়ের বাড়িতে পৌঁছন। হিংসার শিকার আরেকজন মহিলার যাওয়ার কোনও জায়গা নেই আপাতত। কিছু মহিলা এমনও আছেন যাঁদের রেশন কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সুতরাং রেশনটুকুও নেই।

বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকলেই যে সব নিরাপদ, এমনটাও নয় একেবারেই। একাধিক মহিলা ফোন করে জানিয়েছেন যে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যেতে বাধ্য করতে তাঁদের মারধর করছেন মা-বাবাই। যেহেতু তাঁদের খাওয়ানোর সঙ্গতি নেই মা-বাবার। আমাদের কাছে অসংখ্য ফোন এসেছে অল্পবয়সী মেয়েদের, যারা জানিয়েছে যে নিজেদেরই বাবা/ভাইদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছে তারা।

ইংরেজিতে যাকে বলা হয় 'সাপোর্ট সার্ভিস', তার নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে লকডাউনের কারণে। অনেকের কাছেই ফোন নেই যে পুলিশ বা হেল্পলাইনে ফোন করবেন; কারোর কারোর কাছে ফোনের রিচার্জ কেনার টাকা নেই; পালিয়ে যে যাবেন, সেরকম যানবাহন নেই; সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব-বিধির কারণে পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের কাছে সাহায্য চাইতে পারছেন না; এবং প্রোটেকশন অফিসার, আইনি সাহায্য পরিষেবা, বা আদালতের মতো সরকারি সংস্থান আপাতত বন্ধ।

আরও পড়ুন: লকডাউনে বিশ্বের ঘরে ঘরে হিংসা বৃদ্ধি, উদ্বেগ প্রকাশ রাষ্ট্রসংঘ প্রধানের

বেশিরভাগ মহিলার ক্ষেত্রেই সুরক্ষিত আশ্রয় পাওয়াটাই সমস্যার। এমনিতেই শেল্টার হোমের সংখ্যা কম, তার ওপর সংক্রমণের ভয়ে চালু শেল্টার হোমগুলিও নতুন কোনও আবাসিক নিতে চাইছে না। একটা সমাধান হতে পারে যদি নির্যাতনকারীকেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কোনও শেল্টারে, মহিলা এবং শিশুদের স্বস্তিতে বাড়িতে রেখে।

লকডাউনের ফলেই প্রকাশ্যে এসেছে আমাদের সমাজের অবাধ গার্হস্থ্য হিংসার চিত্র। লকডাউন চলাকালীন, এবং তার পরবর্তী সময়েও সরকারের কর্তব্য, মহিলাদের সুরক্ষা এবং সহায়ক পরিষেবা নিশ্চিত করা। এই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের সম্প্রতি চালু হওয়া হেল্পলাইন একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এছাড়াও মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট পুলিশ টাস্ক ফোর্স, এবং হিংসার শিকার যাঁরা, তাঁদের রক্ষার্থে সমস্ত পরিষেবা এবং প্রোটেকশন অফিসারদের জরুরি পরিষেবার আওতায় আনা।

বিভিন্ন এনজিও-র সঙ্গে মিলে মহিলাদের প্রাপ্ত পরিষেবার পরিধি বাড়ানো, এবং মানসিক সহায়তা দিতে হেল্পলাইন চালু করাও অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ পদক্ষেপ প্রয়োজন রূপান্তরকামী মহিলা, পরিযায়ী মহিলা শ্রমিক, প্রতিবন্ধী মহিলা, এবং অন্যান্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপ্রবণ গোষ্ঠীর জন্য। সব শেষে, ঠিক যেভাবে COVID-19 সংক্রান্ত উপদেশাবলী সংবাদ মাধ্যমে অগাধ প্রচার পাচ্ছে, সেভাবেই প্রচার হওয়া উচিত এই সমস্ত হেল্পলাইন এবং সহায়ক পরিষেবারও।

(লেখিকা কলকাতার স্বয়ম সংস্থার ডিরেক্টর, মতামত ব্যক্তিগত)  

Advertisment