Advertisment

সমাজটাই যে কৃত্তিকা আজ

কৃত্তিকা তো নতুন কোনও ঘটনা নয়। খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা ইত্যাদি নানা কারণে অকালে ঝরে গেছে বহু প্রাণ। প্রতিবারই আলোড়ন উঠেছে এবং কোনও এক সময় স্তব্ধ হয়ে গেছে সব।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

মৃত্যুর ঠিক আগে, যখন একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছিল তার চোখে, বন্ধ হচ্ছিল শ্বাসপ্রশ্বাস। সেই অন্তিম মুহূর্তে যে কথা তার হৃদয় মন্থন করে উঠে আসছিল, সেই কথা আর জানা যাবে না। পুলিশ তদন্তে অনেক গোপন কথা বাইরে আসবে। কিন্তু তার মনের কথা অধরাই থেকে যাবে। জানা যাবে না, কোন উথালপাথাল ঢেউ আলোড়িত করছিল তার অন্তর্জগত। কোন অমোঘ ডাক তাকে তরতাজা জীবন থেকে এই অকালমৃত্যুর অভিমুখে নিয়ে গেল, কেউ জানবে না কোনওদিন।

Advertisment

কৃত্তিকা পাল। এক কিশোরী। সম্প্রতি স্কুলের বাথরুমে আত্মহত্যা করে সে। অত্যন্ত মর্মান্তিক এই ঘটনা ইতিমধ্যেই পরম আকুলতায় আলোড়িত করেছে আমাদের। একটা ছোট্ট মেয়ে। সে প্লাস্টিকে নিজের মুখ বেঁধেছে। হাতের শিরা কেটেছে, আঙ্গুল কেটেছে। অর্থাৎ কোনও দিক থেকেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট করতে চায়নি সে। কেন? কিসের এত জ্বালা অন্তরে বাহিরে মথিত করছিল তাকে? পুলিশ তদন্ত করছে। মনস্তাত্বিকরা পর্যালোচনা করছেন। শিক্ষাবিদরা তাঁদের সুচিন্তিত মতামত জানাচ্ছেন। সমাজকর্মী ও মানবাধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন। এগুলো নিশ্চয়ই সুলক্ষণ। আশা করব, প্রতিবারের মতোই এই ভাবনা-চেতনা-পর্যালোচনা অসমাপ্ত অর্থাৎ কোনও এক চোরাগলির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে না।

এটা কিন্তু কোনও অভিযোগ নয়। এটা আক্ষেপ। কৃত্তিকা তো নতুন কোনও ঘটনা নয়। খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা ইত্যাদি নানা কারণে অকালে ঝরে গেছে বহু প্রাণ। প্রতিবারই আলোড়ন উঠেছে এবং কোনও এক সময় স্তব্ধ হয়ে গেছে সব। স্তব্ধই থেকেছে আবার কোনও এক কৃত্তিকার জীবনে অন্ধকার নেমে আসার আগে পর্যন্ত। তবে, অভিযোগ যদি করতে হয়, সেখানে আমি নিজেকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাব। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সমাজমনস্ক মানুষ হিসেবে এই বারবার ঘটে যাওয়া সমস্যা কতটুকু ভাবায় আমায়? আমি কি আমার আশপাশের শিশু-কিশোর বয়সীদের সংকট দেখতে পাই বা দেখার চেষ্টা করি?!

স্কুল কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে একটা অভিযোগ উঠেছে, যা অত্যন্ত যুক্তিসংগত। এতক্ষণ সময় ধরে কৃত্তিকা ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু কেউ সেটা খেয়ালই করলেন না। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেও প্রাণ ছিল কৃত্তিকার দেহে। অর্থাৎ সময়ে খেয়াল করলে সে বেঁচে গেলেও যেতে পারত। এই খেয়াল না করাটা চরম উদাসীনতা। আর এটা শুধু একটি বা একাধিক স্কুল কর্তৃপক্ষ নয়, আমরা সবাই করে চলেছি। যখন নিজের ঘরে আগুন লাগে, যখন নিজের ঘরের প্রাণ যায়, তখন আমরা নড়েচড়ে বসি।

