বেশ কিছুদিন আগে যখন হানসাল মেহতা নির্মিত 'শাহিদ' ছবিটি প্রথম দেখেছিলাম, তখন কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না আমাদের দেশের ন্যায়ব্যবস্থা (justice system) ব্যাপারে। সময়ের সঙ্গে সে ধারণা কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে, এবং আজ দেখার আঙ্গিকও বদলেছে। ২০১৩ সালের ভারতবর্ষের সাথে আজকের ভারতবর্ষের কোনো মূলগত তফাৎ না থাকলেও, অভিব্যক্তির তফাৎ ক্রমশ দৃঢ় হয়েছে। ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, শুধুমাত্র এই গুণগত তফাৎ ছাড়া, আর বিশেষ কোনো তফাৎ বিগত প্রায় ৫ বছর তো বটেই, এমনকি ৩০ বছর ধরেই নেই। কিন্তু, এই তফাৎ আমাদের চোখে পড়ছে, আমরা মানে যারা শহুরে মধ্যবিত্ত, ট্যাক্স ও পেট্রোল এর দাম নিয়ে চিন্তিত। এছাড়া যে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল, সেখানে এই ফারাক চোখে পড়ার মতন নয়। মুক্ত-অর্থনীতির হাত ধরে দুর্নীতি আজ ঘরে ঘরে ঢুকে পড়লেও, নিপীড়নের ইতিহাস তো নতুন কিছু নয়। এই ইতিহাস বদলের লড়াইও কোনো নতুন বিষয় নয়, আগেও হয়েছে, পরেও হবে, গোটাটাই একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এবং, এই প্রক্রিয়ারই একজন অদম্য কর্মীর নাম, শাহিদ আজমি।
আইনজীবী শাহিদ আজমি ২০১০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি খুন হন, মাত্র ৩২ বছর বয়সে। মাত্র ৭ বছরের ওকালতি জীবনে, শাহিদ জিতেছেন ১৭টি ফৌজদারি মামলা। না, শুধু জামিন নয়, শাহিদের মক্কেলরা ছাড়া পেয়েছিলেন সমস্ত অভিযোগ থেকে। শাহিদ সবধরনের ফৌজদারি মামলা লড়তেন না। শাহিদ লড়েছেন সব থেকে কঠিন ফৌজদারি মামলাগুলো। শাহিদ লড়েছেন, কুখ্যাত মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অফ অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট, প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট জাতীয় বহু সমালোচিত আইনগুলোর বিরুদ্ধে, সেই আইনের গেরোয় আটকে থাকা আসামির পক্ষে। শাহিদ লড়েছেন, ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মুম্বাই শহরে যে যাবতীয় সন্ত্রাস-মূলক ঘটনা ঘটে তাতে ফেঁসে যাওয়া দরিদ্র স্বল্প-শিক্ষিত মুসলিম যুবকদের পক্ষে, শাহিদ এমনকী লড়েছেন, ২৬/১১'র মুম্বাই হামলার অন্যতম মূল অভিযুক্ত ফাহিম আনসারির হয়েও। মামলা করতে গিয়ে বারবার তিনি বলেছেন যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিনিও, কিন্তু, সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকবার মিথ্যে অভিযোগে, বিনা প্রমাণে, বিনা বিচারে, বছরের পর বছর জেলখানায় আটকে আছেন যে দরিদ্র স্বল্প-শিক্ষিত মানুষেরা, তিনি তাদের পক্ষে, তাঁর লড়াই তাদের জন্য, অন্য কিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে না।
না, সন্ত্রাসবাদীদের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের হয়ে ওকালতি করা তেমন একটা কঠিন হয়তো হত না, যদিনা শাহিদ নিজেই সেই অভিযোগে ৭ বছর জেল খেটে আসতেন ! ৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, আরো কয়েক হাজার মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ১৪ বছরের স্কুল ছাত্র শাহিদকেও গ্রেফতার করে মুম্বাই পুলিশ। জেলখানার অত্যাচার সহ্য করে জেল থেকে বেরোনোর পরে, স্কুলের পড়া শেষ করে শাহিদ রওয়ানা দেন কাশ্মীরের দিকে। লক্ষ্য বন্দুক তুলে নেওয়া, লক্ষ্য প্রতিশোধ, কারণ বুকে তখন রাগ ও