বেলভিউতে যখন সৌমিত্র ভর্তি হলেন তখন খবর আসে আমার কাছে। পরের দিনগুলো শুধুই উৎকন্ঠার। তবে শেষের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। লড়াই জিতে ফিরবেন সেই আশাতেই দিন কাটিয়েছি। ফোনের স্ক্রিনে যখন মেসেজটি এল, 'সৌমিত্রদা আর নেই'। আমি নির্বাক হয়ে গেছিলাম। ঠিক কী ক্ষতি হল, কতটা ক্ষতি হল তা বোঝার সব ক্ষমতা যেন মুহুর্তে লোপ পেয়েছিল।
'অপু' চলে গেলেন। এরপর শুধু ফোন। একের পর এক ফোন এসে চলেছে মিডিয়ার। আমার কী প্রতিক্রিয়া তা জানতে। খুব স্বাভাবিক সেটা কিন্তু ক্ষতির খতিয়ান দেওয়ার ভাষা আমার নেই। অপু আর অপর্ণার অবিস্মরণীয় অনস্ক্রিন রোম্যান্সে মুগ্ধ হয়েছিল সব দর্শক। আজও একইভাবে প্রাসঙ্গিক। অপর্ণাকে ছাড়া অপুকে ভাবা যায় না।ছবিতে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় অপর্ণার। কিন্তু গোটা সিনেমায় অপর্ণাকে একসঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন অপুই।
বর্তমানের দিকে যখন তাকাই দেখি কেবল ব্যস্ততা। শুধু সংবাদে যে তাড়াহুড়ো তা নয়, সবকিছুতেই। এই প্রেক্ষাপটে 'বন্ধুত্ব' বাঁচিয়ে রাখা খুব কঠিন। একটি ছবিতে কাজ করার সময় খুব ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব হচ্ছে আবার ছবি শেষ হয়ে পরের প্রজেক্টে যাওয়া মানে সেই তৈরি হওয়া বন্ধুত্বের সুতোয় টান। ক্রমশ বিবর্ণ হতে শুরু করে বন্ধুত্বগুলি। ব্যস্ততার সঙ্গে বন্ধুত্ব যেন ব্যস্তানুপাতিক। কিন্তু এ সবটাই সহ্য করেছিল 'সৌমিত্র-শর্মিলা' জুটি। তাই হয়ত থেকে গিয়েছিল, রয়ে গেল সেই উজ্জ্বল স্মৃতি।
অপুর সংসার আমাদের প্রথম ছবি একসঙ্গে।তখন আমার বয়স ১৩ এবং সৌমিত্র ২৩ বছর। ইউনিটে আমিই সবার ছোট ছিলাম। তাই সত্যজিৎ রায় মানিকদা হয়ে গিয়েছিলেন আমার কাছে, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট দুর্গা দা, ডিওপি সুব্রত কাকু হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সৌমিত্র চ্যাটার্জি- কেবল সৌমিত্র ছিলেন। যার সঙ্গে আমি গল্প করতে পারি, অনেক কথা ভাগ করে নিতে পারি। পরে বুঝতে পেরেছি সবার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার এই অনন্য গুণ ছিল সৌমিত্ররই।
অরণ্যের দিনরাত্রি ছবির স্মৃতিগুলি আমার কাছে খুব উজ্জ্বল। আমরা বিহারের পালামৌ অঞ্চলের একটি বনের ছোট্ট শহরে শুটিং করছিলাম। এপ্রিল মাস, মারাত্মক গরম ছিল। আমরা ভোরে প্রায় তিন ঘন্টা এবং তারপরে আবার সন্ধ্যায় তিনঘন্টা করে কাজ করেছি। আর মাঝের সময়টা শুধু আড্ডা। রবিদা ছিলেন মজার মানুষ। সবার একটা করে নাম দিয়েছিলেন। রবি পোড়া, শমিত ভাপা, শুভেন্দু ভাজা। পুলিশ পোস্ট থেকে অনেকটা দূরে ছিলাম বলে দেহরক্ষী ছিল না। কিন্তু একবার বেশ কয়েকজন এসে উপদ্রব করছিল। সৌমিত্র আরও কয়েকজন ওদের তাড়িয়ে দেয়। সেই সব স্মৃতি আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আজ আমার এই প্রিয় মানুষেরা সকলেই প্রায় চলে গিয়েছে। কাবেরী দি, রবি দা, শমিত, শুভেন্দু, মানিকদা আর এখন সৌমিত্র। সেই সব স্মৃতি যাপনের আর কেউ রইল না। 'আবার অরণ্যে' শুটিংয়ের সময় দেখেছি সৌমিত্র ওঁর নাতি-নাতনীদের জন্য কবিতা লিখত। সেগুলো শোনাতও আমাকে। আমি কী বলি তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। সেই হাসি, দীপ্ত চেহারা সবসময় মনে করায় ভীষণ পরিবার প্রিয় মানুষ ছিলেন সৌমিত্র।
থিয়েটার, শিল্প, খেলাধুলা, রাজনীতি, দর্শন, গসিপ সৌমিত্র অনন্য। আমি অবশ্যই সেখানের নীরব শ্রোতা। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গিয়েছে। ব্যক্তিত্ব, রসবোধ, মূল্যবোধ আমাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি ছিল এগুলিই। সৌমিত্র সবসময়ই আদর্শে অবিচল ছিলেন। যত দিন যাচ্ছে এমন মানুষই বিরল হয়ে পড়ছেন।
১৫ নভেম্বর কলকাতা যখন কবিতা, ফুল, গান, চোখের জলে বিদায় দিচ্ছিল সদা বিনয়ী মানুষটিকে, আমি অবাক হয়নি। সৌমিত্র কখনই 'অতীত' হতে পারেন না। তিনি সবসময়ের। ৬০ বছরের বন্ধুত্ব ছিল আমাদের। সৌমিত্রর চলে যাওয়া তাই কতটা ক্ষতির তা সংখ্যায়, ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। রবি ঠাকুরের কথায় তাঁকে স্মরণ করে বলব-
'জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে'
অনুবাদক- পল্লবী দে
Read the story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন