কয়েকদিন আগের কথা। ফেসবুক খুলেই দেখি আমার পরিচিত একটি মেয়ের পোস্ট। খানিকটা গরম মেজাজেই সে লিখেছে 'সিঁদুর-খেলা' প্রসঙ্গে। তার বক্তব্য, 'সিঁদুর-খেলা' একটি অতি প্রচলিত রীতি। পালিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। এক্ষেত্রে যাঁরা খেলছেন, তাঁরা সারা বছর সধবা হওয়া সত্ত্বেও শাঁখা-সিঁদুর পরেন কিনা, সেই প্রশ্ন অবান্তর। এই নিয়ে একদল তথাকথিত 'সংস্কারী'র মেয়েদের উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গ ও বক্রোক্তির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানিয়েছে সে এই পোস্টে।
মেয়েটিকে বহু বছর চিনি। আধুনিকমনস্ক ও যুক্তিবাদী। যাকে আমরা সামাজিক রুচি ও সংস্কৃতি বলি, তা মেয়েটির মধ্যে পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। বলা বাহুল্য, তার জেহাদ সেই তথাকথিত 'সংস্কার'-এর বিরুদ্ধে, যা ইদানীংকালে হঠাৎ করে আমাদের সামাজিক জীবনে অনুপ্রবেশ করেছে। এই সংস্কার 'সু' না 'কু', তার চেয়েও বড় কথা, এখানে ধর্ম, সমাজ, সংস্কার ও রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে এক নতুন জটিলতার সৃষ্টি করেছে বাঙালি তথা ভারতীয় জনজীবনে।
আজকাল সব বিষয়েই আমাদের প্রথম জ্ঞান ও তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ ঘটে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশেষত ফেসবুক যেন চারপাশের ঘটনাক্রমের যথার্থ আয়না। মেয়েটির পোস্ট পড়ে বুঝলাম, দশমীর দিন ঠাকুর বিসর্জনের প্রেক্ষিতে এই 'সিঁদুর-খেলা'-কে ঘিরেই নতুন করে নীতি পুলিশির খাঁড়া তুলেছেন কেউ। আজকাল অনেক বিবাহিত মহিলাই শাঁখা-সিঁদুর পরেন না। এটা পুরোপুরি একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির কিছু বলার থাকতেই পারে না। আর দুর্গাপুজোর 'সিঁদুর-খেলা'র সঙ্গে এটা মেলানো তো রীতিমতো হাস্যকর।
অহেতুক এই বিতর্ক উস্কে দেওয়াটা কতটা অপ্রাসঙ্গিক, সেটা সামাজিক অনুশাসনের নিরিখেই প্রথমে খুঁজে দেখা যাক। 'সিঁদুর-খেলা'র প্রচলন পুরানমতে। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি বাঙালি হিন্দু সংস্কার। পুজো প্যান্ডেলে বা প্রাঙ্গনে বিসর্জনের ঠিক আগে মহিলারা সিঁদুর দিয়ে দুর্গাপ্রতিমাকে বরণ করেন। সেই সিঁদুর একে অপরকে পরিয়ে দেওয়া ও শেষে মিষ্টিমুখ, এভাবেই 'সিঁদুর-খেলা' পালিত হয়। অনুভূতি বলে, উৎসবের শেষটা যাতে প্রীতি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে আনন্দমুখর হয়ে ওঠে, তার জন্যই এই প্রচলন। সধবা মহিলারাই মূলত এতে অংশ নেন। কুমারীরাও নিয়ে থাকেন। সিঁদুর-খেলায় বিধবা মহিলারা অংশ নেন না। শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনেই এটা ঘটে এসেছে। এক্ষেত্রে সামাজিক অনুশাসন পুরো মাত্রায় শাস্ত্রীয় নিয়মের অনুসারী। মা দুর্গাকে বিসর্জনের আগে বরণ করে নেওয়ার এই বিভেদ নীতি মেনে বা মানিয়ে নেওয়া কতটা সঠিক, তা আগামীর ইতিহাস বলবে।
ডিভোর্সিদের জন্য শাস্ত্রীয় বিধান এক্ষেত্রে খুব একটা পরিষ্কার নয়। তবে তাঁরা তো এমনিতেই সমাজে অস্তিত্ব নিয়ে নানা প্রশ্নে বিপর্যস্ত। 'সিঁদুর-খেলা'য় তাঁরা অংশ নেওয়ার সুযোগ পান কিনা ঠিক জানা নেই। এই অধিকার, অনধিকারের ক্ষেত্রগুলোই বা কারা নির্ধারণ করেন, কে জানে। এটা তো বোঝাই যাচ্ছে, সিঁদুর-খেলার সঙ্গে ধর্মাধর্মের চেয়েও সামাজিক মিলনমেলার সম্পর্কটা অধিক সম্পৃক্ত। সেক্ষেত্রে ডিভোর্সি, বা যেসব বিবাহিত মহিলা শাঁখা-সিঁদুর পরেন না, তাঁরা সিঁদুর-খেলায় মাতবেন কিনা, সেলফি তুলে পোস্ট করবেন কিনা, এই প্রশ্নগুলি তোলা অর্থহীন নয় কি?
