সন্ধ্যা মালো!
দেশজোড়া সিএএ-এনআরসি বা এই জাতীয় অন্যান্য গুরুতর বিষয়, ঘটনা বা বিতর্ক এক লহমায় দূরে সরিয়ে গত কয়েকদিন ধরে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে এই নাম। নিজের দু'মাসের শিশুকন্যাকে গলা টিপে হত্যা করে তার মৃতদেহ ম্যানহোলে লুকিয়ে রাখেন সন্ধ্যা। পুলিশের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চিত্রনাট্যও নিপুণভাবে সাজানোর চেষ্টা করেন তিনি। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। পুলিশের জেরায় ধরা পড়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন সন্ধ্যা। আবার নিজেই ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে শিশুটির মৃতদেহ বের করে এনেছেন পুলিশ, বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশীদের সামনে। এমন একটি ঘটনা, যা একাধারে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক, সমাজে আলোড়ন তো সৃষ্টি করবেই।
এই ঘটনাটির কিছু আগেই ঘটে যাওয়া আর একটি খবর, সমান গুরুত্বের না হলেও, আমাদের ভাবায়। প্রেমিক অজয় আম্বাউনিকে দিয়ে স্বামী অধ্যাপক অরূপকুমার চট্টরাজকে খুন করায় স্ত্রী পাপড়ি চট্টরাজ। পাপড়ি একজন স্কুল শিক্ষিকা। অজয় ও পাপড়ির একটি দশ বছরের মেয়েও আছে। অজয় পাপড়ির কলেজজীবনের প্রেমিক। সে সময় প্রেম পরিণতি পায়নি। পরে গৃহশিক্ষক অরূপবাবুর সঙ্গে পাপড়ির প্রেম ও বিয়ে। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, গত কয়েক বছর যাবৎ অরূপ-পাপড়ির সম্পর্ক ভালো চলছিল না। আড়াই বছর আগে ফেসবুকে অজয়ের সঙ্গে পাপড়ির আবার দেখা ও নতুন করে প্রেম। তারপরই এই খুনের পরিকল্পনা।
আরও পড়ুন: সমবেদনা না থাক, চক্ষুলজ্জাও কি নেই?
প্রেমিকের তত্ত্ব উঠে এসেছে সন্ধ্যার সন্তান হত্যা প্রসঙ্গেও। তার প্রেমিক এই খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা, সেটা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। কিন্তু সন্ধ্যার জীবনযাপনের সঙ্গে এই প্রেমিকের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। তাদের নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ ছিল। কথাবার্তা হতো ফেসবুকেও। জানা গিয়েছে, সন্ধ্যা তার কন্যাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ১৫ দিন ধরে। এবং পুরো কাজটি সমাপ্ত করে মাত্র ১৫ মিনিটে। আগে থেকেই লিউকোপ্লাস্ট কিনে আনে ও সেটা মেয়ের মুখে লাগিয়ে শ্বাসরোধ করে, যাতে শিশুটির আর্তনাদ কেউ শুনতে না পায়। বোঝাই যাচ্ছে, নিজের কৃতকর্ম বিষয়ে একশোভাগ নিঃসন্দেহ হয়েই পরিকল্পনা রূপায়ণে নামে এই আপাতনিরীহ গৃহবধূ। এক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষ্যনীয় দিক হলো, সন্ধ্যার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিশ্বাস করতে চাইছেন না, সন্ধ্যা একাজ করতে পারে। অন্যদিকে প্রতিবেশীরাও খুব অবাক। একজন বিস্ময়াহত প্রতিবেশী সংবাদমাধ্যমকে বলছিলেন দেখলাম, "এমনটা তো সিনেমায় হয় জানতাম। বাস্তবে ভাবতেই পারছি না।"
ওই প্রতিবেশী কিন্তু অজান্তেই এক সত্যের মুখোমুখি নিজেও দাঁড়িয়েছেন, আমাদেরও দাঁড় করিয়েছেন। আমাদের জীবন সম্পর্কে যা ধারণা, জীবন তার চেয়ে অনেক বেশি রহস্য ও রোমাঞ্চে নাটকীয়। সিনেমার চিত্রনাট্য সেখানে থই পাবে না। মানুষের মন শুধুই সাদা বা কালো নয়, সেখানে অনেকটা অংশ ধূসর আস্তরণে ঢাকা। সুযোগ পেলেই এই ধূসরতা রোগজীবাণুর মতো ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার প্রথম সন্তান ছেলে। ছেলের জন্মের পর নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় উচ্ছ্বসিত হয় সন্ধ্যা। তাহলে পরে কী ঘটল, যে এমন নারকীয় এক কাণ্ডে জড়িয়ে পড়ল সে? পুত্র ও কন্যাসন্তানের মধ্যে পার্থক্য রচনা?
