নোটবাতিল, জিএসটি, সার্জিকাল স্ট্রাইক, রাফাল-বিমান থেকে নাগরিক-নকশাল বা শবরীমালা পর্যন্ত সব তাসগুলি একে-একে ব্যর্থ হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী ও যোগী আদিত্যনাথের নবতম চাল পটেলমূর্তি স্থাপন ও রামমূর্তির পরিকল্পনা শাসকদলকে ভোট-বৈতরণী পার করতে সাহায্য করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে শাসকদলেই।কিন্তু, সার্বিকভাবে জনকল্যাণবিরোধী দলটি তো শূন্য-হাতে ভোটারদের কাছে যেতে পারে না। যে-রামমন্দিরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছিল, তা যখন তামাদি হয়ে এসেছে, যখন রামভক্ত ভোটাররাও ‘অসহিষ্ণু’, তখন রামমন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উপর চাপ সৃষ্টি করেও সফল হয়নি তারা। শীর্ষ আদালত সাফ জানিয়ে দিয়েছে, মন্দিরমামলা এমন-কোনও জরুরি বিষয় নয় যে খামোখা তা নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের কঠোর মনোভাব বুঝে, পটেলমূর্তি উন্মোচনের অব্যবহিত পরেই যোগী আদিত্যনাথ জানিয়ে দিয়েছেন, অযোধ্যায় মন্দিরের জন্য অনন্তকাল বসে থাকতে পারে না রামভক্তরা। তার আগেই তিনি অযোধ্যায় পটেলমূর্তির চেয়েও দীর্ঘকায় রামমূর্তি বসিয়ে ফেলবেন।
নরেন্দ্র মোদী যখন প্যাটেলমূর্তির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের দান চালছেন, তখনই যোগীর রামমূর্তির প্রকল্পনা তাৎপর্যপূর্ণ।মোদীর তথাকথিত জাতীয়তাবাদে যে যোগীর তেমন আস্থা নেই, তা এই সিদ্ধান্তে যেমন স্পষ্ট, তেমনই মোদীও বিষয়টি ভালভাবে নিতে পারেন না। কেননা, যোগী যদি দীর্ঘতর রামমূর্তি সত্যিই বানিয়ে ফেলেন, তাহলে তা মোটেই তাঁর প্রতাপানুকূল হবে না। কিন্তু, মানুষ বুঝে গেছে, পটেল বা রামচন্দ্র আসলে মোদী ও যোগীর অহংকারের উপলক্ষমাত্র। রাম বা পটেল কারও প্রতিই মোদী বা যোগীর ভক্তি অবিচল নয়। ফলে, মূর্তি গড়ে তাঁরা যতই নিজেদের ভাবমূর্তি তৈরিতে সচেষ্ট হোন, তাতে ভবী ভোলার নয়।সে-কারণেই সাবধানতাবশত কর্মবীর যোগী ইতিমধ্যেই ফৈজাবাদের নাম অযোধ্যা ও এলাহাবাদের নাম প্রয়াগ করে ছেড়েছেন। আসন্ন কুম্ভমেলা নিয়ে শুরু করে দিয়েছেন প্রচারসমারোহ। কেন্দ্রও যোগীরাজ্যের আগ্রা ও মুজফ্ফরনগর-সহ দেশের পঁচিশটি গ্রাম-শহরের নাম পালটানোর সবুজসংকেত দিয়েছে। মেরুকরণের রাজনীতি জোরদার করতে দেশীয় ইতিহাস থেকে মুসলমানি চিহ্নগুলি মুছে দিতে তৎপর তারা। যে-তৎপরতায় তালিবান ভেঙেছে বামিয়ামের সুপ্রাচীন বুদ্ধমূর্তি, সে-তৎপরতায়ই বাবরি মসজিদ ভেঙে সূচনা হয়েছিল দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস বিকৃত করা। সেই ধারাই আরও-অপ্রতিহত করতে চায় কট্টর-হিন্দুত্ববাদীরা।
আরও পড়ুন, শবরীমালার তাণ্ডবেও অম্লান নারীশক্তির আরাধনা
