শব্দব্রহ্ম বলে একটা কথা চালু আছে। আমার ধারণা যে কোনও শব্দ উচ্চারিত হল, তা আমাদের কিছু একটা দেখতে বাধ্য করে। ছোটবেলায় কথাটা এরকম ভাবে বুঝতাম না। কিন্তু যখনই কেউ বলত মেঘ, তখন মেঘ দেখতে পেতাম, মেঘের দিকে না তাকিয়েই দেখতে পেতাম, মেঘ না থাকলেও দেখতে পেতাম। বৃষ্টি বললে আসলে ফোঁটাগুলোই দেখতে পাই। যখনই নারী বলেছে কেউ, বা কেউ বলেছে ফুল, অথবা উচ্চারণ করেছে আগুন, আমরা সেটা কিন্তু দেখেছি। একটা দেখা, একটা ধ্বনি। তেমনটাই হয়ে আসছে, তেমনটাই হয়। তাই শম্ভু মিত্র বলতেই আমি সৌম্যদর্শন একজন মানুষের চেহারা দেখতে পাই। যিনি আমার কাছে আদতে একটি থিয়েটারের প্রতিশব্দ। নাট্যের প্রতিশব্দ। এ বোধ একদিনে তৈরি হয়নি, একটু একটু করে গড়ে উঠেছে।
আমি যে বাড়িতে বড় হয়েছি, সে বাড়িতে অভিনয়ের চর্চা ছিল - আমার বাবা ছিলেন পেশাদার যাত্রাভিনেতা, ৩৫ বছর উনি যাত্রা করেছেন। আমি যে জামাকাপড় পরেছি, খাওয়া দাওয়া করেছি, সেসবই অভিনয় থেকে উপার্জিত পয়সার মাধ্যমেই করেছি। অতএব অভিনয়ের সঙ্গে ছোট থেকেই আমাদের একটা জড়ানো ব্যাপার ছিল। অথচ সেটা যাত্রা বলেই, খুব ছোট থেকে আমরা থিয়েটার দেখার সুযোগ সবসময়ে পেয়ে উঠিনি। বাবার সঙ্গে গিয়ে মাঠের যাত্রা দেখেছি, ফলে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমার যে স্মৃতি- সেখানে অভিনয় বলতে আমি খোলা মঞ্চ, অসম্ভব শক্তিমান সব অভিনেতাদের দেখেছিলাম। তাঁরা একদিকে মঞ্চের উপর মায়া তৈরি করছেন, তার একটা নির্দিষ্ট সুর থাকছে এবং সেই সুর আমাকে মুগ্ধ করছে। এবং এসবই আমি দেখছি প্রায় হাত ছোঁয়া দূরত্ব থেকে। আমার কাছে তখন সেটাই ছিল অভিনয়। যাত্রা বলতে আমি তখন নাটকই বুঝতাম।
আরও পড়ুন, গিরিশ মৃত্যুহীন রয়ে যাবে
কিন্তু পরে যখন রেডিওতে নাটক শুনছি, সে সময়ে একদিন হঠাৎই একজনের কণ্ঠস্বর শুনলুম। তাঁর নাম শম্ভু মিত্র। ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, এঁর নাম শম্ভু মিত্র, ইনি একজন নাম করা নাট্যাভিনেতা এবং পরিচালক। আমি বললাম, রেডিওতে অন্য যাঁরা নাটক করেন, এঁর গলাটা তাঁদের থেকে আলাদা। তখনই আমি জানলাম- ইনি রেডিও নাটকের মানুষ নন, মঞ্চের মানুষ।
রেডিওয় ওই গলাটা শুনে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাব তৈরি হয়েছিল। এরপর আমি ক্লাস এইটের পর থেকে নিয়মিত নাটক দেখবার পয়সা এবং সাহস ও সুযোগ সবটাই যখন হচ্ছে, তখন পৌঁছে যেতে শুরু করলাম অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে কী অন্যান্য হলে। কিন্তু সেখানে তখন শম্ভু মিত্র আর অভিনয় করছেন না। জানতে পারলাম, উনি অভিমান করে এখন আর অভিনয় করেন না। তার কারণ ছিল ওঁর প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত হল উনি পাচ্ছিলেন না। এসব যখন জানছি, তখনই জেনে ফেলছি বহুরূপী কী, বহরূপীতে