দুঃখ, মাথায় তখন আগুন জ্বলছে বিনা দোষে শাস্তি পাওয়ার ক্ষোভে। ভুল ভাঙতে দেরি হয়না, শাহিদ পালিয়ে আসেন ও ধরা পড়ে যান পুলিশের হাতে, এবং ফেঁসে যান এক ঝুটা মামলায়। টেররিস্ট এন্ড ডিসরাপটিভ একটিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট, যা টাডা আইন নামে পরিচিত, তার বিরুদ্ধে শুরু হয় আরেক লম্বা আইনি যুদ্ধ। জেলখানাতে বসেই পড়াশুনো করেন শাহিদ, গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন জেলখানা থেকেই। শেষে ৭ বছর জেলে থাকবার পরে, সমস্ত অভিযোগ থেকে বিনা শর্তে মুক্তি পান, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট থেকে। এবং এখানেই মোড় ঘুরে যায়, তার জীবনের।
নিজের জীবনের শিক্ষা থেকে তিনি উপলব্ধি করেন, আইনি লড়াই কঠিন হতে পারে, অনেক লম্বা হতে পারে, পদে পদে তিনি হারতে পারেন, কিন্তু, শেষ অব্দি লড়তে পারলে, সাফল্য নিশ্চিত। শাহিদ আইন পড়া আরম্ভ করেন, এবং একজন স্বাধীন আইনজীবী হিসেবে নিজের ওকালতি জীবন শুরু করেন, ২০০৩ সালে।
নিজের জীবন থেকে শিখে ছিলেন হার-না-মানার শিক্ষা। অতএব, শাহিদ লড়ে গেলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দরিদ্রের পক্ষে, অসহায়ের হয়ে। বিরুদ্ধে সব বিশেষ বিশেষ আইন যার ফাঁক গলে বেরোনো, সির্ফ মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন। আমাদের দেশের বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে বেশিরভাগই এই সমস্ত বিশেষ আইনের অধীনে আটকে আছেন, এবং, কোনো প্রমাণ ছাড়াই জেলখানায় কেটে যাচ্ছে তাঁদের জীবনের অনেকটা সময়। কখনো ৭, কখনো ১৫ কোনো ২০ বছর পরে তারা বিনা শর্তে মুক্তি পাচ্ছেন, প্রমাণ হচ্ছে যে তাঁরা নির্দোষ। এই মানুষগুলো কখনও মুসলিম, কখনও সাঁওতাল আবার কখনও দলিত, এবং এঁরা সবাই মিলেই লড়ে চলেছেন এই অনন্ত লড়াই। এই লড়াইয়েরই আরেক যোদ্ধা শাহিদ। তাঁর সংগ্রামমুহূর্তে তিনি পাশে পেয়েছিলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন সহকর্মী আর কিছু মানবাধিকারকর্মীদের। ২০০২ সালে মুম্বাইয়ের একটি বাসে বিস্ফোরণ হয়, এবং যথারীতি বেশ কয়েকজন নিরপরাধ মুসলিম যুবক গ্রেফতার হন কুখ্যাত প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট বা (POTA)-র অধীনে। শাহিদ এঁদের হয়ে মামলা লড়েন বিনা পারিশ্রমিকে। আদালত রায় দেয় যে পুলিশের হাতে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই, অভিযুক্তরা সকলে একযোগে নির্দোষ প্রমাণিত হন ও মুক্তি পেয়ে যান। এই মামলার ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীতে প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার। এভাবেই একের পর এক বিখ্যাত, এবং মতান্তরে কুখ্যাত মামলায় জিততে থাকেন শাহিদ, নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পেতে থাকেন বহু নিরপরাধ সাধারণ দরিদ্র মানুষ। অনেকবার প্রাণঘাতী হামলা, হুমকি ইত্যাদির সামনে পড়েছেন, কিন্তু হাল ছাড়েননি। শাহিদের শেষ মামলা ছিল ২৬/১১'র মুম্বাই বিস্ফোরণে মূল অভিযুক্তদের একজন ফাহিম আনসারির হয়ে। এই মামলা চলাকালীনও বহুবার তাঁর ওপর আক্রমণ হয়, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি, লড়ে গেছেন। ১১ ফেব্রুয়ারির রাতে, ৪ জন দুষ্কৃতীর গুলিতে তিনি খুন হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ন্যায়ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর স্বপ্ন অটুট ছিল।
