ধর্ম বনাম মানবতা: মৌলবাদের রক্তবীজে আক্রান্ত আমরা

মৌলবাদীদের সুবিধা হল, তাদের কোনওভাবেই যুক্তিসাপেক্ষ হতে হয় না। মানুষের অচলায়তনীয় ধর্মবিশ্বাসের সুযোগটি তারা নিঃশেষে নেয়।

মৌলবাদীদের সুবিধা হল, তাদের কোনওভাবেই যুক্তিসাপেক্ষ হতে হয় না। মানুষের অচলায়তনীয় ধর্মবিশ্বাসের সুযোগটি তারা নিঃশেষে নেয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

শুজাত বুখারি এবং অন্যান্য সাংবাদিক হত্যার প্রতিবাদে কলকাতার পথে সাংবাদিকদের মৌন মিছিল। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

গৌতম ঘোষদস্তিদার

Advertisment

মৃত্যুর একঘণ্টা আগেও একটি টুইটে কাশ্মীরে মানবাধিকারের কথা বলেছিলেন সাংবাদিক-সম্পাদক শুজাত বুখারি। দীর্ঘদিন ধরেই এমন বলছিলেন তিনি। না জঙ্গি, না সরকার, কেউই কর্ণপাত করেনি তাতে। তিনবার কোনওক্রমে রক্ষা পেয়েছিলেন। চতুর্থবার কর্মক্ষেত্রের বাইরে খুন হয়ে গেলেন প্রতিবাদী সাংবাদিক। সাংবাদিকতা কেবল তাঁর পেশা ছিল না। তা হয়ে উঠেছিল কাশ্মীরিয়াত এবং মানবাধিকার-রক্ষার বলিষ্ঠ মাধ্যম। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের মনে পড়ে কর্নাটকের বিদ্রোহী-সাংবাদিক-সম্পাদক গৌরী লঙ্কেশকে। তাঁর পত্রিকার নাম ছিল ‘লঙ্কেশ’। রামরাজত্বে রাবণের নামে পত্রিকার প্রকাশনের মূল্য চোকাতে হয়েছে জীবনের বিনিময়ে।

সম্প্রতি একইভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের ব্লগার-লেখক শাহজাহান বাচ্চু। তিনিও মৌলবাদবিরোধী লেখালিখিতে নিয়োযিত ছিলেন। মনে হয়, তিনটি খুনই করেছে যেন একই আততায়ী, একটিই স্থিরলক্ষ্য বুলেটে যেন বিদীর্ণ হয়েছে তিনজনের দেহ। যেন সকলের খুনির নামই নাথুরাম গডসে, মেজর ডালিম, ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমর, হাফিজ সৈয়দ বা আজমল কাসব। কেননা দেশকালভেদে তিনজনই সরব হয়েছিলেন হিংসাদীর্ণ কূটনীতি-রাজনীতির বিরুদ্ধে। এরকম কোনও মৃত্যুকেই তাই আলাদা করা অসম্ভব।

শুজাত বুখারির উপর আগেও তিনবার হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। প্রতিবারই ঘটনাচক্রে রক্ষা পেয়েছেন দুঃসাহসী সাংবাদিক। ২০০৬ সালে তাঁকে অপহরণ করার পরে দু-জন পুলিশকর্মীকে নিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁর নিরাপত্তায়। তবু, বারো বছর পরে, জঙ্গিদের আক্রমণ থেকে বাঁচলেন না তিনি। বুখারির মৃত্যুর পরে সন্দেহের তির স্বাভাবিকভাবে লস্কর-ই-তৈবা বা জইশ-ই-মহম্মদের দিকে ঘুরলেও, অস্বাভাবিকভাবেই কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীই হত্যাদায় স্বীকার করেনি। অন্যদিকে, কাশ্মীরে সরকারি দমননীতির ঘোর সমালোচক ছিলেন বুখারি। কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বারবার সরব হয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে আলোচনাই একমাত্র পথ। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে সরকার সেনাবাহিনীকেই কাশ্মীরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা করেছে। সামরিক আগ্রাসনের মাত্রা হয়েছে তীব্রতর। সাধারণ মানুষকে সেনাবাহিনী দেখছে শত্রুর মত।