তবে, বিজেপি যে কেবল ইতিহাস মুছতে বা মসজিদ ভাঙতেই তৎপর, তা নয়। প্রধানমন্ত্রী বরং সক্রিয় বিকৃত ইতিহাস গড়তেও। সেই লক্ষ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ কাজটি সেরে ফেলেছেন তিনি। তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে গুজরাতগর্ব সর্দার বল্লভভাই পটেলের আকাশছোঁয়া মূর্তি উন্মোচিত হয়েছে সাড়ম্বরে। চিনে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ‘বুদ্ধর বসন্তমন্দির’-এর চেয়ে পটেলমূর্তি ত্রিশ-মিটার উঁচু। লৌহমানবের মূর্তিটিকে প্রধানমন্ত্রী চিহ্নিত করেছেন ‘ঐক্যমূর্তি’ হিসেবে।৩১ অক্টোবর পটেলের ১৪৩তম জন্মদিনে (সার্ধ-শতবর্ষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব) গুজরাতের নর্মদা জেলার সাধুদ্বীপে মূর্তিটির আবরণ উন্মোচন করে প্রধানমন্ত্রী ভোটারদের সঙ্গে নিজের ঐক্য সুনিশ্চিত করতে চেয়েছেন। অন্তত, প্রধানমন্ত্রী নিজে যে তেমনই ভাবছেন, তা তাঁর সে-দিনের বক্তৃতায় স্পষ্ট। উন্মোচনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন ‘এই মূর্তিস্থাপনে আঞ্চলিক আদিবাসী, কৃষক ও আপামর গ্রামবাসীর অবদান ভুললে চলবে না। ইতিহাস তাদের কথা মনে রাখবে। এই প্রকল্পের ফলে অঞ্চলের সমৃদ্ধি হবে, কর্মসংস্থান হবে, রোজগার বাড়বে, রাজ্যের পর্যটনে জোয়ার আসবে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই সুভাষিতে যেমন তাঁর ভোটলক্ষ্য প্রকট, তেমনই পরিস্ফুট তাঁর চিরকালীন মিথ্যাচারিতাও। ‘গ্রামবাসীদের অবদান’ দিয়ে তিনি আড়াল করতে চেয়েছেন সংলগ্ন তিনশো-গ্রামের উচ্ছেদপর্বটিই। উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনের সামনে তিনি ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছেন উন্নয়নের স্বভাবসিদ্ধ লালিপপ। এই মূর্তির আড়ালে রয়ে গেছে আরও-এক মিথ্যাচারিতা। ২০১৩ সালে পটেলমূর্তি স্থাপনের পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার পরে ‘সর্দার বল্লভভাই পটেল রাষ্ট্রীয় ট্রাস্ট’ প্রকল্পটি জনমুখী করে তোলার তাগিদে দেশের কৃষকদের থেকে তাদের ব্যবহৃত লৌহসরঞ্জামের বিপুল দানগ্রহণ করে। পাঁচ লক্ষেরও বেশি কৃষক এই অভিযানে শামিল হয়েছিলেন। তাদের থেকে সংগৃহীত হয় পাঁচ হাজার টন লোহা। যথারীতি কৃষকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অগ্রাহ্য করে সংগৃহীত লোহা ব্যবহৃত হয় মূর্তির বদলে অন্যান্য পরিকাঠামোয়। চিনে-নির্মিত মূর্তিটিতে যে ওই দেশীয় লোহা ব্যবহার আদৌ সম্ভব নয়, তা ছিল পূর্বানুমিতই।
কথা তা নয়। কথা হল, মোদী দেশবাসীকে নতুন করে জানাতে চান, স্বাধীনতার পরে দীর্ঘদিন বিভিন্ন জাতিসত্তার দাবি অগ্রাহ্য করে লালকেল্লায় পতাকা উড়িয়েছেন কেবল হিন্দিবলয়ের প্রধানমন্ত্রীরা। এই অভিযোগে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে থাকেন যে, সেই তালিকায় ছিলেন মোদীর দলীয় অগ্রজ অটলবিহারী বাজপেয়ীও। সে-ক্ষেত্রেও গুজরাতি নেতা পটেলের মতো লালকৃষ্ণ আডবাণীকেও উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। মোদী মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চান, তাঁর