শাহিদের মৃত্যুর আড়াই বছর পরে, ওই মামলায় অভিযোগমুক্ত হন ফাহিম আনসারি। তাঁকে মুক্তি দেয় শীর্ষ আদালত। উচ্চতম আদালতে প্রমাণিত হয় যে পুলিশের কাছে ফাহিমের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণই ছিল না। মৃত্যুর পরে আরও একবার জিতে যান শাহিদ। উল্লেখ্য, শাহিদের খুনের মূল অভিযুক্তকে পুলিশ নানান টালবাহানার পর গ্রেফতার করে ঘটনার ১ বছর পরে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ খুন পূর্বপরিকল্পিত নয়, ডাকাতি করতে এসে ঘটনাক্রমে খুনের ঘটনা ঘটে গেছে। শাহিদ হত্যায় অতএব কোনও ষড়যন্ত্রের হদিশ পাওয়া যায় না, এবং একমাত্র ধৃত ব্যক্তি জামিনে মুক্ত।
যে প্রশ্ন একজন আইনজীবী হিসেবে আমাকে শুরু থেকেই ভাবাচ্ছে, তা হল, এই খুন হয়ে যাওয়া শহিদ, শাহিদ আজমি কি একা? আমাদের দেশের ন্যায়ব্যবস্থা, যেখান থেকে এই লেখার সূত্রপাত, সেই ব্যবস্থার অংশ হয়ে বা, না হয়ে, আরো বহু শাহিদ কিন্তু লড়ে যাচ্ছেন, ভারতবর্ষের নানান অঞ্চলে, এবং প্রধানত গ্রামাঞ্চলে। সেই লড়াই কখনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক গুন্ডাদের বিরুদ্ধে, কখনো বা পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে আবার কখনো তা রূপ নিচ্ছে, ব্যবস্থা বিরোধিতার। কোন ব্যবস্থার বিরোধিতা? যে ব্যবস্থা নিষেধ করে এই লড়াই লড়তে, যা, মানুষের ন্যূন্যতম সাধারণ অধিকারের দাবিকে অস্বীকার করে, যা গণতন্ত্র বলতে শুধুমাত্র ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আংশিক যোগদান বোঝায়, বা যা বিবিধ আইন-স্বীকৃত পদ্ধতিকে নিজেরাই অস্বীকার করে। এই সিস্টেম কে চ্যালেঞ্জ করছে যে বা যারা, আজ আসুন, এই স্বল্প পরিসরে, তাদের কথাও অল্প কিছু জানি।
প্রশান্ত ভূষণ, ইন্দিরা জয়সিং, আনন্দ গ্রোভার, মেহমুদ প্রাচা, বৃন্দা গ্রোভার, কলিন গঞ্জালভেজ, কামিনী জয়সওয়াল, বা, রাজু রামচন্দ্রনদের কথা তো আমরা অনেকেই জানি। বিভিন্ন বহুলচর্চিত মোকদ্দমায় এঁরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে মনে পড়ছে, ইশরাত জাহান ও ইয়াকুব মেননের বিচার-প্রক্রিয়া। যেখানেই, বিচারপ্রক্রিয়া সংক্রান্ত কোনো গোলযোগ থাকবার সম্ভাবনা দেখা যায়, বা, ন্যায়বিচার প্রশ্নের মুখে পড়ে, সেখানেই, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সামনে, বিচারপ্রার্থীর হয়ে সওয়াল করতে এনারা নির্দ্বিধায় হাজির হয়ে যান। কিন্তু, কোনও মামলা সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছনোর আগে, তার সব থেকে কঠিন স্টেজ, অর্থাৎ, ট্রায়াল কোর্ট, বা, প্রাথমিক ন্যায়ালয়কে পেরিয়েই আসতে হয়, এবং, নিজের স্বল্প অভিজ্ঞতায় জানি, সব থেকে বড় ভুলগুলো, ওই প্রাথমিক স্তরেই হয়ে যায়, যা পরে আর বদলানো যায়না, এবং, বিনা দোষে সাজা পান বহু নিরপরাধ মানুষ। সম্প্রতি, ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের মামলা নিয়ে হওয়া সিনেমাতে আমরা এমনটাই দেখেছি।
এবং এই কারণেই, আমার ধারণায়, সেই আইনজীবীরা, যাঁরা ওই প্রাথমিক ন্যায়ালয়ে, সাক্ষীগ্রহণ প্রক্রিয়ায়, নিরপরাধ অভিযুক্তের পক্ষে লড়েন, তাঁদের কৃতিত্ব অনেক অনেক বেশি। যে পরিকাঠামো এবং ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে তাঁদের দৈনন্দিন লড়াইটা করতে হয়ে থাকে, তাকে স্যালুট জানানো ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই। এরা প্রত্যেকেই এক একজন শাহিদ আজমি !