কী কী প্রযোজনা হয়েছে, সেসব প্রযোজনায় উনি কেমন করে কাজ করেছেন। এসব করতে করতেই আমি দেখছি রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তকে, উৎপল দত্তকে, বিভাস চক্রবর্তীকে- আর এসব করতে করতেই আমি মেলাবার চেষ্টা করছি, ভাববরা চেষ্টা করছি এ লোকটা আসলে কেমন! কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি না। শুধু শুনতে পাচ্ছি। চাঁদ বণিকের পালার পাঠ শুনতে চলে যাচ্ছি, অয়দিপাউসের খানিক অংশ শুনতে পাচ্ছি, ডাকঘরের কিছু অংশ শুনতে পাচ্ছি- সেসব থেকে লোকটা সম্পর্কে, তার অভিনয় সম্পর্কে ধারণা তৈরি হচ্ছে।
আরও পড়ুন, রবীন্দ্রনাথের নাটক ও সমসময়
সে সময়ে দাঁড়িয়ে সেই ধারণাটা কিন্তু ঈশ্বরের মত। এ কারণে উপমাটা দিচ্ছি, আমি ঈশ্বরকে যেমন দেখতে পাই না, কিন্তু ভক্তি শ্রদ্ধা করি, জানি যে তিনি অসীম ক্ষমতাধর। কিন্তু যাঁদের দেখতে পাই, তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। কিন্তু আমার যেহেতু শম্ভু মিত্রকে দেখার সুযোগ হচ্ছে না, ফলে আমার ওইরকম একটা কথা মনে হচ্ছিল।
এর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ওই নবান্ন এবং গণনাট্য এবং আইপিটিএ ও সে সময়ের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মানুষজনের ভূমিকা জানতে জানতে মনে হচ্ছে উনি একজন ব্যাতিক্রমী মানুষ, যিনি নিচু গলায় একটা সজোর প্রতিবাদ করছেন। প্রতিবাদ করার জন্য উনি গলা তুলছেন না। আমি যে সময়ে তখন, সে সময় আমার গলা তোলার বয়স। স্কুল থেকে বেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি, ছাত্র রাজনীতি শুরু করেছি। আমার মনে হচ্ছে যে এই ভঙ্গিমাটা আমার ভঙ্গিমা নয়, আমি এটা পছন্দ করি না, কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করতে পারছি না। যখন পড়ছি, উনি কেন আইপিটিএ থেকে বেরিয়ে গেলেন, কেন বহুরূপী নামের একটি সংগঠন করলেন, কেন বলছেন ভাল নাটক ভালভাবে করব বলেই একটি সংগঠন। উনি বলছেন কোনও রাজনৈতিক দলের ফতোয়ার নিচে থেকে নাটক করা যায় না। এ কথাগুলো যখন শুনছি, তখন কিন্তু আমি রাজনৈতিক দলের সদস্য, তা সত্ত্বেও এ কথাগুলো আমি মেনে ফেলছি। মানব না, মানব না করেও মেনে ফেলছি। একটা দোলাচল তৈরি হচ্ছে। আর যেখানে দোলাচল তৈরি হয়, যেখানে রোমাঞ্চ তৈরি হয়, সেখানে প্রেমটা জমে। আমিও বুঝতে পারছিলাম প্রেমটা জমছে।
এরপর কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি যখন নান্দীকারের নাট্যচর্চায় নিয়মিত হলাম, তখন ওঁর যে বই, ওঁর যে নিজস্ব লেখা, এসবের মধ্যে আরও ঢুকতে শুরু করলাম। এবং বুঝতে শুরু করলাম একটা সময়ের সংস্কৃতিকে পাল্টে দেওয়ার এবং তাকে নতুন করে তৈরি করার মত একজন পুরোহিত বোধহয় তৈরি ছিলেন। ইতিহাসে আমি তার প্রমাণ পেয়ে যাচ্ছি তখন।
আরও পড়ুন, থিয়েটারে মুক্তধারা…রবীন্দ্র ঠাকুর!