জানা গেছে, পুত্র-কন্যার বিষয় নয়, সন্ধ্যা দ্বিতীয়বার মা হওয়ার ক্ষেত্রেই রাজি ছিল না। পরিবারের চাপে তাকে নতি স্বীকার করতে হয়। আর এখান থেকেই বোধহয় ওই ধূসর ছায়াটা পক্ষ বিস্তার করতে শুরু করে। এই যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু মেনে নেওয়া, এই যে একটা মানিয়ে চলার মধ্যপন্থার জীবন, এই সবই মনের ভিতরে একটা অন্ধ ও চোরা গলিপথ খুলে দেয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেই গলিতে চলতে শুরু করে। সেই গলি একদিন 'ডেড-এন্ড'-এ পৌঁছবে জেনেও ফিরতে পারা যায় না। অধরা সুখের বিকল্প রাস্তা খোঁজে মানুষ। আর এভাবেই কোনও এক সময় তথাকথিত 'অবৈধ' সম্পর্ক দানা বাঁধে সমাজ অনুশাসিত বৈধ জীবনযাপনে।
আরও পড়ুন: ‘ভাইরাল’ ভাইরাসে আক্রান্ত সমাজ, ঠিক ভুল একাকার
প্রথমটি কলকাতা। দ্বিতীয়টি পুরুলিয়া। দুটি ক্ষেত্রেই চলমান যাপনে বিশ্বাস হারানো দুই নারী। দুজনের অপরাধের অভিমুখ ভিন্ন। কিন্তু দুজনেই চরম পন্থা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাহীন, নিঃসংশয়। ঘটনা পরম্পরা সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে প্রায় সকলেরই জানা। সে বিষয়ে বিস্তারে যাওয়া নিষ্প্রয়োজন। এটুকু চোখ বন্ধ করে বলা যায়, দুক্ষেত্রেই অপরাধ অত্যন্ত গুরুতর। আইনগত ও সামাজিক, দুভাবেই। প্রশাসনিক স্তরে যা যা করার করছে পুলিশ। এরপর আদালতের বিচার। বিচারের পর শাস্তি। কিন্তু সেখানেই কি শেষ হয়ে যাবে সব?
যে দুটি মানুষ অপরাধ করল, তাদের চারপাশের কয়েকটি পরিবার ও একাধিক মানুষের জীবনও তো বিপর্যস্ত হয়ে গেল। সন্ধ্যার ছেলে বা পাপড়ির মেয়ে, তাদের জন্য যে ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, সেখানেও তো কত প্রশ্ন, অবিশ্বাস, অসহায় যন্ত্রণা। মায়ের অপরাধের বোঝার ভার তারাও কি বহন করবে না? এইদিক থেকে দেখলে এই দুই নারী বা তাদের মতো যারা এমন ধরনের ঘটনা ঘটায়, তাদের তীব্র দোষারোপ করাটাই স্বাভাবিক মনে হতে পারে। আমরা সেটাই করি।
কিন্তু তাতে কি এই জাতীয় ঘটনা বন্ধ হয়? নিন্দা দোষারোপ, বিচার, শাস্তি - অপরাধ বন্ধ করতে পারে না। এই মহামারী বন্ধ করতে হলে প্রথমেই ওই চিরাচরিত, গতানুগতিক ও রক্ষণশীল চিন্তার অর্গলটা ভাঙতে হবে। এই কাজটার দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার ও বৃহদর্থে সমাজের সকলকে। সন্ধ্যা বা পাপড়ির চিত্তবৈকল্য রাতারাতি ঘটেনি। তাদের বিরক্তি, অসন্তোষ, আক্ষেপ, ক্ষোভ একদিনে বারুদের স্তূপে পরিণত হয়নি। উল্টোদিকের মানুষগুলো দেখেও দেখেননি সেই কালো ছায়া। না দেখার জন্যই আজ পুরো পরিবারকে গ্রাস করেছে অন্ধকার। সন্ধ্যা বা পাপড়ির জায়গায় তাদের স্বামীরাও এমন অপরাধ ঘটাতে পারতেন। বহুক্ষেত্রে দেখেছি আমরা এটা। পরিবারের পুরুষ প্রতিনিধিরা - অর্থাৎ স্বামী, বাবা, ভাই, ছেলে - এরাও এমন অপরাধ করে ফেলছেন। আসলে পরিবার একটা নৌকোর মতো। একটি দিক টালমাটাল হলে পুরো নৌকোই ডুবে যায়।
