অনেক সমতা কি সত্যিই 'সমান' করে? মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায় প্রবেশ সমান অধিকার পেলে কি মেয়েরা সত্যিকারের সমতা পাবেন? সেনাবাহিনী-পুলিশ এসব শাসনের যন্ত্রে সমান সংখ্যায় প্রবেশ করতে পারলেই কি ময়েরা সমতা পাবেন? তারপরেও তো থাকবে বেশিরভাগ মানুষ, নারী ও পুরুষ-- তাঁদের রোজকার বিশ্বাসের সঙ্গে দৈনন্দিন বেঁচে থাকা -- আসলে মেয়েরা নাকি পুরুষের তুলনায় খাটো, তাই মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায় প্রবেশের পরেও 'নারী নরকের দ্বার' বলে চলবে ধর্মগ্রন্থের নিদান, আর সেটাকেই ধ্রুবসত্য ধরে নিয়ে পুরুষদের শাসন আর মেয়েদের সেই শাসন মানার আজন্ম বা আমৃত্যু বিশ্বাস। আর যে রাষ্ট্র আসলে কল্যাণের নামে বুড়ো আঙুল দেখায়, শাসনের নামে টিকিয়ে রাখে নানা বিভাজনের দেওয়াল, সেই বিভাজনকে জিইয়ে রাখার শাসনযন্ত্রের সমান শরিক হয়ে কি মেয়েরা আসলে সমতা পাবেন? নাকি তা হবে সমান অত্যাচারী হয়ে ওঠার ছাড়পত্রের সমতা? আপাতত ধর্মস্থানে মেয়েদের প্রবেশের অধিকার নিয়ে সত্যিই এতো মাতামাতি করার কিছু আছে কিনা, নাকি তা আসলে শৃঙ্খলের সমতা, ধর্ম নামের আফিঙে বুঁদ হয়ে থাকার সমতা, সেই প্রশ্নটাই একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।
মেয়েরা বম্বে উচ্চ ন্যায়ালয়ের আদেশে আমেদনগরের শনি সিংনাপুর মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পেয়েছেন, ওদিকে সবোর্চ্চ ন্যায়ালয় শবরীমালার আয়াপ্পার মন্দিরে কেন সব মেয়েরা প্রবেশের অধিকার পাবেন না, সেই ব্যবস্থা তো দেশের সংবিধানের পরিপন্থী-- এই প্রশ্ন তুলে শবরীমালা মন্দির পরিচালন সমিতিকে কারণ দর্শাতে নির্দেশ দিয়েছে। মেয়েদের প্রবেশের অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তি যে তা আয়াপ্পার ব্রহ্মচর্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। কেরলের শবরীমালা মন্দরে সম্ভাব্য ঋতুমতী মেয়েরা প্রবেশ করতে পারেননা-- তাই ১০ থেকে ৫০-এর মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। ঋতু নিয়ে এই সংস্কার--এই সময়ে মন্দিরে তো দূরস্থান, বাড়ির ঠাকুরঘরে ঢোকা যাবেনা এটা মেয়েদের মধ্যেও স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়। মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই, কারুর চারশো তো কারুর তারও বেশি সময় ধরে এটাই 'চলে' আসছে।
তখন মনে হয়, আমাদের সংস্কৃতে তো স্ত্রীর একটি প্রতিশব্দ সহধর্মিণী, অর্থাৎ স্বামীর সঙ্গে সমানভাবে ধর্মাচরণের অধিকারী, তাহলে তো যে ঐতিহ্যকে সাক্ষী মানা হচ্ছে, সেখানে মেয়েদের ধর্মের সমান অধিকার ছিলো, এইসব নিষেধাজ্ঞা কবে জারি হলো? মুম্বইয়ের বিখ্যাত হাজি আলি দরগার গর্ভগৃহে যেখানে পীর হাজি আলি শাহ বুখারির মৃতদেহ শায়িত হয়েছে, সেখানে মেয়েদের যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বম্বে উচ্চ ন্যায়ালয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন ভারতীয় মুসলিম নারী আন্দোলনের (বি এম এম এ) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নুরজাহান নিয়াজ। হাজি আলির কবর পর্যন্ত মেয়েরা যেতে পারবেননা, যা নুরজাহান নিজে গিয়েছেন বলে স্পষ্ট মনে করতে পারেন। আর ১৪৩০ সাল নাগাদ এই হাজি আলি দরগা তৈরির পর