Advertisment

সন্তোষ রাণা: সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক সমাজবিপ্লবী

''প্রেসিডেন্সি'র উজ্জ্বল ছাত্র", বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট', 'মেধাবী গবেষক', এই যেসব অভিধায় আজ তিনি সংবাদমাধ্যমে ভূষিত সেই সন্তোষ রাণাকে আমরা চিনতাম না। চিনতাম গ্রামের পিচ রাস্তার ধারে আলো-বাতাসহীন একটা খুপরি ঘরের কার্যালয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Santosh Rana, CPIML

সন্তোষ রানা (১৯৪২-২০১৯)

বেশ কিছুদিন খুবই চিন্তিত ছিলেন বনবাসীদের অধিকার নিয়ে। যেভাবে শীর্ষ আদালত কলমের এক খোঁচায় প্রায় ১১ লক্ষ আদিবাসী এবং অন্যান্য পরম্পরাগত বনবাসীদের উচ্ছেদ করার আদেশ দিয়েছিল, সেই রায়ে যে কোনো সাধারণ সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন হবেন। আর তিনি তো সন্তোষ রাণা। সাতের দশকের গোপীবল্লভপুর-ডেবরা-বহেরাগোড়ার মাল, কোড়া, সাঁওতাল, বাগদিদের অবিসংবাদী কৃষক নেতা।

Advertisment

দিন পনেরো আগে যে সামান্য সময় কথা হল, কুমারই (রাণা) উদ্যোগ নিয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গের বন- জন শ্রমজীবী মঞ্চের সৌমিত্র ঘোষ ছিলেন। তবু অল্প সময়ের মধ্যে শরীরের দুর্বলতা সত্ত্বেও, অল্প কথায় তাঁর দেখা গোপীবল্লভপুর, নিজের গ্রাম পিতানাউয়ের জঙ্গল, জঙ্গলের সঙ্গে আদিবাসী, তেলি, সাউ, বেজ পরিবারের সম্পর্ক, বনকর্মীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, জঙ্গল লাগোয়া জমিতে চাষ আর সেই জমি কাড়তে এলে তাঁর মায়ের রুখে দাঁড়ানো থেকে বর্তমান সময়। চারবছর ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছেন, স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা হাঁপাচ্ছেন কথা বলতে, কিন্তু কথার খেই হারাচ্ছে না। চিরকালই নিচু স্বরে কথা বলেন তাই বলছেন, পুরনো কথা মনে পড়ায় হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়ছে মুখে, চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। বলছেন, ঝাড়গ্রামের এক সাধারণ  বনাধিকার আন্দোলনের কর্মীর কথা, কীভাবে তিনি অসামান্য উদ্যোগে সংগ্রহ করছেন প্রয়োজনীয় তথ্য; দলিল, দস্তাবেজ নিয়ে ছুটছেন আধিকারিকদের কাছে। শেষে বলেই ফেললেন, 'শোভন (পাল) এই আন্দোলনে আমার নেতা, আমি ওর কাছে শিখি।' এখানেই সন্তোষ রাণার অন্য়দের সঙ্গে তফাৎ।

আরও পড়ুন, আমাদের রাজনীতি: সমালোচনার অধিকার

''প্রেসিডেন্সি'র উজ্জ্বল ছাত্র", বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট', 'মেধাবী গবেষক', এই যেসব অভিধায় আজ তিনি সংবাদমাধ্যমে ভূষিত সেই সন্তোষ রাণাকে আমরা চিনতাম না। চিনতাম গ্রামের পিচ রাস্তার ধারে আলো-বাতাসহীন একটা খুপরি ঘরের কার্যালয়। শীতের দিনে মেঝেতে পাতা খড়ের বিছানায় যেমন তেমন চাদর পাতা। একটি কালচে মশারির কোনায় কোনায় থিকথিকে ছারপোকার ডেলা। কলাইয়ের থালায় একসঙ্গে ক্ষুৎনিবৃত্তি করে পাশের নয়ানজুলিতে থালা-গ্লাস মেজে নেওয়া। আর প্রায় অন্ধকার থাকতে থাকতে গ্রাম পেরিয়ে গাড়ু হাতে মাঠে যাওয়া। সেই সময় বিত্তহীন একটি দল সামান্য কয়েকজন কর্মী তখন উচ্চবর্ণবাদী এই সমাজের ভোল পাল্টাবে বলে, একটা একটা করে ইট গাঁথতে ব্রতী। তাদের কথা স্পষ্ট --- এই দেশের শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নিম্ন শ্রেণি মানেই নিম্নবর্গ, নিম্নবর্ণ, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া বর্গ, আদিবাসী এবং মুসলমান। জাতিব্যবস্থার মূলে আঘাতও শ্রেণিসংগ্রাম। আমাদের দেশে জাতিপরিচয় না-বুঝলে শ্রেণিপরিচয় বোঝাটা অধরা থেকে যায়। সেই মুহূর্তে নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে এই কথাগুলো বার বার বলাটাই ছিল লক্ষ্য।

আজ এ কথা অনেকে বামপন্থী স্বীকার করছেন বটে, তবে সেই আশির দশকে তখন তিনি এবং দল পিসিসি, সিপিআই(এমএল) এই কথাগুলো, 'ছোটলোক'দের কথা বড়ো মুখে বলার জন্য 'ভদ্রলোক' এবং বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কাছে, ঘরে-বাইরে যারপরনাই নিন্দিত হচ্ছে। কেননা একটি কমিউনিস্ট পার্টি, তাও আবার নকশালপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ক্লাস স্ট্রাগল  ছেড়ে, কাস্ট স্ট্রাগল শুরু করল! কী অধঃপতন! শুধু তো জাতপাত না, তার উপর আবার মুসলমানদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতেও মেতেছে। স্বাভাবিক ভাবেই 'প্রতিক্রিয়াশীল' তকমা জুটতে, একঘরে হতে বেশি সময় লাগেনি। জাতিবর্ণগত নিপীড়ন, বৈষম্য তখনও তাঁদের চোখে পড়েনি, মনে ধরেনি। তাঁরা শ্রেণি চরিত্রকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। জাতিবর্ণ পরিচয় ছিল তাঁদের কাছে উপরিকাঠামো। ফলত, মণ্ডল কমিশন হোক কিংবা সাচার কমিটির রিপোর্ট তাঁদের মনে দাগ কাটল না।

আরও পড়ুন, জরুরি অবস্থার স্মৃতি আজও প্রাসঙ্গিক

এই তো কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে আটের দশক থেকে বহুবার বলা কথা আরও একবার বললেন। সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললেন, "বামপন্থীরা ভারতীয় সমাজকে চিনা বা ইউরোপিয় সমাজের মতো করে দেখেছিল। এটা বামপন্থীদের বড় ভুল ছিল।" এর পর একটু ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, "...'৬৯ সালে গ্রামে বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে গিয়ে দেখলাম মার্ক্সের নাম জানি, লেনিনের নাম জানি, মাও সে তুঙের নাম জানি, ভিয়েতনামের নাম শুনেছি কিন্তু আমরা আম্বেদকারের নামই জানি না। পেরিয়ারের নামই শুনিনি। এর মানে হল, ভারতের কাস্ট স্ট্রাকচার সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। অথচ ভারতীয় সমাজ যে আলাদা হবে সেটাই স্বাভাবিক। কেন সেটা চিনের মতো হবে। (প্রতিদিন, ২৯ এপ্রিল ২০১৮)।

কেন চিনের থেকে আলাদা সে প্রশ্নের ব্যাখ্যাও পাব আমরা তাঁর লেখায়। তবে, উদ্ধৃতি একটু দীর্ঘ হবে। ১৯৬৯ সালে গোপীবল্লভপুরে জোতদারদের উপর আক্রমণ, জমি কাড়া আবার পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখে প্রথমদিকে লড়াইয়ে থাকা মধ্যজাতির (তেলি, সদগোপ, খণ্ডায়েত, রাজু প্রভৃতি) গরিব কৃষক এবং খেতমজুরদের বিপরীত শিবিরে সরে যাওয়া কিন্তু মাল, সাঁওতাল, কোড়া, বাগদিদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তিনি লিখছেন:

"আমাদের শ্রেণি বিশ্লেষণের ধরণ ছিল এই রকম: যাঁরা পুরোপুরি মজুরি-শ্রম বিক্রি করার উপর নির্ভরশীল তাঁরা ক্ষেতমজুর; যাঁরা আংশিক সময়ে মজুরি-শ্রম বিক্রি করেন ও বাকি সময় নিজ জমিতে বা ভাগ-জমিতে চাষ করেন তাঁরা গরিব কৃষক; যাঁরা মূলত শ্রমশক্তি ক্রয় বা বিক্রি কোনোটাই করেন না তাঁরা মাঝারি কৃষক; যাঁরা মূলত শ্রমশক্তি ক্রয় করেন, কিন্তু, নিজেরাও কিছু পরিমাণে প্রধান ধরণের শ্রমে অংশগ্রহণ করেন তাঁরা ধনী চাষি এবং যাঁরা কোনও প্রকার শ্রমে অংশগ্রহণ না করে মজুর খাটিয়ে এবং জমি ভাগে দিয়ে সেই উদ্বৃত্তের উপর সংসার চালান তাঁরা জোতদার। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি এভাবেই চিনা সমাজের শ্রেণি-বিশ্লেষণ করেছিল এবং আমরাও সেটাকে অনুসরণ করেছিলাম। কিন্তু, এই পথের বিশ্লেষণ আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলল না - একই অবস্থানের হওয়া সত্ত্বেও তেলি, সদগোপ, মাল ও সাঁওতালরা রাজনৈতিক ভাবে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিলেন। এটা শুধু গোপীবল্লভপুরের অভিজ্ঞতা নয়। দেশের নানা প্রান্তে যাঁরাই কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন তাঁদের সকলেরই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই সমস্যাটা চিন্তা করতে গিয়ে ধরা পড়ে যে আমরা শ্রেণিটাকে সংকীর্ণ অর্থে অর্থাৎ শুধু উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা বা মালিকানাহীনতা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম।" ( সন্তোষ রাণা, কুমার রাণা, পশ্চিমবঙ্গে দলিত ও আদিবাসী, কলকাতা, ক্যাম্প, ২০০৯)।