মিয়াঁ আব্দুল কায়ুম, জম্মু-কাশ্মীর বার এসোসিয়েশনের উনিশ বারের প্রেসিডেন্ট। গোটা উপত্যকা জুড়ে আফস্পা সংক্রান্ত মামলাগুলি উনি বিনা খরচে লড়ে থাকেন। আফস্পা তৈরি হওয়ার আগেই, সেই সত্তরের দশক থেকেই তিনি লড়ে যাচ্ছেন, সেই সমস্ত মানুষের জন্য যারা বিনাবিচারে বছরের পর বছর সাজাপ্রাপ্ত। স্বাভাবিকভাবেই, রাষ্ট্রের চোখে, তিনি শত্রু, এবং আরো স্বাভাবিক ভাবেই, কয়েকবার তাঁকে আটকও করা হয়, সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করার অভিযোগে। সেসব অভিযোগ যে ধোপে টিকবে না তা মোটামুটি সকলেরই জানা ছিল, প্রতিবারই মুক্তি পান তিনি। কায়ূমকে হত্যার চক্রান্তও হয়েছে, আদালতচত্বরেই তাঁর ওপর গুলি চলেছে, এবং অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, পুলিশ সে অভিযোগের ন্যূন্যতম তদন্ত করতেও অস্বীকার করেছে। এ সব সত্ত্বেও তিনি লড়ে যাচ্ছেন, আজও, এখনো। এবং বারবার জিতে যাচ্ছেন বার এসোসিয়েশনের নির্বাচনেও। প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট থেকে শুরু করে, টাডা হয়ে, এখন তাঁর যুদ্ধ আফস্পার বিরুদ্ধে। সিনেমার মতন জীবন তার, আর সিনেমার মতনই লড়াই। ‘জীবনের মায়া করেন না কেন’, জানতে চাইলেই উত্তর মিলবে, ‘এটাই তো আমার জীবন’ !
একা নন কায়ুম সাহেব, একদল আইনজীবী একই ভাবে লড়ে যাচ্ছেন ছত্তিশগড়ের জাগদলপুরে। 'জাগদলপুর লিগাল এইড গ্রুপ' নামের একটি নন-প্রফিট ছাতার তলায় তাঁরা জড়ো হয়েছেন, মাওবাদী সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া অসংখ্য আদিবাসী মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়ার লক্ষে। এঁদেরই একজন, শালিনী গেরা। ২০১৫ সালে বাসে সুখমা থেকে জাগদলপুরে ফিরছিলেন তিনি। আচমকা পুলিশ সেই বাস থামায়, ও 'ছোট চুলের সন্দেহজনক এক মহিলার' খোঁজ করতে থাকে, শালিনী গ্রেফতার হন। শালিনীর জামিনের পর, ওই সংগঠনের প্রায় প্রত্যেকের ওপর নজরদারি চালাতে থাকে পুলিশ, এবং তাতেও কাজ না হওয়ায়, অদ্ভুত ভাবে এক নতুন নিয়ম চালু করা হয়। এই নিয়মানুসারে যেহেতু তাঁরা জাগদলপুরের বাসিন্দা নন, সেহেতু, সেখানকার আদালতে তাঁরা কাজ করতে পারবেন না। এবং, এই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও, বিভিন্ন ভাবে, নানান মিথ্যা মামলা থেকে তারা বেকসুর মুক্তি দিয়েছেন, বহু মানুষকে। আজ ওই অঞ্চলে, সনি সোরির মামলার পর থেকেই, ঈশা খাণ্ডেলওয়াল, গুণীত কৌরের নাম তাই প্রায় সকলেরই জানা।
গল্পটা আলাদা নয় অন্ধ্রপ্রদেশ বা তেলেঙ্গানাতেও। চিক্কুডু প্রভাকর, বা বেল্লা রভিন্দ্রনাথ কাজ করেন তেলেঙ্গানা ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে। নিরপরাধ মানুষদের আইনি সহায়তার দেওয়ার লক্ষে, এই মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে তাঁদের নিয়মিত যাতায়াত লেগেই থাকে। এরকমই একবার, তেলেঙ্গানা ও ছত্তিশগড়ের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে তাঁদের হঠাৎই গ্রেফতার করা হয়, মাওবাদী অভিযোগে এবং, তারপর দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়াতে ফাঁসিয়েই দেওয়া হয় প্রায়। অভিযোগ? ওই, বিনা অপরাধে, মাওবাদী সন্দেহে আটক মানুষদের আইনি সহায়তা দেওয়া।