সিঁদুর কী? একটি রঞ্জক পদার্থ। হিন্দুধর্মে সিঁদুর পরা নারীর বিবাহধর্ম পালনের প্রতীক। বিবাহিত বাঙালি মেয়েদের সিঁথিতে রেখা ও কপালে সিঁদুরের টিপ পরার ইতিহাস অতি প্রাচীন। শাস্ত্রমতে বিধবাদের সিঁদুর পরা নিষিদ্ধ। এছাড়া বিভিন্ন পুজাতেও সিঁদুরের ব্যবহার প্রচলিত। হিন্দু ধর্মমতে বিশ্বাস, এটি স্বামীর দীর্ঘজীবন বয়ে আনে। বলা হয়, সিঁদুরের লাল রং শক্তি ও ভালোবাসার প্রতীক। আবার সিঁদুর পরা প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদরা বলেন, লালবর্ণ সিঁদুর কপালে ধারণ করার অর্থ জড়িয়ে রয়েছে আদিম উর্বরাশক্তির উপাসনার সঙ্গে। আবার সেই আদিম কাল থেকেই লাল সিঁদুরকে এভাবেই বেছে নেওয়া হয়েছে একান্ত প্রসাধন হিসেবেও।
প্রসাধন। অনেকেই আজকাল এভাবেই দেখতে চাইছেন সিঁদুরকে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের বহু পুরুষকেই বলতে শুনেছি, উচিত-অনুচিতে যাচ্ছি না, মেয়েদের শাঁখা-সিঁদুর পরলে দেখতে ভালো লাগে। এই ভালো লাগার মধ্যে কোনও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা খোঁজার কোনও যুক্তি এক্ষেত্রে মোটেই সমর্থন করি না আমি। সম্পর্কের রসায়নে এই সব ছোটখাটো ভালো লাগা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তবে, সেটাও তো একান্ত ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়।
উল্টো যুক্তিতে, যে মহিলারা সিঁদুর পরতে পছন্দ করেন না, তাঁদেরও সমালোচনা করার অধিকার কারও নেই। অনেকেই আছেন যাঁরা প্রথম জীবনে পরলেও, পরে সিঁদুর পরা ছেড়েছেন বিভিন্ন কারণে। অনেকের সিঁদুরে অ্যালার্জি হয় বলেও শুনেছি। আসলে প্রাচীনকালে আরও অনেক কিছুর মতোই সিঁদুরও তৈরি হতো প্রাকৃতিক উপকরণে। এখন সবই কেমিক্যাল। ত্বকে তার ক্ষতিকারক প্রভাব পড়তেই পারে।
সিঁদুরের ব্যবহার প্রসঙ্গে একটা বেশ মজাদার যুক্তি ইদানীং খুব বেশি চোখে পড়ছে। কানেও শুনছি কোথাও কোথাও। শাঁখা-সিঁদুর কম্বো হলো নারীর সুরক্ষা কবচ। পুরুষকুল নাকি নারীর সিঁথির সিঁদুরকে 'নো এন্ট্রি বোর্ড' হিসেবে দেখে। এর চেয়ে হাসির কথা আর কী হতে পারে? তাই যদি হয়, তাহলে তো কোনও বিবাহিত মহিলাই ধর্ষণ বা লাঞ্ছনার শিকার হতেন না। আসলে সুরক্ষা ব্যাপারটাই তো আপেক্ষিক। সেটা কখনোই ওই ছবির ডায়ালগের 'এক চুটকি সিন্দুর কা কিমত তুম কেয়া জানো রমেশবাবু' জাতীয় সস্তা ব্যাপার হতে পারে না। মোদ্দা কথা, কোনও যুক্তিতেই সিঁদুর পরার সঙ্গে সুরক্ষার কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
একই ভাবে নারীর সিঁদুর পরা না পরার সঙ্গে দুর্গা বিসর্জনের আগে অনুষ্ঠিত 'সিঁদুর-খেলা'র কোনও সম্পর্ক অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পেলাম না। এই খেলা সম্পূর্ণভাবে উৎসব অন্তে আনন্দে অবগাহন। মিলনের, সম্প্রীতির আবহে উজ্জীবিত হওয়া। যার ইচ্ছে হবে, সে-ই এতে মেতে উঠতে পারে। খুশির আসরে সবাইকে সাদরে ডেকে নেওয়াই তো বাঙালির আপন সংস্কৃতি।
এদেশের অনেক অঞ্চলেই দুর্গাপুজোয় সানন্দে অংশ নেন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁদেরকে কি এই আসরে সমাদর জানাই না আমরা? ঠিক সেভাবেই আজকের কোনও তরুণী তথাকথিত সব সংস্কার ঝেড়ে ফেলে, সিঁদুর-খেলায় মেতে, সিঁদুরের লালিমায় একটা দিন সেজে উঠলেই বা ক্ষতি কী? এই নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেন, তাঁদের এই 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' গিরি এবার বন্ধ হোক।