দুঃখ এই, যে নড়েচড়ে বসার ক্ষেত্রেও নিজেদের কাছে সৎ থাকি না আমরা। স্কুল কর্তৃপক্ষ উদাসীন ছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু কৃত্তিকার অভিভাবক? জানা যাচ্ছে, কৃত্তিকা এর আগেও বাড়িতে একবার আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করে। সেটা স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানান নি তার অভিভাবকরা। এ ছাড়াও এই প্রথম ঘটনাটি বাবদ কৃতিকাকে কোনও কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিনা, পরিষ্কার নয়। তার লম্বা সুইসাইড নোটে কৃত্তিকা সবথেকে বেশি অভিযুক্ত করেছে বাবা-মাকে। পাঠক, সেই সুরে সুর মিলিয়ে আমিও নিছক সেটারই উল্লেখ করে দায় সেরে ফেলতে চাই না। আসলে এই প্রেক্ষিতেও উঠে আসে অনেকগুলি দিক।

অভিভাবকদের একটা বড় দায় নিশ্চয়ই আছে। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য, অভিভাবকদের একটি ফোরাম তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই গত কয়েক বছরের এই জাতীয় ঘটনা পরম্পরার পরিপ্রেক্ষিতে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। দেরিতে হলেও এর একটা কার্যকর ভূমিকা নিশ্চয়ই দেখছি ও দেখব।

কিন্তু এও তো বাইরের ভূমিকা। কৃত্তিকার অন্তর্জগত? যেখানে পথ চলা শুরু হচ্ছে তার বাবা-মায়ের হাত ধরে। এটাকে যদি সবথেকে স্পর্শকাতর বিষয় বলি, তাহলে সেটা বোধহয় অতিরিক্ত হবে না। আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরে একটা সুস্থ পরিবেশ পেয়েছি বাড়িতে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার পরও আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রভাব বজায় ছিল আমাদের জীবনে। নিউক্লিয়ার, নাকি তার থেকেও ছোট পরিসরে সেটা অনুপস্থিত। আমি জানি এই উল্লেখগুলি বহু ব্যবহারে জীর্ণ। কিন্তু এর গুরুত্ব কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন? আমরা যে খোলামেলা আবহে বেড়ে উঠেছি, সেটা কি ওরা পায়?

এটা ঠিক, হাজার হাহাকার করলেও সেই দিন ফিরে আসবে না। কিন্তু পরিবারে এবং সমাজে (যা কিনা আমাদের বৃহত্তর পরিবার) একটা সুস্থ বাতাবরণ যে চাই এটা তো নিশ্চিতরূপে বলা যায়। আর এই সুস্থ বাতাবরণ সৃষ্টি ও রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। আমরা বড়রা একে অপরকে সুস্থ থাকতে না দিলে, পর প্রজন্মকে জীবনের আসল পাঠ কেমন করে পড়াব? অর্থাৎ ঘরের বাইরে যে ঘর, সেটাকেও সমান গুরুত্বে ঠিক রাখতে হবে।

অভিভাবকরা যে ভুলটা করেন, তাঁরা বাড়ির বাচ্চাদের সামনে বহু সময়ই এমন কিছু আচরণ করে ফেলেন, যেটা সুস্থ আবহের পরিপন্থী। ওরা আর কী বোঝে, এটা একটা অসম্পূর্ণ চেতনা। মায়ের প্রতি বাবার ব্যবহার বা বাবার প্রতি মায়ের মনোভাব ওরা লক্ষ্য করে এবং তার দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। পরিবারের অন্যদের প্রতি, বাড়ির বাইরের মানুষদের সম্পর্কে ভাবনা, এইসব নিয়েও মাথা ঘামায় ওরা। মানে ওদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া ঘটে। কেউ যদি বলেন, ওদের এগুলো ভাবার বিষয় নয়, ওরা মন দিয়ে কেরিয়ার তৈরি করুক। নিজেকে একবার ওদের জায়গায় রেখে দেখবেন অভিভাবককুল, উপলব্ধি করতে পারবেন আসল সত্য। আর লেখাপড়া, কেরিয়ার কি জীবনের বাইরে? এর ফলে আমরাই তো এক উদাসীন প্রজন্ম তৈরি করছি, তাই না?

