ঘটনাস্থল দিল্লির হায়দরাবাদ হাউস। ব্রিটিশ স্থপতি স্যার এডউইন লাটইয়েন্স (Edwin Lutyens) যখন নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লক, এমনকী রাষ্ট্রপতি ভবন নির্মাণ করছিলেন, তখন হায়দরাবাদের নিজামেরও সাধ হয় লাটইয়েন্সকে দিয়ে রাজধানীতে একটি অট্টালিকা নির্মাণ করানোর। সেটি হবে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওসমান আলি খান ছিলেন শেষ নিজাম। তিনি স্যার লাটইয়েন্সকে অনুরোধ করেন, যাতে তিনি প্রায় নয় একর জমির ওপর একটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন। পাশেই বরোদা হাউস, যা এখন উত্তর ভারতের রেলওয়ে বিভাগের সদর দপ্তর। কাছাকাছি আছে বিকানেরের রাজার বাড়ি।
১৯২৬ সালে শুরু হয় এই বাড়ির নির্মাণ। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই সব রাজবাড়ি এবং নিজাম হাউস ভারত সরকার নিয়ে নেয়। এখন হায়দরাবাদ হাউজে পৃথিবীর সমস্ত মান্যগণ্য রাষ্ট্রপ্রধানেরা আসেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের বৈঠক, ভোজসভা, সব হয় এই হায়দরাবাদ হাউজেই। এই বাড়িতে আছে ৩৬ টি বড় বড় ঘর। আর ছিল এক বিরাট 'জেনানা'। জেনানা বলা হতো বাড়ির সেই অংশকে, যেখানে থাকতেন শুধু মহিলারা। স্বাধীনতার পর বিদেশ মন্ত্রক এই অংশটিকে ভোজন কক্ষে রূপান্তরিত করে।
শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকটি হলো একতলার চিত্তাকর্ষক একটি ঘরে। সেই ঘরে প্রতিনিধি দলের সদস্যরাও ছিলেন দু'পক্ষেরই। মধ্যাহ্নভোজনের নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর একটা, কিন্তু আমি একটু আগেই চলে গেলাম। সাংবাদিকের স্বভাব, গিয়ে দেখি কী হচ্ছে ঘরের ভেতর। দেখলাম, দু'পক্ষেরই যাকে বলে মুড খুব ভালো। টেনশন নেই।
অথচ একথা কিন্তু ঠিক যে এবার হাসিনা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যখন দিল্লি এলেন, তখন বেশ কিছু বিষয়ে ঢাকার উদ্বেগ সঙ্গে নিয়েই এসেছেন। ২০১৭ সালের পর এটিই হাসিনার প্রথম ভারত সফর। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে তিনি নিজভূমিতে পীড়িত। আশা করছেন, ভারত এ ব্যাপারে আরো সক্রিয় সমর্থন দেবে। আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়েও বাংলাদেশের মানুষের অনেক প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় কথা, তিস্তা চুক্তির কী হবে? ২০১০ সালে সচিব পর্যায়ে এই চুক্তি হয়ে গিয়েছিল, তার পর ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিলতায় সে চুক্তি কার্যকর করা সম্ভব হয় নি।
তাহলে হাসিনা এবং তাঁর প্রতিনিধি দল এত খুশি কেন? যা জানতে পারলাম, সেটা আপনাদের জানাই। বিদেশ মন্ত্রী জয়শঙ্কর ঢাকা গিয়েছিলেন, এবং সেখানেই আসল হোমওয়ার্কটা করেছিলেন। মোদীও আশ্বাস দিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের বৈঠকে, নাগরিকপঞ্জি বা কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, দুটিই কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দ্বিতীয়ত, এবার বৈঠকে আর্থিক উন্নয়নের ব্যাপারে দু'দেশের মধ্যে অনেকগুলি চুক্তি হয়েছে, যা বাংলাদেশ ও ভারত দু'পক্ষকেই বিপুল সাহায্য করছে। কিন্তু আর্থিক বিষয়ের পাশাপাশি হাসিনা আর একটি কূটনৈতিক রণকৌশল গ্রহণ করেন। সেটি হলো, দু'দেশের মধ্যে তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি নাও হতে পারে, যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা ইস্যু নাও থাকতে পারে, কিন্তু বৈঠকে প্রকাশ্যে বিষয়গুলি উত্থাপন করল বাংলাদেশ।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করে সেকথা জানিয়েও দিলেন। দুপুরে খাওয়ার সময় মোদী-হাসিনা চুটিয়ে আড্ডা মারলেন। হাসিনা যে এত ভালো হিন্দি বলতে পারেন, জানতাম না। কথা হচ্ছিল হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে। এখন ভারতে হিন্দুদের দুর্গাপুজোর সময়, উত্তর ভারতে নবরাত্রি। মোদী তো উপবাস করেন এ সময়ে, শুধু ফলের রস খেয়ে থাকেন তিনি।
