Advertisment

রসিকতা যখন অমানবিক, তামাশা যখন বিকৃতি

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক জুড়ে যখন এইসব হাসি-মস্করার লহর চলছে, তখন এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষগুলো কী করছেন? এটা জানার জন্য খুব বেশি চেষ্টার দরকার পড়ে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
cyclone bulbul memes

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

"বুলবুলকে শুধু ভালোবেসে বলেছিলাম, নাচ মেরি বুলবুল তো পয়সা মিলেগা। ও দেখলাম ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে।"

Advertisment

"ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আসছে, সেটা বড় কথা না। যে যার বুলবুলিকে শক্ত করে ধরে রেখো। যেন না উড়ে যায়।"

"সুনামি, আয়লা, বুলবুল। উঃ, সব ঝড় মেয়েদের নামে। এইজন্যই বলি ওদের থেকে সাবধান!"

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল প্রসঙ্গে রসিক জনতার রসিকতার অল্প ক'টি নিদর্শন। রসিকতা, যা রসবোধ বহির্ভূত। রসিকতা, যা নিষ্ঠুরতার নামান্তর। এখন অজস্র। সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে। প্রবল পরিমাণে ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুকের ক্ষেত্রে লোকজন এই পোস্টগুলিতে লাইকও দিয়েছেন। অনেকে এই রসিকতার প্রত্যুত্তরে এমনই হাসি-মজা-ইয়ার্কি করেছেন। উল্লাসে উচ্চকিত হয়েছেন।

একালের রসিক জনতা। সবেতেই হাসি-মজার খোরাক খুঁজে নেন। জীবনটা যেন শুধুই আমোদ-প্রমোদে ভেসে যাওয়া। মানুষের মৃত্যুর হাহাকার, সর্বহারা হয়ে পথে বসা, কিছুতেই কিছু যায় আসে না। ও যার হয়েছে তার হয়েছে, আমার কী? বা আমাদের কী? এমন অবস্থা, মুষ্টিমেয় দু-একজন যদি এর প্রতিবাদ করেন, তবে তাঁদের নিয়েও শুরু হয় নতুন রসিকতা। তাঁদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-অপমানে বিদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ, এই অমানবিক প্রক্রিয়া চলুক। ফুর্তি জিন্দাবাদ।

আরও পড়ুন: মারণ নেশার নাম এখন স্মার্টফোন, কিন্তু আমি জানি, মুক্তি সম্ভব

'বুলবুল' এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের নাম। সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক বিভীষিকা। যার ফল প্রাণহানি, লক্ষ লক্ষ লোকের গৃহহীন হওয়া। ক্ষেতের পর ক্ষেত জুড়ে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া। বিধ্বস্ত মানুষের জীবন। বহু পরিবারের এমন অবস্থা, একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। জেটি ভেঙেছে। নৌকো ডুবেছে। মাছ ধরতে গিয়ে নিরুদ্দেশ মানুষ। পরিবারের মানুষ দুশ্চিন্তায় পাগলপারা। অবর্ণনীয় এক পরিস্থিতি।

তা নিয়ে রসিকতা করছি আমরা। আমাদের হলো কী? আমরা কি নিজেদের আনন্দ, উল্লাস, ফুর্তির বাইরে চারপাশের চলমান জীবনের বাকি সবকিছু দেখতে ভুলে যাচ্ছি?

বুলবুল অতি সাম্প্রতিক এক বিষয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গত কয়েক বছর ধরেই এইরকম এক রুচিহীন, চেতনাহীন, অমানবিক রসিকতার ট্রেন্ড চলছে। বলা বাহুল্য, সোশ্যাল মিডিয়াকে ঘিরেই যার বাড়বাড়ন্ত। আমাদের বোধ, চেতনা, মনন, যাবতীয় অনুভূতি সেই ভার্চুয়াল জগৎটাকে কেন্দ্র করেই অধিক আবর্তিত আজ। এই জগতে আমিই সব। আমার ভাবনার নিরিখেই আমি বাকিদের দেখি বা দেখি না। এভাবেই বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে, অপরের বাঁচামরার বিষয়ে উদাসীন হতে হতে আমরা কি 'সংবেদনশীল' শব্দটাই অভিধান থেকে মুছে ফেললাম?

অথচ এটা আমাদের সংস্কৃতি নয়। আমরা কেন, পৃথিবীর কোনও জাতিরই নয়। এ যে মানবতার ঘোর পরিপন্থী। কারও চরম সর্বনাশ, চূড়ান্ত দুর্গতি, কী করে অপরের হাসি-ঠাট্টার বিষয় হতে পারে? আমরা কি এই সামান্য চেতনাটাও হারিয়ে ফেলেছি? সোশ্যাল নেটওয়ার্ক জুড়ে যখন এইসব হাসি-মস্করার লহর চলছে, তখন এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষগুলো কী করছেন? এটা জানার জন্য খুব বেশি চেষ্টার দরকার পড়ে না। শুধু নিজেদের একবার ওই মানুষগুলোর জায়গায় রাখলেই অনুভূত হয় মর্মান্তিক অবস্থাটা।

আরও পড়ুন: ঘরের হিংসা ঘরেই শেষ হয় না

ভৌগোলিক পরিস্থিতি অনুযায়ী, মোটামুটি দেখা যায় এই জাতীয় ঘূর্ণিঝড় ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ওপরেই ঘোরাফেরা করে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় এদের মারণ প্রভাব বেশি দেখা যায়। গত কয়েক বছরের রেকর্ড অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সময়ে ঝড়ের বেগ পশ্চিমবঙ্গকে ছুঁয়ে বাংলাদেশে ধাবিত হচ্ছে। এই বাংলার তুলনায় আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ঝড়ের প্রকোপ অনেক বেশি ঘটছে। অর্থাৎ, আমরা অল্পস্বল্প ক্ষতির মুখে পড়লেও বিপদমুক্ত হচ্ছি বারবার।

বুলবুলের ক্ষেত্রে এই বাংলাদেশের দিকে মুখ ঘোরানোর ব্যাপারটা দেরিতে হয়েছে। এই বাংলায় ধ্বংসলীলা চালিয়ে বাংলাদেশে গেছে বুলবুল। অত্যন্ত লজ্জা ও দুঃখের হলো, এই বিষয়টা নিয়েও লোকজন রসিকতা করতে ছাড়েন না। প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে চলে। সে কোথায় সৃষ্টি করবে আর কোথায় ধ্বংস, তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু মানুষ সেই নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়েই তো মানবিক আচরণ করে। আমরা কোন জাতীয় মানুষ, যারা শুধু নিজেদের ভালো থাকার উল্লাসে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মানুষগুলির বিপর্যয়কে স্বাগত জানাই! এক্ষেত্রেও একটু নীরবতা, একটু নম্র সহানুভূতি কি কাম্য নয়?

আসল কথা হলো স্থান-কাল-পাত্র। আসল কথা হলো একটু বিবেচনাশক্তি। কখন, কোথায়, কোন প্রেক্ষিতে কী আচরণ করব, সেটা ভাবা জরুরি। আমার ব্যবহারে চারপাশের মানুষগুলির মনে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটাও ভাবতে হবে। সামাজিকতার প্রথম পাঠই তো তাই। একদিন এই পটভূমি থেকেই তো সমাজবদ্ধ হয়েছিল মানুষ। সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে একে অপরের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। আমরা সভ্য হয়েছি। আধুনিক হচ্ছি। উন্নতির পথে চলেছি। সেটা কি এই প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়ার শর্তে?

পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনাক্রমকে প্রত্যেকে নিজের উপলব্ধির আলোয় দেখবে, সেটাই যদি স্বাভাবিক ধরেও নিই, তাহলেও তো এ আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে তো একজন পরিণত মানুষের উপলব্ধি প্রসঙ্গেই প্রশ্ন উঠে যায়। লক্ষণীয়, এই অপরিণত মনস্কতা, এই চেতনাহীন উপলব্ধি (?) আজ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের দৌলতে মহামারীর আকার ধারণ করতে চলেছে। বুঝতেই পারছি না, অজান্তেই এক অমানবিক অভ্যাসের দাসে পরিণত হচ্ছি আমরা।

আরও পড়ুন: দূষণ রোধে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? আমি, আপনি, আবার কে?

এটা আসলে এক সর্বাঙ্গীন বিকৃত মানসিকতা। একদল মানুষ নাকি একটা চক্র সতত সক্রিয় তাদের উন্মত্ত ও বিকৃত সৃজনশীলতা নিয়ে। অপরের অসহায়তা, সংকট, অসুবিধা, সমস্যায় জর্জরিত হওয়াকে এরা তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করছে। উদ্দেশ্য, নিজেদের বিকৃত ভাবনাকে সস্তা বিনোদনের উপকরণ হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া। নিঃসন্দেহে সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা এ ব্যাপারে অনুঘটকের কাজ করছে।

সোশ্যাল মিডিয়া এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে সবারই আজ স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এমন কোনও মাপকাঠি নেই, যার দ্বারা এই বিচরণ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের নিয়ম নির্ধারকরাও এসব বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন এখনও। তাঁদের বিচারে তথাকথিত নগ্নতা, যৌনতা, হিংস্রতা, এগুলোই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক। অপরের যন্ত্রনা নিয়ে রসিকতা হয়তো কোনওদিনই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং নিয়ম-নীতির আওতায় আসবে না। কিন্তু আমরা কি একটুও ভাবব না এ বিষয়ে?

না ভাবলে দেখা যাবে, একদিন আমিও এদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছি। আমি ও আপনি। বৃহৎ অর্থে আমরা। এমনকী যারা এইসব শুরু করেছে তারাও। আগুন যখন ছড়ায়, তখন খাদ্য-খাদক বিভেদ মানে না। সে হলো সর্বগ্রাসী। এই সর্বগ্রাসী বিকৃতমনস্কতার ফাঁদে একটু একটু করে ধরা পড়ছি আমরা। কখনও জ্ঞানত, কখনও অজান্তেই। সময় এসেছে ভেবে দেখার। সময় হয়েছে বিষ শোধনের। পরের প্রজন্ম আমাদের অনুসরণ ও অনুকরণেই থেমে থাকবে না। তারা তাদের মতো করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করবে। আরও একটু বিকৃতির পথে এগিয়ে যাবে সমাজ। সেই ভুল অবস্থান তৈরির আগেই পূর্ণ সচেতন হতে হবে আমাদের। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এই অমানবিক প্রক্রিয়া। নাহলে আক্ষেপের সীমা থাকবে না।

Facebook Social Media
Advertisment