Advertisment

শাহিনবাগের দাদিরা লিখছেন ফেমিনিজমের চতুর্থ অধ্যায়

বেশির ভাগ মানুষ পিতৃতন্ত্র থেকে বেরোতে পারেন না। কিন্তু এই দাদিরা, এই হিজাব-পরা নারীরা পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ভয় পান না। বরং যুক্তির এবং শক্তির জোরে তাঁদের ভয় পায় রাষ্ট্রও।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
shaheen bagh dadi

প্রতীকী ছবি। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

দাদিরা গল্প বলেন। দাদিরা শুধু গল্পই বলেন না, নাতিপুতিদের রক্ষাও করেন। জ্যাঠাদের শাসনের হাত থেকে, বাবাদের রক্তচক্ষু থেকে। দুনিয়ার সর্বত্র বোধহয় এই এক নিয়ম। এবং দাদিদের মুখ থেকে শোনা গল্পগুলোও সব দেশে যেন একই রকম। আগের দিনে, খুব বেশি আগে নয়, এই তিন চার দশক আগে, দাদিদের যে প্রশ্নটা প্রায়ই করত নাতনি বা নাতিরা, তা হলো, "দাদি, আমার জন্ম কবে?" দাদিদের কেউ উত্তর দিতেন, "ওই যেবার বন্যা হলো, ধানের গোলার চাল অব্দি জল উঠে গেছিল, তার পরের মাসের লক্ষ্মীবার।" কেউ বলতেন, "সেই যে বার তিন-বগি ট্রেন চালু হলো, সেই শীতে তোমার জন্ম বোন।" ধাইমারাও মনে রাখতেন একই ভাবে। কারও কারও বাবা ডায়রিতে লিখে রাখতেন সন্তানের জন্মদিন, সময়। সবার সেই সৌভাগ্য অবশ্য হতো না।

Advertisment

দাদিরা গল্প বলে আগলে রাখতেন নাতনি-নাতির মানসিক ভূগোল। দাদিরা জেঠুদের বকে দিয়ে সন্তানদের রক্ষা করতেন মানসিকভাবে, দৈহিকভাবেও। হ্যাঁ, দাদিরাই। দাদুরা নন। এই বৃদ্ধ সাদা চুলের মাতৃতন্ত্র প্রশ্ন করত না পিতৃতন্ত্রকে, শুধু জানিয়ে দিত - এটা অন্যায়, এটা চলবে না।

আমাদের দেশে যে নাগরিক সংশোধনী আইন প্রবর্তন করা হয়েছে গত বছর, তা অসাংবিধানিক, অনৈতিক এবং অযৌক্তিক। এ কথা দাদিরা শুধু বুঝতে পারলেন এমন নয়, তাঁরা খুব গভীরভাবে অনুধাবন করলেন যে তাঁদের উত্তরসূরিদের যেভাবে এতদিন বাপ-জেঠুদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, এইবার তাদের রক্ষা করতে হবে রাষ্ট্রের হাত থেকে। কেন একজন পাকিস্তানি খ্রিস্টান আফগানিস্তানের ইহুদির তুলনায় ভারতে বেশি অধিকার পাবেন, সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স জানার প্রয়োজন পড়েনি দাদিদের। এটাও বুঝতে তাঁদের অসুবিধা হয়নি যে তাড়া খাওয়া তিব্বতি বৌদ্ধ কিংবা শ্রীলঙ্কার নির্যাতিত তামিল কেন ভারতে জায়গা পাবেন না, যেখানে পাকিস্তানের জরাথুস্ত্রবাদী অথবা আফগানিস্তানের বৌদ্ধ সেই সুযোগ পাবেন!

publive-image কলকাতার পার্ক সার্কাসের ধর্নামঞ্চে দিল্লির শাহিনবাগের এক দাদি, ৮২ বছরের বিলকিস। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

এমনই নাগরিক আইন ২০১৯। এই সব দাদিরা আমাদের পিতাদের গর্ভধারিণী। এবং তাঁরা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান, হিজাব কিংবা নিকাব পরে প্রবল ঠাণ্ডায় সব কাজ ফেলে রাজপথে নেমেছেন রাষ্ট্রের কালা কানুনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। এই আন্দোলনে তাঁরাই নেত্রী। এই নারীদের আন্দোলন এমন এক বিদ্রোহ, যা শুধু নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলছে না, এই আন্দোলন তৃতীয় লিঙ্গ থেকে প্রথম লিঙ্গ, সকলের অধিকারের কথা বলছে। হ্যাঁ, মুসলমান নারী-পুরুষ-অন্য লিঙ্গের কথাও বলছে। এই আন্দোলনকে তাই বলা হচ্ছে চতুর্থ প্রবাহের নারী আন্দোলন।

এই সব দাদিরা কিন্তু এমন আন্দোলনের নামও শোনেন নি। যে ভাবে পুরাণ বা লোকগল্প সারা পৃথিবীতে প্রায় এক রকমের, তেমনি এই আন্দোলনও। মনে পড়ে যায়, জানুয়ারি ২০১৯-এ বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশের মহিলারা সমান মজুরি, গর্ভের অধিকার, এবং হিংসার অবসানের দাবিতে পথে নেমেছিলেন। স্মরণে আসে, হংকং, লেবানন, সুদান, ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার রাজপথে তরুণীরা ছিলেন প্রতিবাদের পুরোভাগে।