আগে দেশ প্রথম অকংগ্রেসি গুজরাতি-প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পেয়েছিল মোরারজি দেশাইকে। মোদী চিরকাল গান্ধীপরিবারতন্ত্র নিয়ে সরব হলেও, দীর্ঘকালীন-কংগ্রেসি মোরারজির সঙ্গে জরুরি অবস্থার প্রযোজক ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা তাঁর কাছে গুরুত্বহীন। লক্ষণীয়, তিনি কোনওদিন গুজরাতমহিম মোরারজির নামোচ্চারণ করেননি। তা করলে তাঁর নিজস্ব গুজরাতি-অস্মিতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা, জনতাদলের প্রধানমন্ত্রী হলেও স্বাধীনতা আন্দোলন থেকেই মোরারজি ছিলেন সক্রিয়-কংগ্রেসি। গুজরাত প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিও হয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া, মোরারজির কথা তুললে, ইন্দিরারাজের অবসানে বামশক্তির লড়াইয়েও স্বীকৃতি দিতে হয়। এই প্রেক্ষিতেই পটেলকে দেশের ‘ঐক্যদূত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মোদী। কেননা, তিনিই ৫৬২টি দেশীয় রাজতন্ত্রকে প্রজাতন্ত্রী কাঠামোয় যুক্ত করেছিলেন। মোদী এ-ক্ষেত্রেও ইতিহাসের ধারাসূত্রটি ঘুলিয়ে দিতে চান। কেননা, দেশীয় রাজাদের নবগঠিত সাধারণতন্ত্রে যুক্ত হওয়া ছিল সমকালীন ক্ষেত্র-বাস্তবতা। সে-ক্ষেত্রে পটেল ছিলেন অনুঘটক মাত্র। সবচেয়ে বড়কথা, পটেলের সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর রাজনৈতিক মতাদর্শের তফাত কখনওই বাজপেয়ী-আডবাণীর সঙ্গে মোদীর মধুর-ব্যবধানে পর্যবসিত হয়নি। অথচ, পটেলকে ‘রাজনৈতিক শহিদ’ রূপেই প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন মোদী। সে-ক্ষেত্রেও তিনি মনে রাখেননি আডবাণীকে তিনি স্বয়ং কীভাবে ‘শহিদত্ব’ দিয়েছেন। অথচ, একদিন আডবাণীই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রেরণা হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মনে না-রাখলেও, মানুষ জানে, ওই ঐক্যমূর্তির আড়ালে তিনি দেশ জুড়ে হিন্দু-মুসলমান ব্রাহ্মণ-দলিতের কীরকম অনৈক্যের বাতাবরণ তৈরি করেছেন।
এখন রাজনীতিতে এক-ঢিলে একশো-পাখি মারতে হয়। মোদীও আসলে সবদিক বিবেচনা করে পটেলের সমুজ্জ্বল ভাবমূর্তিটি স্থবির-মূর্তিতে পরিণত করে যুগপৎ দেশাত্মবোধ ও কংগ্রেস-বিরোধিতার ঘুঁটি সাজাতে চেয়েছেন। চেয়েছেন চিরকালীন-কংগ্রেসি পটেলকে কেন্দ্রচ্যুত করতে। সে-জন্য লৌহমানবের হিন্দুত্ববাদ-বিরোধিতাও মানতে হয়েছে তাঁকে। কেননা, খাস-গুজরাতেই মোদীবিরোধী হাওয়া ক্রমশ উত্তাল হচ্ছে। পাঁচ-বছরে জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে এক-ইঞ্চিও প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বরং গুজরাতের তরুণ-প্রজন্ম ক্রমশই জিগ্নেশ মেলোয়ানি বা হার্দিক পটেলের মতো তরুণতুর্কিদের পাশে জড়ো হচ্ছেন। দিল্লিতে যেমন দ্রুত উঠে আসছেন কানাইহা কুমার, খালিদ উমর বা অনির্বাণ ভট্টাচার্যরা। তাই পটেলমূর্তিটিকে তিনি যতই ‘ঐক্যমূর্তি’ হিসেবে পরিগণিত করতে চান, তাঁর প্রকৃত লক্ষ্য গুজরাতি ভোটে ভাঙনরোধ। কেননা, দেশে যে ‘মোদীজাদু’ অপস্রিয়মাণ, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিককালের কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচন ও উপনির্বাচন। তাই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের বিধানসভা এবং দেশে লোকসভা ভোটের আগে নতুনতর কোনও কৌশল তাঁকে নিতেই হত। ফলে, অচ্ছে দিন বা মন্দির-মসজিদে ভরসা না-রেখে তিনি তুলে নিয়েছেন দেশাত্মবোধ ও জাতীয় ঐক্যের তাসটিই। কেননা, তিনি বুঝে গেছেন, বাবরি মসজিদ ভেঙে বা গুজরাতে দাঙ্গা করে একদা যে-উন্মাদনা জাগানো গিয়েছিল হিন্দুত্ববাদী-মনে, তাঁর পাঁচ-বছরের কালবেলার পরে তা আর ফলপ্রসূ হবে না।
এই তথাকথিত দেশাত্মবোধের ইঙ্গিত আমরা কিছুদিন আগেই পেয়েছিলাম সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবতের স্বাধীনতাযুদ্ধের সাড়ম্বর-জয়গানে। চিরকাল স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্র করে, জাতীয় পতাকার অবমাননা (যোগাসনে মোদীর ঘামমোছা) করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ স্বাধীনতার জয়গান গাইতে আসর সাজিয়েছিল। প্রণব মুখোপাধ্যায় নাগপুরে সঙ্ঘের সদর-দফতরে ভাষণ দেওয়ার পরে, ভাগবতরা মনে করছেন, তারা সমাজের মূল-স্রোতে যুক্ত হয়ে গেছেন। যদিও, বিশ্বকর্মাপুজোর দিন রাজধানীর বিজ্ঞান ভবনে সঙ্ঘের তিনদিনব্যাপী আলোচনাসভার প্রথম দিনেই সঙ্ঘপ্রধানকে প্রাথমিকভাবে খেলতে হয়েছিল এক-পা পিছিয়ে। কেননা, তিনি তো আর ক্রিকেটের মহারাজ নন যে, এই বয়সেও তাঁর মতো এগিয়ে এসে ছক্কা হাঁকাতে পারবেন। ফলে, উপক্রমণিকায়ই তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের অবিসম্বাদিত ভূমিকা। দেশে যখন মেরুকরণের অভিযোগ উঠছে সঙ্ঘ-পরিবার তথা শাসকদল বিজেপি-র বিরুদ্ধে, তখন সরকারি মদতে বিজ্ঞানভবনের সভাঘরে এমন সূচনাভাষণই অভিপ্রেত ছিল ভাগবতের কাছে। ভাগবত তাঁর ভাষণে স্বীকার করে নেন, হিন্দুসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার সূত্রেই সঙ্ঘের সূচনা। সে-কারণে সঙ্ঘ সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণাও রয়েছে। সেই ধারণা দূর করতে তিনি সঙ্ঘচালকদের সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধের সম্পর্কেরও অবতারণা করেছেন, যা হাস্যকরভাবে এক বিরোধাভাসের জন্ম দেয়। স্বাধীনতাসংগ্রামে কংগ্রেস নামে মঞ্চটির উল্লেখেই ভাগবত প্রথম বাইরের বলে খোঁচা দেন। কেননা, সেই মঞ্চটি কখনও দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত করেনি। মুসলমান-জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে যে দেশের স্বাধীনতা মরীচিকামাত্র, ঐতিহাসিক সূত্রেই তা জানতেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কিন্তু, সঙ্ঘের সূচনামন্ত্রই ছিল হিন্দু-ঐক্য তথা মুসলমান বিরোধিতা। ফলে, দুটি বিষয় যে যুগপৎ ঘটা সম্ভব, এতদিন পরে ভাগবত সাড়ম্বরে সে কথা বোঝাতে বসলে তা সঙ্ঘসমর্থকরা বুঝলেও, দেশের মানুষ বুঝবেন, এমন আশা করা বাতুলতাই। ক্রিকেটের বাইশ-গজে বহু মহারথীকে আমরা বাইরের বলে খোঁচা মেরে প্যাভেলিয়নে ফিরে যেতে দেখেছি। ভাগবত সেভাবে মাঠের বাইরে না-গেলেও, ওই খোঁচাটি আপাতত তাঁর কোনও কাজে লাগেনি।
তবু, দেশাত্মবোধের সেই ছলনার পিচেই ব্যাট করতে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর রাজনীতির অভিসন্ধি আরও গভীরজল। আসলে, তিনি যখন তথাকথিত জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমের সুকঠোর পদক্ষেপ করছেন, তখন ইতিহাস খুঁজে একজনও স্বাধীনতাসংগ্রামী মিলছে না দলে বা সঙ্ঘের ইতিহাসে। মানুষ দেশপ্রেমের হিসাব চায়। অথচ, তাঁর হাতের ফর্দে দুটি-মাত্র নাম, সাভারকর ও বাজপেয়ী, যাঁরা দু-জনেই চিহ্নিত মুচলেকাসংগ্রামী। তখন বাধ্যত তাঁকেও ভাগবতের মতো কংগ্রেসশিবিরেই চোখ ফেরাতে হয়েছে। অনেক হিসেব কষেই তিন-হাজার কোটি টাকা খরচ করে তিনি অন্তিম কুমিরছানার মতো প্রতিষ্ঠা করেছেন দীর্ঘকায় পটেলকে। এই দীর্ঘতম মূর্তির গরিমায় ঢেকে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন দেশ-বিদেশে গান্ধীমূর্তিগুলির মহিমাও। কেননা, সঙ্ঘের হাতে লেগে আছে গান্ধীজির রক্ত। হয়তো, একই সঙ্গে তিনি মুছে দিতে চেয়েছেন ইন্দিরা গান্ধীর রক্তাপ্লুত শহিদদিবসটিও। আসলে, সবটাই প্রধানমন্ত্রীর সহজাত ভড়ং। তিনি চটকদারিতে বাজিমাত করতে চান। নোটবন্দি, সার্জিকাল স্ট্রাইক, বুলেট-ট্রেন, রাফাল-বিমানের মতোই পটেলমূর্তিও তাঁর একটি সুশোভন চমক। যার কোনওটিই মানুষের কাজে লাগে না। আসলে, পটেলের মাধ্যমে তিনি যেমন দল ও নিজেকেও জুড়তে চান স্বাধীনতা-আন্দোলনের ইতিহাসে, পরিকল্পিত দেশাত্মবোধে পার হতে চান ভোটবৈতরণী, তেমনই তিনি কার্যত হয়ে উঠতে চান লৌহমানবের মতো দীর্ঘতমও। তাই ত্রিপুরায় দল লেনিনমূর্তি ভেঙে দিলেও তিনি থাকেন মৌন, অথচ পটেলমূর্তিতে লগ্ন করে দেন নিজের অহমিকাই। কেননা, সাজাহানের মতো তিনিও চান নিজপ্রতিষ্ঠাই। তফাত একটিই, সাজাহান ছিলেন সম্রাট আর মোদী দেশের গণতান্ত্রিক প্রধান।
কিন্তু, আমরা তো দেখেছি, রাজ্য জোড়া মূর্তি বসিয়েও নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে পারেননি মায়াবতী, অজস্র মণীষীমূর্তি ভেঙেও চিনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান করা যায়নি। ইতিহাসের নিয়মেই মোদীও যে মূর্তিরাজনীতিতে সফল হবেন না, তা বোঝা সময়ের অপেক্ষামাত্র। কেননা, ঘরপোড়া মানুষ দেখেছে, কীভাবে উল্লম্ফন চলছে রান্নার গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দামে। কেননা, মানুষ জেনে গেছে, অধিগৃহীত সংস্থাগুলিকেই ‘সামাজিক দায়িত্ব’ পালনার্থে পটেলমূর্তির জন্য জোগাতে হয়েছে আড়াই-হাজার কোটি টাকা। কেননা, মানুষের মনে আছে, অনাহারক্লিষ্ট মানুষ কীভাবে ধূলায় লুটিয়েছিল হীরকরাজার মূর্তি।
মতামত ব্যক্তিগত