অভিভাবকদের ভাবনার পিছনে যেটা কাজ করে, সেটা এক চরম নিরাপত্তার অভাব। অর্থ, কেরিয়ারের সাফল্য নিরাপত্তা দিতে পারছে না, যেখান থেকে তাঁরা একটু শান্তি ও সুস্থিতির সঙ্গে জীবন কাটাতে পারেন। সংকট কাটছে না কিছুতেই। যার অর্থের প্রয়োজন সেও অর্থের পিছনে ছুটছে, যার নেই, সেও ছুটছে। অর্থই অনর্থের মূল বলব না। কিন্তু অর্থ ছাড়াও আরামদায়ক জীবনযাপনের আরও কিছু উপকরণ দরকার। দয়া করে আরাম ও বিলাসিতার মধ্যে গুলিয়ে ফেলবেন না। আজকের শৈশব-কৈশোরের জীবনে বিলাসিতা আছে, আরাম নেই। বড়দের নিরাপত্তা বোধের অভাব তাদেরও আক্রান্ত করছে প্রতিনিয়ত। তাদের ব্যক্তিত্বের সঠিক বিকাশ কিছুতেই হতে পারছে না এর ফলে।

বৃহত্তর ঘর অর্থাৎ সমাজের কথা যদি বলি, সেখানে কৃত্তিকার স্কুল ও আরও অনেক এমন স্কুল আছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি ও পরিকাঠামোর উন্নতি একান্ত প্রয়োজন। স্কুলগুলি হয় বাণিজ্যের, নয় রাজনীতির পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। ছাত্রছাত্রীদের রেজাল্ট নিয়েই যত মাথাব্যাথা তাদের। একটি ছেলে বা মেয়ের প্রত্যেকটা দিন কিভাবে কাটে, সেটার খোঁজ রাখাও যে অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু স্কুলেই অনেকটা সময় থাকে ওরা, সেক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। আমরা আমাদের শিক্ষকদের ভয়-শ্রদ্ধা দুইই করতাম। ভালোও বাসতাম। তাঁরা সেই জায়গাটা করে দিয়েছিলেন। শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক সমন্বয় সবথেকে জরুরি এক্ষেত্রে।

অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থা। অহেতুক পড়ার চাপ। কেরিয়ার গঠন সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ও অবাস্তব কিছু থিওরি পরের প্রজন্মকে সামগ্রিক ভুল পথে পরিচালিত করছে। সরকারি-বেসরকারি স্তরে বিপুল পর্যায়ে এই নিয়ে এক গঠনমূলক, বাস্তবসম্মত পর্যালোচনা দরকার। সমাজ ও বেঁচে থাকার বিভিন্ন ব্যবস্থা ভুল পথে চালিত করছে সাধারণ মানুষকে। আর জীবনধারার সেই প্রভাব মানুষ প্রবাহিত করছে তার ঘরোয়া জীবনে। কৃত্তিকারা যে পরোক্ষে তারই শিকার হচ্ছে। আইন-প্রশাসন, আন্দোলন এর চিকিৎসা করতে পারবে না। অবস্থা এমন, যেন পুরো সমাজেরই এখন কাউন্সেলিং দরকার।

দেশের নীতি নির্ধারক থেকে ঘরের মানুষ, প্রতিটি স্তরের প্রত্যেক মানুষকে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে হবে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, ঠিক আছে তো আমার ভাবনা? ছোটদের যে দিশা দেখাব, আমি নিজে পথটা জানি তো? আত্মপ্রবঞ্চনা আর নয়। আজ প্রবলভাবে দরকার আত্মসমীক্ষা। আমরা বাঁচলে, বাঁচবে কৃত্তিকারা। আমরা মাটি তৈরি করে দিলে চারা গাছ হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। নাহলে এই অকাল ও যন্ত্রণার মৃত্যুমিছিল বন্ধ হবে না।

abetment of suicide
Advertisment