Advertisment

আরও পড়ুন: ন'ভোল্টের ব্যাটারি কিনে ২৭ বছর জেলে

কাশ্মীরিদের কাছেও জঙ্গিদের তুলনায় সেনাবাহিনীই এখন বড় শত্রু। জঙ্গিদের প্রতি যদি তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন তৈরিও হয়ে থাকে, সেজন্যও অনেকটাই দায়ী বাহিনী। আসলে, বিশেষ সেনা আইনের জোরে বাহিনী সেখানে কায়েম করেছে প্রায়-সমান্তরাল প্রশাসন। সেনাবাহিনীর মোকাবিলায় আবালবৃদ্ধবনিতার পাথরনিক্ষেপ-অভিযানের জন্যও বাহিনীর নাগপাশ অনেকটাই দায়ী বলে মনে করেন ওয়াকিবহাল মহল। বিশেষত, ২০১৬ সালে বুরহান মুজাফ্‌ফর ওয়ানির মতো জনপ্রিয় তরুণ ‘স্বাধীনতাযোদ্ধা’ (আদতে হিজবুল-মুজাহিদিনের কমান্ডার) সেনাবাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত সঙ্ঘর্ষে মারা যাওয়ার পরে জনমানসে সেনার ভাবমূর্তি তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। সেনাদের বিরুদ্ধে সাজানো সঙ্ঘর্ষ বা ধর্ষণের অভিযোগও কম নয়।

publive-image সেনা-সিভিলিয়ান সংঘাত মারাত্মক রূপ ধারণ করছে কাশ্মীরে (ফাইল চিত্র)

বুখারি এই আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছেন চিরকাল। নরেন্দ্র মোদীর আমলে যে কাশ্মীরনীতির চূড়ান্ত অবনমন ঘটেছে, তাও বারবার লিখেছেন তিনি। ফলে, আলোচনাবাদীরা বুখারির খুনে সরষের-মধ্যে-ভূতও দেখছে। যথারীতি সেই মতের বিরুদ্ধে উচ্চস্বর শোনা যাচ্ছে সরকারপক্ষীয় নানা সংবাদমাধ্যমেও। আলোচনাবাদীদের ‘দেশদ্রোহী’-ও বলছে জাতীয় সংবাদমাধ্যম। দেখা যাচ্ছে, তথাকথিত দেশাত্মবোধই এখন সরকারের একমাত্র আয়ুধ। সেই অস্ত্রে বিরোধীদের মোকাবিলা করার চেষ্টা চলছে দেশ জুড়ে।

তাতে কিছু নয়। কেননা, বুখারি সারাজীবনেই বারবার এমন অভিযোগ শুনেছেন রাজধানীর সাংবাদিকসতীর্থদের কাছেও যে, তিনি কাশ্মীর সম্পর্কে অন্ধ-সাংবাদিকতা (বায়াসড জার্নালিজম) করে থাকেন। তবু, তিনি ছিলেন নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী। মৃত্যুর আগে শেষবার তিনি টুইটারে লিখেছেন, "এই প্রথম রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের একটি রিপোর্টে কাশ্মীরে মানবাধিকার-লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমরা বহুদিন ঠিক এই কথাটিই বলে আসছি।"

দিল্লির সতীর্থদের উদ্দেশে তিনি টুইট করেছিলেন, "কাশ্মীরে আমরা মাথা উঁচু করে সাংবাদিকতা করি। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ ছাড়া আমাদের আর-কারও প্রতি দায়বদ্ধতা নেই। আমরা তা-ই করে যাব। কাশ্মীরের মাটিতে যা ঘটছে, অবিকল তা-ই লিখে যাব। আমরা নিরুপায়।"

কথাটি ওই, দায়বদ্ধতা। ইদানীং সাংবাদিকতা যতই প্রতিষ্ঠানমুখী ও আত্মমগ্ন হোক, তা-ই শেষকথা নয়। বুখারি কখনও কোনওরকম ব্যক্তিগত লাভালাভে দৃক্‌পাত করেননি। সাংবাদিকতার ধর্ম ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় তিনি ছিলেন অবিচল ও অকুতোভয়। হয়ত, দেশের এমন মুষ্টিমেয় সাংবাদিকদেরই তালিকা বানানোর হুমকি দিয়েছিলেন তথ্য-সম্প্রচারমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। হয়ত, এমন উন্নতশির কলমকারদের জন্যই সাংবাদিকসম্মেলন এড়িয়ে চলেন নরেন্দ্র মোদী। হয়ত, এমন প্রতিবাদী সাংবাদিকের নামই উঠে যায় জঙ্গিদের খতমতালিকায়। হয়ত, সে-কারণেই বুখারির মৃত্যুর পরে নীরবতাই নির্মোক নরেন্দ্র মোদীর।

বুখারি চিরকাল কাশ্মীরিয়াতের সমর্থক হলেও, জঙ্গিদের বিরোধিতায় তাঁর রচনা বারবার ঝলসে উঠেছে। বুখারিই প্রথম নন। কাশ্মীরে জঙ্গিরা ২০০০ সালে চিত্রসাংবাদিক প্রদীপ ভাটিয়া, ২০০৩ সালে সাংবাদিক পারভেজ সুলতানকেও খতম করেছে। তবু ভয় পাননি বুখারি। বারবার আলোচনার রাস্তা খুলে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু জঙ্গিগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রযন্ত্র সতত বন্দুকের নলে বিশ্বাসী। ফলে বুখারির মৃত্যু ছিল যেন কেবল সময়ের অপেক্ষামাত্র।

আরও পড়ুন: প্রসঙ্গ গৌরী লঙ্কেশ, একটি খোলা চিঠি

দেশে যেমন অনিবার্য্‌ ছিল এম এম কালবুর্গি থেকে গৌরী লঙ্কেশের খুন, তেমনই বাংলাদেশে ওয়াসিকুর বাবু, নিলয় নীল, রাজীব হায়দার, অনন্তবিজয় দাশ, অভিজিৎ রায় থেকে শাহজাহান বাচ্চুর মৃত্যুও যেন আকস্মিক ছিল না। প্রতিটি ঘটনায় খুনিদের অবলম্বন সেই তথাকথিত ধর্ম। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বিষয়টি কিছুটা ভিন্নমাত্রিক হলেও, সেই হিংসাও অনেকটাই ধর্মাশ্রিত। কেননা সেখানেও কাশ্মীরিয়াতের নামে বিপুলসংখ্যক হিন্দু-পণ্ডিতকে বিতাড়িত ও নিগৃহীত হতে হয়েছে। সেই সুযোগটি নিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরাও। তারা কাশ্মীরের স্বাধিকারের বিষয়টিকে দেখেছে মৌলবাদেরই দৃষ্টিকোণে।

আজ বোঝা যায়, কেবল রাজনীতি থেকে নয়, সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রত্যাখ্যান করতে না-পারলে তার রক্তবীজ মানুষকে ক্রমশ গ্রাস করবে। কেননা পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগ্রন্থের ভিতরেই উপ্ত আছে আধিপত্য ও হিংসার বীজ। কায়েমি স্বার্থে জাকির নায়েকের মতো ধর্মবণিকরা জনজীবনে সেই আগুন উসকে দেয়। ধর্মভীরু মানুষ ধর্মীয় হিংসার তাত্ত্বিক সমর্থন খুঁজে পায় ওইসব সচেতন ভ্রান্ত-প্রচারে। তাদের ভিতরে নাস্তিকতার বিরুদ্ধে মানসিক প্রতিরোধ তৈরি হয়। তারাও হয়ে ওঠে মৌলবাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থক। তৈরি হয় হিংসার বাতাবরণ।

মৌলবাদীদের সুবিধা হল, তাদের কোনওভাবেই যুক্তিসাপেক্ষ হতে হয় না। মানুষের অচলায়তনীয় ধর্মবিশ্বাসের সুযোগটি তারা নিঃশেষে নেয়। মানুষের কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বতঃসিদ্ধ, ফলত ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশ্বাস অটল। কিন্তু নাস্তিকরা সেই বিশ্বাসের অটল পাহাড়টিকেই সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। সেই খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থাব্দে রোমান-দার্শনিক লুসিয়াস অ্যানিয়ুস সেনেকা বলেছিলেন, "সাধারণের কাছে ধর্ম সত্য, জ্ঞানীদের কাছে তা মিথ্যা, শাসকের কাছে তা উপকারী।"

সেনেকার ২২০০ বছর পরেও আমরা সেই জ্ঞানসত্যের তাৎপর্য্ অনুধাবন করিনি। আমরা ভেবে দেখিনি, প্রকৃতপ্রস্তাবে, ধর্মগ্রন্থে যেমন নিহিত আছে যুক্তিশৃঙ্খলার অপরিমেয় অভাব, তেমনই বিদ্বেষ ও বিনাশের বিপুল প্ররোচনা। কেননা সেনেকা যেমন বলেছিলেন, ধর্মীয় অনুশাসনগুলি ভাবাই হয়েছে সাম্রাজ্যরক্ষা ও সাম্রাজ্যবিস্তারের কারণে। হজরত মহম্মদ চেয়েছিলেন নব্য-ইসলামধর্মের যোগসূত্রে আরবরাজ্য প্রসারিত ও চিরস্থায়ী করতে, আর মহাভারত রক্ষার নামে কৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে প্ররোচিত করেছিলেন ভ্রাতৃরাজত্ব-অধিকারে হিংসাত্মক হতে। তাঁর কূটনৈতিক ও ধর্মীয় হিংসাকে মান্যতা দিতে মহাভারতকারকে রূপায়িত করতে হয়েছে সাদা-কালো দুর্জন-সুজনের। মৌলবাদীদের কাছেও তেমনই বুখারি, গৌরী বা বাচ্চুর মতো বিরোধীরা শত্রু, হত্যাযোগ্য।

publive-image কলকাতায় রামনবমীতে অস্ত্রমিছিল (ফাইল চিত্র)

অথচ সাধারণ-বুদ্ধিতেই ঈশ্বরের অনস্তিত্ব কিংবা মৃত্যুপর-জীবনের প্রবঞ্চনা অনুভব করা কিছুই দুরূহ নয়। ভাবলে অবাক লাগে বিশ্বত্রাস ওসামা বিন লাদেন ছিল একজন উচ্চশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ। অথচ সেই লাদেনেরও অবলম্বন ওই ধর্মগ্রন্থ, যা বলেছে, এই আসমান ও জমিন পরমেশ্বর ছয়দিনে তৈরি করেছেন। বাইবেল বা সনাতন-ধর্মশাস্ত্রও ঐশ্বরিক সৃষ্টিরহস্যের চমকপ্রদ কাহিনি বয়ন করেছে। আমরা দেখেছি, ঢাকার অভিজাত গুলশান-অঞ্চলের মৌলবাদী-হামলায় যুক্ত ছিল যে-সব তরুণ, তারা কেউই মাদ্রাসায় পড়েনি, তারা সকলেই প্রগতিশীল ইংরাজিমাধ্যমের ছাত্র। অথচ তারাও ধর্মগ্রন্থসম্বল হয়ে ইহজীবনের পরিবর্তে বিশ্বাস করেছে জন্নতের হুরিপরিসুরার অলীক-হাতছানিতে। সে-জন্য মৃত্যুভয়ও জয় করেছে তারা।

মৃত্যুভয়হীনের কাছে কোনও হিংসাভিযানই বিপজ্জনক নয়। গৌরীহত্যায় পুলিশ সম্প্রতি যাকে গ্রেফতার করেছে, সেও পুণের এক নামী প্রযুক্তিবিদ। এই প্রেক্ষিতে কলকাতার তরুণ প্রজন্মের শিক্ষিত বাঙালিও যখন কলম ফেলে রামনবমীর শোভাযাত্রায় হাতে তুলে নেয় ধারালো তরোয়াল, তখন আমরা সিঁদুরে মেঘ পুঞ্জীভূত হতে দেখি পুবের আকাশেও। বুখারি নাস্তিক ছিলেন না। কিন্তু তিনি পরিপ্রশ্নে বিশ্বাসী ছিলেন। বারবার আলোচনার কথা বলেছেন। কিন্তু জঙ্গি মোকাবিলায় রাষ্ট্রযন্ত্রও যখন মৌলবাদী হয়ে ওঠে, আলোচনার বদলে হয়ে পড়ে অস্ত্রনির্ভর, তখন বুখারি বা গৌরীদের আর কোনও নিরাপত্তা থাকে না। জনজীবনের পক্ষেও সেই পরিস্থিতি আতঙ্কের, অসহায়তার।