অবাক লাগছে, আইনজীবীরাই যদি এই সমস্যায় পড়েন, তাহলে ন্যায়বিচার কীভাবে হবে? অবাক হবেন না, প্রভাকর গোওলের গল্প তো এখনো বলা বাকি। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে উঠে আসা এই মানুষটি, আইন পড়ার পরে ১০ বছর ছত্তিশগড়ে একজন আইনজীবী হিসেবেই কাজ করছিলেন, এবং ২০০৬ সাল থেকে তিনি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। দুর্নীতি সংক্রান্ত একের পর এক মামলায় রায়দান করবার 'পুরস্কার' হিসেবে তিনি শেষমেষ স্থানান্তরিত হন, বস্তারে। অল্প দিনের মধ্যেই, নির্বিচারে ভুয়ো সংঘর্ষ ও ভুয়ো গ্রেফতারির মামলায় পুলিশের বিরুদ্ধে রায়দান করেন। তাঁর এই অসীম সাহস সহ্য করা মুশকিল হয়ে ওঠে সরকারের পক্ষে এবং তাই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ২০১৬ সালে তাকে প্রথমে দূরভাষের মাধ্যমে ও পরে অফিসিয়াল চিঠি দিয়ে বরখাস্ত করে, ছত্তিশগড় সরকার। কী কারণে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে তা আজাবধি তিনি জানেন না। ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, আদালতে তাঁর আবেদন আজও স্থগিত রয়েছে।
পাঞ্জাব থেকে, বাংলা, আসাম, ওড়িশা, বিহার, জম্মু-কাশ্মীর, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, রাজস্থান, গুজরাট, তামিলনাড়ু পর্যন্ত ছবিটা একই। কোথাও এই শ্রেণির মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর অভিযোগে আইনজীবীরাই গ্রেফতার হয়ে যাচ্ছেন, কোথাও বা খুন হচ্ছেন অজানা কোনো আততায়ীর হাতে, কোথাও আবার তাঁদের প্রচ্ছন্ন হুমকির সামনে পড়তে হচ্ছে বারবার। ওই প্রাথমিক বিচার প্রক্রিয়ায় তারিখের পর তারিখ পড়ছে, অভিযুক্তদের ১৫-২০ বছর পরে মুক্তি ঘটছে। ন্যায়বিচারের জন্য হাহুতাশ আমরা সিনেমায় দেখে থাকি বটে, কিন্তু বাস্তব আরও ভয়ঙ্কর। মাওবাদী বা সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে, বহু বছর কারাগারে আটকে রাখার পর, যে মুক্তি ঘটছে, তাতে আদৌ কারও কোনও সুরাহা হচ্ছে কিনা, সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ, আমরা জানি, 'জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড'।
এই সমস্ত আইনজীবীরা, যাঁরা প্রায় জীবন উৎসর্গ করে, নিরপরাধ, গরিব, বঞ্চিত ও নিপীড়িত শ্রেণির পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, ও শাসক, বা সরকারের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছেন একটি অসম লড়াই, তাঁদের নিয়েই এই লেখা। শাহিদরা মারা যান, কিন্তু, শহিদরা মারা যান না, তারা বেঁচে থাকেন, এভাবেই, অনেকের মধ্যে। ওই যে বললাম, আবার জিতে যান শাহিদ আজমি। শহিদরা এইভাবেই বারবার জিততে থাকেন !