আরও পড়ুন, চিকিৎসক আন্দোলন: বিনায়ক সেনের কী বক্তব্য?

বারোমাস পত্রিকার ২০১০-এর শারদীয়া সংখ্যায় বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় লেখেন, "...সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের জাতি-ব্যবস্থার বিন্যাসে, অথবা তার প্রভাবে, পরিবর্তন এসে থাকলে তার চরিত্র নিয়ে প্রায় কোনো আলোচনাই নেই বলা চলে --- তা সে সমাজবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ মহলেই হোক, অথবা রাজনীতির ক্ষেত্রেই হোক। সন্তোষ রাণা ঠিকই বলেছেন, বামপন্থী থেকে দক্ষিণপন্থী কোনো রাজনৈতিক দলই পশ্চিমবঙ্গের জাতিব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে রাজি নয়।"

সন্তোষ রাণা কিংবা কুমার নৃতত্ত্ববিদ ছিলেন না বা নন, কিন্তু দলিত ও আদিবাসী বিষয়ক নৃতত্ত্ববিদদের রচিত কোষগ্রন্থের সঙ্গে তুলনীয়, রাজ্যের প্রতিটি জাতি ও আদিবাসী গোষ্ঠীর পৃথক বর্ণনা সম্বলিত বইটি নিয়ে আলোচনা প্রায় শুনিইনি। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় এই বইটির আলোচনায় ১৯৩১-এর সেনসাস এবং সেই সেনসাসের ভিত্তিতে নির্মলকুমার বসু ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের 'শিক্ষা ও উচ্চকোটির পেশাগুলি দখল' করে থাকার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন এবং আলোচনাও করেছেন। এই জন্যই এ কথা বলা যে, ১৯৩৯ সালে প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ নির্মল বসু'র 'হিন্দু সমাজের গড়ন' শীর্ষক এই বইটি বিশ্বভারতী'র 'লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা' সিরিজে প্রকাশিত হয়। এই বইটির আলোচনা যতটা সমাজবিজ্ঞানীদের মুখে শোনা যায় তার একাংশ শোনা যায় না বামপন্থী রাজনীতিক কিংবা কর্মীদের মুখে। রোহিত ভেমুলার মৃত্যু, জিগনেশ মেওয়ানি, কানাইয়া কুমারদের উত্থান সন্তোষ রাণা এবং পিসিসি'র প্রয়াত তাত্ত্বিক নেতা ভাস্কর নন্দীদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার গুরুত্ব প্রমাণ করে। সিপিআই(এম)ও সর্বভারতীয় দলিত ও আদিবাসী সংগঠন গড়ে তুলেছে।

আরও পড়ুন, মোদী বনাম ট্রাম্প, না মোদীর পাশে ট্রাম্প?

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সন্তোষ রাণা বিশ্বাস করতেন, 'বামপন্থাই গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষক --- এই ভাবধারাকে জনসাধারণের মধ্যে প্রসারিত করেই বামপন্থা নিজেকে এবং ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে পারে।' দেশের বহুত্ববাদিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষটি বিগত পাঁচ বছর ধরে বার বার নানা লেখায় দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে গিয়েছেন। 'এক ব্যক্তি-এক দল-এক ধর্ম-এক জাতি গঠনের' পথে 'সাম্প্রদায়িক, স্বৈরতান্ত্রিক এবং কর্পোরেট পুঁজির মেলবন্ধনে গড়া মতাদর্শ' যে ক্রমে দেশকে গ্রাস করতে উন্মুখ তার বিরুদ্ধে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিই যে মূল্যবান সংগ্রাম চালাতে পারে শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত এই বিশ্বাসে তিনি অবিচল ছিলেন। তাঁর সমকালীন সমাজ ও রাজনীতিতে তিনি ঢের বেশি এগিয়ে ছিলেন। ভেরেন্ডার ভিড়ে যেন এক মহাদ্রুম।

(দেবাশিস আইচ, সন্তোষ রাণার এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোগী।)

naxal
Advertisment