সপ্তমীর দিন হায়দরাবাদ হাউজে গিয়ে কাজ করছি, এমন অভিজ্ঞতা আমার জীবনে প্রথম, যদিও গিয়ে বাংলায় অনেকক্ষণ আড্ডা মেরে ভালো লাগল। ভেবেছিলাম, মেনুতে ইলিশ থাক বা না থাক, মাছ থাকবে। না, মেনুতে আদৌ আমিষ ছিল না। নিরামিষ খাবার অবশ্য দারুণ ছিল। ছোট ছোট লুচি, বেগুন আর পটল ভাজা, ধোকার ডালনা, মোচার চপ, ইত্যাদি ইত্যাদি। সব মিলিয়ে কাজের পরিবেশ ছিল।
রেল প্রকল্প, বিমান পরিষেবা, গ্যাস সংযুক্তি। বাংলাদেশ থেকে রান্নার গ্যাস ভারত আমদানি করবে উত্তর পূর্বাঞ্চলে। আদানি এসেছিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রকল্প করছেন। স্পাইস জেটের মালিক অজয় সিং ছিলেন। ঢাকায় পরিষেবা চালু করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ছিলেন। উপকূলবর্তী নজরদারির জন্য দুই দেশে রাডার বাবস্থা করছেন।
সব মিলিয়ে বলতেই হবে, শেখ হাসিনার এবারের সফর সফল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দিল্লি আসার একদিন আগে হাসিনাকে ফোন করে জানতে চান, তাঁর শরীর কেমন আছে। হাসিনা বাংলাদেশ হাই কমিশনে যে রিসেপশন দেন, সেখানেও দিল্লিতে কর্মরত অ্যাক্টিং পাক হাই কমিশনার এসে ছিলেন। ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। ভারত কিন্তু এ সফরে বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের কূটনৈতিক গুরুত্ব কেন আজ এত বেশি। বিদেশ মন্ত্রী জয়শঙ্কর ঢাকা গিয়ে তড়িঘড়ি হাসিনাকে বলে এসেছেন, উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। ভারত এমন কিছু করবে না যাতে ঢাকার সমস্যা হয়। হাসিনা সরকারও জানিয়ে দিয়েছে, আসাম থেকে একজনকেও বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ সরকার এদের বাংলাদেশী বলে মনেই করছে না।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঢাকা মানবতাবাদী অবস্থান নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। উল্টে ভারত সরকার ওই বোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীদের পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছে। কাজেই এখন হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন। তবে একটা বিষয় বুঝতে হবে, এনআরসি'র ঘটনায় হাসিনা সরকার ক্ষুব্ধ। শেখ হাসিনা এবার সেটা জানিয়েছেন মোদীকে, তবে ঠিক এভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া অবৈজ্ঞানিক। বুঝতে হবে, বাংলাদেশের জনসমাজ ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস যদি ভারত আবার হারায়, তাতে যদি হাসিনা সরকার-বিরোধী জনমত তীব্র হয়, যদি পাকিস্তান-পন্থী উগ্রপন্থীরা তার সুযোগ নেয়, তাতে ভারতের লাভ কী? পাকিস্তান যে এই সমস্যায় জামাতদের মদত দেবে, এ তো একটা বাচ্চা ছেলেও বলে দেবে।
যে ১৯ লাখের বেশি বাসিন্দাদের নাম বাদ গেল, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বিদেশি ট্রাইবুন্যালে আবেদন করতে হবে, সামনে রয়েছে দীর্ঘ আইনি লড়াই। ভারত এবার আশ্বাস দিয়েছে, নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ঢাকার সমস্যা হবে না। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের বক্তব্য, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, তাই আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করব না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমিনা মহসীন কিন্তু বলেছেন, বাংলাদেশের এখনই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার এবং প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
একটা কথা বলি, ভারত এখন পাকিস্তানের সঙ্গে কার্যত সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ। সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘে পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান বিরোধের ছায়া পড়ছে। কাশ্মীর নিয়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে তুলকালাম চলছে। এখন পাকিস্তান দুনিয়ার সামনে একেবারে হেরে গিয়ে কাশ্মীরে নাশকতামূলক কাজকর্ম করার জন্য মরিয়া। চীন-পাকিস্তান অক্ষ ভাঙা কঠিন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড করাটা কিন্তু ভূল কূটনীতি। ভারত সেটাই হাসিনাকে জানিয়েছে - ঢাকাকে আজ ভারতের প্রয়োজন।