আরও পড়ুন: জেএনইউ কী শেখাল? হয় বশ্যতা, নয় ধ্বংস
এত কিছুর পর পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, তাই বলে একজন মা? এখানেই বলব, একটু ভাবুন নতুন করে। নারীর সার্থকতা মাতৃত্বে, এটা আপনি-আমি মনে করছি। সমাজের অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন। কিন্তু কেউ যদি বিষয়টা এভাবে না দেখেন, তাঁকে কি প্রথাগতভাবে দেখতে বাধ্য করা যায়? বাধ্য করেই বা কোন ভালোটা হচ্ছে? স্বার্থপরতা যেমন কাম্য নয়, তেমন নিজের ভালো থাকার ইচ্ছেটাও তো দূষণীয় নয়, তাই না? বিয়ে করতেই হবে, সন্তানের মা হতেই হবে, এটা তো জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার হলো।
একটি প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক সার্ভে বলছে, বিয়ে না করে বা সন্তানের মা না হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন, এমন মহিলারা তুলনায় বেশি সুখী। জানি, এটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু ভরপুর সংসারে অসুখী মহিলাদের কি চারপাশে দেখছি না আমরা? তবে, এ প্রসঙ্গেও একটা কথা অবশ্যই জোর দিয়ে বলব। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে একদিকে যেমন 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে', এটা অনেকটাই অবাস্তব এবং যুক্তিহীন মনে হয়, তেমনই সেই রমণী বা নারীকেও যুক্তির পথে গিয়েই প্রথার দাসত্ব-মুক্ত হতে হবে। অপরাধ তাকে কারাগারের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার বাইরে কিছুই করবে না। অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অপরাধের যে অন্ধগলিতে সে পা রাখছে, সেটা আর যাই হোক, খোলা আকাশের সামিয়ানা কখনওই দিতে পারে না।
সব শেষে, জীবনসঙ্গীর দায়িত্ব হলো সবচেয়ে বড়। সংসার বা সমাজের চেয়েও। একে অপরের পরিপূরক হওয়াটা আজকাল নানা কারণেই হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বিচ্ছেদের পথ অন্তত মারাত্মক অপরাধের চেয়ে শ্রেয় নয় কি? কিন্তু আমরা সেটা করি না। আমরা ভাবি, 'পাছে লোকে কিছু বলে!' দাম্পত্য, সন্তানের জন্ম, এই একান্ত ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়গুলির সঙ্গে কোথায় সমাজকে মেলাব আর কোথায় সমাজকে রাখব ঘরের সীমানার বাইরে, সেটা নিজেদেরই বিবেচনায় ঘটুক। আজকের শিক্ষিত, সচেতন নারী-পুরুষ যদি এটুকুও না করতে পারেন, তবে প্রথা ও নিয়মের বাঁধনটাই থাকবে শুধু। বাকি 'বেঁচে থাকা' বিষময়। এ বিষের দংশন ভবিষ্যতে আরও অনেক সন্ধ্যা ও পাপড়ির জন্ম দেবে, এটা জ্যোতিষ না জেনেও নিশ্চিতভাবে বলা যায়।