আমি নিজে কতকগুলো কাকতালীয়ের চাপে, অকস্মাতের ধাক্কায় থিয়েটারে এসেছি। উনি তেমনভাবে থিয়েটারে এসে পড়লেও, সচেতনভাবে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। যেটা আমাদের ক্ষুদ্র পরিসরে আমরাও করেছি। কিন্তু ওঁর ক্ষেত্রে যেটা ছিল নির্মাণের ক্ষেত্রে একেবারে সময়ের থেকে আলাদা হয়ে, নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী নিজের রুটিন তৈরি করবার যে প্রয়াস, সেটা আমাকে ভীষণ ধাক্কা দিচ্ছিল। এই ব্যাপারটায় ওঁর সঙ্গে আমার বিরোধ ও সমর্থন- দুইই থেকে যাচ্ছে, যেমনটা ওঁর ক্ষেত্রে আমার বরাবরই থেকে গেছে। এরকমভাবেই জেনে ফেললাম ওটা একটা সাধকের জীবন। একজন প্রায় তদ্গত পূজারীর জীবন। নিজের বিশ্বাসে শম্ভু মিত্র এতই সংলগ্ন যে সেটা নড়ে যাবার নয়। সে জায়গা থেকে উনি যখন পরপর বহুরূপীতে প্রয়োজনীয় নাটক তৈরি করছে, তখন আমার সামনে একটা পথ তৈরি হচ্ছে। যে পথটায় আমি চাইলে হাঁটতে পারি। এবং এই আমাদের নাগরিক থিয়েটারের যে ধরনটা, যেখানে আমিও পথ চলছি, এ পথ কিন্তু ওঁর জঙ্গল কেটে বানানো পথ। এ জমি উনিই উর্বর করেছেন। দ্বিতীয়ত শম্ভু মিত্রর থেকে আমি যেটা করতে পেরেছি, অভিনয়ের সঙ্গে সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকা যায় কিনা, সে পথটা ধরবার চেষ্টা করেছি। তাতে কেউ আমাকে ওঁর উত্তরসূরী হিসেবে বলতে পারেন। কিন্তু ওঁর যে চলন, সেটা আমার নয়। উনি যেমন একমাত্র একটি সংগঠনে থেকে নানাবিধ কাজ করেছেন, কখনও কখনও সংযুক্ত কাজ করেছেন, আমি তেমন নই। আমি বহু সংগঠনে কাজ করেছি, করি। আমি তো আজকের ভাষায় বললে ভাড়াটে কেষ্ট। আমার বোধ হয় যে আজকের সময় আমাকে এটা করতে বাধ্য করেছে, এবং এটা এ সময়ের চাহিদাও বটে। নাহলে আমি হয়ত একজিস্টও করতে পারতাম না। বা একজিস্ট শব্দটা ঠিক নয়, বলা চলে, আমি নিজেকে প্রকাশের এতগুলো জায়গা তৈরি করতে পারতাম না। সেটা ভুল হতে পারে, ইতিহাস তার বিচার করবে। কিন্তু আমার নিজের কাছে এতগুলো রাস্তায় হাঁটা আমার কাছে স্বাস্থ্যকরই হয়েছে। যেমন করে উনি ভেবেছিলেন আলাদা কিছু করতে হবে, তেমন করেই আমি এই সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে, এই সময়ের মধ্যে থেকে আলাদা কিছু করতে চেয়েছি। ঘটনাটা যে খুব সচেতন ভাবে ঘটেছে, তাও নয়, ঘটনাটা ঘটে গেছে। ফলত নিরন্তর অভিনয়ের চর্চার মধ্যে থাকা, সে অভিনয়গুলি করা, তার মান নিয়ে অনেকের নানাবিধ মত থাকতে পারে কিন্তু অভিনয়ের মধ্যে থাকা, তা নিয় চর্চা করে চলা, তার মধ্যে যে শ্রম-মেধা ইত্যাদি থাকে সেটা কিন্তু সর্বদা সুলভ নয়, সকলের সাধ্যও নয়।
আরও পড়ুন, ভোটের নাটক, নাটকের ভোট
আমি নিজে ওঁর করা নাটকের মধ্যে অয়দিপাউস করেছি, চার অধ্যায় করেছি, এখন পুতুলখেলা করছি। কিন্তু আমার টেক্সটগুলো আলাদা। অয়দিপাউস, উনি যে টেক্সট করেছেন, আমি সে টেক্সট করিনি, চার অধ্যায় বা পুতুলখেলা, যেটার নাম হয়ে গেছে খেলাঘর, সেটা একেবারে অন্য। ফলে ওই টেক্সটগুলোর কাছে কিন্তু আমি অনেকবার ফিরে যেতে পারছি, ফিরে যাচ্ছি। ওঁর কথাটা মাথায় থাকছে, কিন্তু ওঁর সময় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে একই গল্পের কাছে যাচ্ছি। সেটা কেমন হচ্ছে! এটা আমার কাছে একটা আবিষ্কারের বিষয় হয়ে উঠছে। সে দিক থেকে দেখলে শম্ভু মিত্র এক অর্থে আড়ালে থেকে আমাকে ফুয়েল দিচ্ছেন।
হয়ত সেটাই আমার মোটিভেশন, যে একজন প্রণম্য মানুষ, আমার ঈশ্বরস্বরূপ, তিনি এই অভিনয়গুলো করেছেন।