গত ২০১২ সালের নভেম্বর অবধি মেয়েদের প্রবেশের অধিকার ছিলো। এখনো দরগা-সংলগ্ন মসজিদে মেয়েরা প্রার্থনা করতে পারেন, শুধু দরগার তরফ থেকে বলা হয়েছে মেয়েদের 'সুরক্ষার জন্যেই' প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা-- মেয়েরা যদি হঠাৎ ঋতুমতী হয়ে পড়েন, অস্বস্তিতে পড়তে পারেন, ঝুঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পরনের পোষাক বেসামাল হয়ে গেলে লোভী পুরুষদের নজরে পড়তে পারে ইত্যাদি। ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে মেয়েরা হাজি আলি দরগায় প্রবেশ ও প্রার্থনা করতে পারবেন। তবে মেয়েদের প্রবেশ পথ পৃথক হবে কিনা, মেয়েদের প্রবেশের জন্য কোনো পৃথক পরিকাঠামো প্রয়োজন হবে কিনা, সেসব বিচার করে হাজি আলি ট্রাস্টকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টকে জানাতে হবে। অবশেষে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাস থেকে মেয়েরা হাজি আলি দরগায় প্রবেশ করছেন।
শবরীমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্য মেয়েদের প্রবেশ এখনও বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টের তিন-বিচারপতির বেঞ্চ ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে বিষয়টি পাঁচ-বিচারপতির বেঞ্চে পাঠিয়েছে। শবরীমালা মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ড যদিও সংবাদমাধ্যমে বলেছে তারা ঋতুযোগ্য মেয়েদের প্রবেশ করতে দিয়ে শবরীমালাকে 'থাইল্যান্ড বানাতে চায় না', আর কেরালার বামপন্থী সরকার বলেছে তারা মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে, কিন্তু রায় এখনও আসেনি। বরং সুপ্রিম কোর্ট মামলাকারী ইন্ডিয়ান ইয়াং লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন, মন্দির বোর্ড, কেরালা সরকার-- সবাইকে পাঁচটি প্রশ্নমালা ধরিয়ে তার উত্তর দিতে বলেছে। প্রশ্নগুলির কয়েকটি এরকম--একটি লিঙ্গের জৈবিক একটি দিকের দিকের উপর ভিত্তি করে এই নিষেধাজ্ঞা কি 'বৈষম্য' এবং তা কি ধরা ১৪, ১৫, ও ১৭-র মূল ভাবনার বিরোধী? ঋতুমতী নারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা কি ২৫ ধারা অনুযায়ী একটি 'আবশ্যক ধর্মীয় আচার'? কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধর্মাচরণের স্বাধীনতার খাতিরে কি এধরণের দাবি তুলতে পারে? এটিকে সুপ্রিম কোর্ট একটি বৈষম্য হিসাবেই দেখছে বলে তা শুনানির খবর থেকে মনে হচ্ছে। দেখা যাক পাঁচ-বিচারপতির বেঞ্চ কবে এ নিয়ে রায় দিতে পারে।
মেয়েদের ধর্মস্থানে প্রবেশ নিয়ে বিধিনিষেধের ব্যাপারটা অনেকদিনের। সব ধর্মেই ব্যাধিটি রয়েছে। এই ব্যাধিটির নিরাময়ে মেয়েদের লড়াইও অনেকদিনের। সমান ধর্মাচরণের অধিকার নিয়ে বিতর্ক যে শুধু হিন্দু ধর্মেই আছে তা তো নয়। মক্কা-মদিনায় মেয়েরা মসজিদে প্রার্থনা করতে পারলেও মেয়েরা কাজি কিংবা ইমাম হলে গেলো-গেলো রব ওঠে। তাছাড়া এখানে একসঙ্গে প্রার্থনার অধিকারও নেই, আমরা কলকাতার রেড রোডে যে বিরাট নমাজের ছবি দেখে বড় হয়েছি তাতে মেয়েদের কোনো ছবি আজও নেই। খৃষ্টানদের মধ্যেও রোমান ক্যাথলিক বা একটু গোঁড়া ধারাগুলি মেয়েদের সন্ন্যাসিনী হয়ে ওঠা স্বীকার করলেও ধর্মের প্রবক্তা-- প্রিস্ট থেকে বিশপ হয়ে উঠতে দিতে অনেক সময় নিয়েছে। শুধু মেয়ে নয়, পশ্চিমি দেশে কালো মানুষ ধর্মাচরণের দিক থেকে বহু বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আমাদের দেশেও শুধু মেয়েরাই নন, নিচু জাতের মানুষ বহু মন্দিরে প্রবেশের অধিকার এখনও পাননাস ব্রাক্ষ্মণরা তাঁদের পুজো করেন না, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় উঁচু জাত আর নিচু জাতের মানুষের গির্জা আলাদা।
ধর্ম আফিং না নিপীড়িতের শেষ আশ্রয়? দুশো বছর আগে একডন বলেছিলেন দুটোই। অবস্থা বিচারে এক এক রূপ ধর্মের। কিন্তু প্রশ্ন যখন হয় যে একটি বিশেষ সময়ে ধর্মের কোন রূপটি প্রধান, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয় বৈকি। ধর্মের ভিতরে ঢুকে সেই আশ্রয়কে নিজেদের মত গড়ে নেওয়া না কি এই আফিংকে সুযোগ মতন দূরে ঠেলা? মেয়েরা কি ধর্মের ভিতরে নিজেদের অবস্থানকে আরও সংগঠিত করবেন নাকি ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবেন তার দমবন্ধকরা দেবালয় থেকে মুক্ত আকাশের ধর্ম চর্চায়।
আরও পড়ুন, মাতৃত্ব, অবসাদ ও অপরাধবোধে
সমান ধর্মাচরণের অধিকার অবশ্যই সমান অধিকারের দিকে, সমান স্বীকৃতির দিকে এগোনোর জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দাবি। কিন্তু ধর্মাচরণের সমানাধিকার আমাদের বাস্তবে কতদূর সমান করতে পারে? দেশে-বিদেশে বহু প্রয়াস হয়েছে, হচ্ছে ধর্মকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার। সেই প্রয়াসকে শ্রদ্ধা জানিয়েও প্রশ্ন ওঠে যা নিজে অসাম্যের ভিত্তি, তা দিয়ে কি আদৌ কখনো অসাম্যকে নিরসন করা যায়? আমরা কি কোনওদিন প্রভুর হাতিয়ার দিয়ে প্রভুর প্রাসাদ চূর্ণ করতে পারি? তা কি আদৌ সম্ভব? বিশেষত মেয়েরা সারা পৃথিবীতেই ধর্মে অনেক বেশি মতি রাখেন, কারণ মেয়েদের পৃথিবী এখনো অনেক বেশি ঘরের চারদেওয়ালে আঁকড়ে, অর্থ-ক্ষমতা সবকিছুর নিরিখেই পরিবারের পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশী অনিশ্চিত একটি পরিমন্ডলে বাস করেন, ধর্ম হয়ে ওঠে অনেকের সমচেয়ে বড়ো আশ্রয়। তাই অনেক মেয়ের কাছেই ধর্মাচরণের সমান অধিকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁদেরকে আমরা তো অন্য কথা ভাবতে বলতে পারি। যদি আমরা মনে করি ধর্ম বিষয়টার জন্মই হয়েছে সমাজের চলতি অসাম্য আর বিভেদের ভিত্তিকে সহনীয় করে তোলার জন্যই, যা বলে মেয়েদের স্বর্গ স্বামীর পায়ের তলায় বা যা আমাদের একলব্যের গল্প এমনভাবে গ্রহণ করতে শেখায় যাতে আমরা মনে করতে পারি যে একটি ব্যাধ ছেলে য়ে নিশ্চয়ই অর্জুনকে ছাপিয়ে যেতে পারেনা তাই দ্রোণাচার্য তার ডানহাতের বুড়ো আঙুল গুরুদক্ষিণা হিসাবে চাইলে কোনো অন্যায় নেই, অথবা মিশ্রবিবাহে সন্তান শূদ্র হবে-- এই সব শিখে জাতপাত, নারীপুরুষভেদ এরকম সব বৈষম্যকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করতে শেখায়। একরম অনেক পিছিয়ে পডা চিন্তার আধার ধর্মগুলির মধ্যে লডাইয়ে নিজেদের ব্যস্ত না রেখে, আমরা নিজেরাই আমাদের পছন্দের স্থানে ইশ্বরকে বসাই। মন্দির-মসজিদে প্রবেশে সামানাধিকারের দন্য সময় আর শ্রম ব্যয় না করে বরং পূজ্য ইশ্বরকে পবিত্রতার সেই কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বলি বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো? সেই মুক্ত জগত হোক আমাদের দেবালয়।