এই আন্দোলন শুধু নারীদের ছিল না, ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে, যার সুফল পাবেন সকল শ্রেণির মানুষ। এই চতুর্থ প্রবাহের নারীবাদ বা ফোর্থ ওয়েভ ফেমিনিজম কখনই মনে করে না, অন্য বর্গের মানুষরা নির্যাতিত থাকবেন আর নারীরা শুধু নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। শাহিনবাগের দাদিদের কথাও তাই। নতুন নাগরিক আইন শুধু মহিলাবিরোধী নয়, কেবল মুসলমানবিরোধী নয়, তা হলো গরিব মানুষ, তৃতীয় লিঙ্গ, শিশু এবং ভারতে চলে আসা তিব্বতি বৌদ্ধ কিংবা শ্রীলঙ্কার তামিল হিন্দুদের স্বার্থেরও পরিপন্থী।

শাহিনবাগের এই আন্দোলনকে রাষ্ট্র যে ভয় পেয়েছে, তা স্পষ্ট। ভয় পেলে মানুষের কাণ্ডজ্ঞান যে লুপ্ত হয়, তখন কীভাবে সে হিংস্র হয়ে ওঠে, তা দিল্লির সাম্প্রতিক ঘটনা দেশবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দাদিরা জোর গলায় বলছেন, তোমরা আমাদের গচ্ছিত টাকা কেড়ে নিয়েছ নোটবন্দির নামে, তোমরা ভয় দেখিয়ে আমাদের আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি নিয়েছ আধার কার্ডে, তোমরা ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলিয়েছিলে ১৫ লক্ষ টাকা দেবে এই আশ্বাস দিয়ে, কিন্তু কিছুই দাওনি, বরং ব্যাঙ্ক আমাদের কারণে অকারণে রোজ নানা ছুতোয় টাকা কেটে নিচ্ছে; কাশ্মীরে যে অন্যায় করেছ, তা এখন সারা দেশে করতে চাও। আমাদের নাতি-নাতনিদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তোমরা তাদের সস্তার মজুর যে বানাতে চাও, সে কথা আমরা বুঝে গিয়েছি। আর নয়, রাষ্ট্রের এই দমন, পীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করো, নইলে আমরাও প্রতিবাদে অবরোধ চালিয়ে যাব, শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম অবজ্ঞা করে বসে থাকব রাস্তায়।

শাহিনবাগকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার শাহিনবাগ গড়ে উঠেছে সারা দেশে। এবং সেখানেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহিলারা। না, এই দেশের পুরুষদের উচিত এই দাদিদের কাছে ঋণী হওয়া। তাঁদের কাছে পুরুষরা যূথবদ্ধ নেতৃত্বের এক নতুন পাঠ গ্রহণ করতে পারেন। নারীদের যে সহজাত যুক্তির তেজ, সেই সাবলীলতা পুরুষকেও শেখাবে নতুনতর যুক্তিকাঠামো। বেশির ভাগ মানুষ পিতৃতন্ত্র থেকে বেরোতে পারেন না। কিন্তু এই দাদিরা, এই হিজাব-পরা নারীরা পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ভয় পান না। বরং যুক্তির এবং শক্তির জোরে তাঁদের ভয় পায় রাষ্ট্রও।

মনে রাখা ভালো, রাষ্ট্রও পিতৃতান্ত্রিক। সে চায়, এই দেশ হোক হিন্দু রাষ্ট্র। কে 'হিন্দু'? হিন্দুত্বের সংজ্ঞা কী? হিন্দু ধর্ম হলো এক বহুরৈখিক জীবনদর্শন - সেখানে বহু স্বর রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সেই বহু স্বর মানবে কেন! তার কাছে আছে গোলওয়ালকর থেকে সাভারকরের হিন্দুত্ব। তার হাতে রয়েছে মনুসংহিতা। এই হলো তার হিন্দুত্বের ধারণা। সেখানে নারী হলো নরকের দ্বার, শূদ্র অচ্ছ্যুত, তৃতীয় লিঙ্গ অভিশপ্ত, সেখানে অন্য ধর্মের লোককে ব্রহ্মবাদীরা রোষানলে পুড়িয়ে মারে।

দাদিদের আপত্তি এখানেই। আজ মুসলমানের উপর যে আঘাত হানতে বদ্ধপরিকর একটি গোষ্ঠী, কাল সে শূদ্রকে 'অপর' বানিয়ে নির্যাতন করবে, পরশু তার লক্ষ্য হবে নারী। শাহিনবাগের দাদিদের নেতৃত্বাধীন নারী আন্দোলন তাই প্রকৃত অর্থেই ফোর্থ ওয়েভ ফেমিনিজম, যাকে গ্রাহ্য না করলে রাষ্ট্র, একবিংশ শতকের রাষ্ট্র, আবার ফিরে যাবে অন্ধকারের যুগে।

(শামিম আহমেদ উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ লেখক তথা দর্শনের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment